“একটা অত্যাচারের প্রতীক, একটা ঘৃণার বস্তু, এবং বৈষম্য ও জুলুমবাজি চালানোর একটা হাতিয়ার” – আফস্পা অর্থাৎ ‘সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন’ সম্পর্কে এটা ছিল জীবন রেড্ডি কমিটির পর্যবেক্ষণ। আর সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রতিদিনই এই অভিমতের যথার্থতার প্রমাণ দিয়ে চলেছে। সেনাবাহিনীর হাতে কাশ্মীরের তিন নিরপরাধ যুবকের হত্যার ঘটনা দু’মাসেরও বেশি সময় আগে ঘটলেও সেনাবাহিনীর নিজের স্বীকারোক্তির সূত্রে ঘটনাটা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে কিছুটা নাড়াচাড়া হয়েছে অতি সম্প্রতি। রাজৌরির তিন যুবক – ইবরার আহমেদ, মহম্মদ ইমতিয়াজ, মহম্মদ ইমরান (এরা সম্পর্কে তুতো ভাই এবং সবচেয়ে ছোটটির বয়স ১৬ বছর) – কাজের খোঁজে গিয়েছিল সোপিয়ান। সেখানেই সেনারা ১৮ জুলাই তাদের হত্যা করে। ছেলেগুলোর সঙ্গে বাড়ির লোকজনের দীর্ঘদিন যোগাযোগ না হওয়ায় অবশেষে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া নিহত তিন “জঙ্গি”র ছবি দেখে পরিবারের লোকজন জানতে পারে যে তাদের বাড়ির ছেলেরা সেনাদের হাতে নিহত হয়েছে। ভুরি-ভুরি ঘটনায় যেমন হয়ে থাকে, এই ঘটনাটার ওপর থেকেও হয়ত সেনাদের নির্মমতার পর্দাটা সরত না। কিন্তু ঘটনাটা নিয়ে পরিবারের তরফে ভুয়ো সংঘর্ষের অভিযোগ জানানো, সোশ্যাল মিডিয়ায় শোরগোল ওঠা, কিংবা নিহত যুবকদের জ্ঞাতিদের সেনাবাহিনীতে কাজ করার সূত্রে বাহিনীতে যোগাযোগ থাকা, যে কোনো কারণেই হোক সেনাবাহিনীর কর্তারা ১১ আগস্ট ঘটনাটার তদন্তের নির্দেশ দেন। এবং তদন্তের নির্দেশের এক মাসেরও কিছু বেশি সময় পর সেনাবাহিনী জানায় – “আপাতদৃষ্টির তথ্যপ্রমাণের” ভিত্তিতে তাদের মনে হয়েছে যে আফস্পার অপব্যবহার করে ওই যুবকদের মেরে ফেলা হয়েছে।
ভারতীয় রাষ্ট্র দেশের নাগরিকদের “পাকিস্তান মদতপুষ্ট সন্ত্রাস”এর চশমা পরেই কাশ্মীরকে দেখতে অভ্যস্ত করিয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে চালানো সেনাদের সমস্ত অপরাধের ঢাল হয়ে ওঠে “সন্ত্রাস” এবং শাস্তিহীনতার রক্ষাকবচে মোড়া আফস্পা। এই ঘটনাটার ক্ষেত্রেও সেই প্রচেষ্টাই হয়েছিল। তিন যুবককে হত্যার পর তাদের “সন্ত্রাসে” যুক্ত জঙ্গি অভিহিত করে পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয় – “তল্লাশি চালানোর সময় জঙ্গিরা সেনাদের ওপর গুলি চালায় এবং সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে পুলিশ ও সিআরপিএফ যোগ দেয়। সংঘর্ষে তিন অজ্ঞাত পরিচয় জঙ্গি নিহত হয়। সংঘর্ষ স্থল থেকে তিন জঙ্গির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জঙ্গিদের সনাক্ত করা এবং কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে তারা যুক্ত তা জানার চেষ্টা হচ্ছে।” কাজের খোঁজে যাওয়া নিরীহ তিন শ্রমিককে হত্যা করে পুলিশের বয়ানে এইভাবে জোড়া হল সংঘর্ষের, সেনা ও জঙ্গিদের মধ্যে গুলি চালাচালির রেডিমেড গল্প। সেনারা তাদের তদন্ত রিপোর্টে কিন্তু বলেনি যে, নিহত তিন শ্রমিক ছিল নিরপরাধ যুবক। এখনও ওরা বলে চলেছে তিন যুবক ছিল “অজ্ঞাত পরিচয় সন্ত্রাসবাদী” এবং “সন্ত্রাসবাদে ওদের যোগ নিয়ে” পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। ঘটনাটার প্রকৃত উন্মোচন না ঘটলে সাধারণ ভারতবাসীর মনেও কাজের খোঁজে যাওয়া নিরপরাধ তিন যুবকের সন্ত্রাসবাদী পরিচয়ই গেঁথে যেত এবং তাদের হত্যা করার সেনাদের ‘পবিত্র অধিকার’ও অনুমোদন পেত। যারা নিষ্পাপ কৈশোর-যৌবনকে এভাবে অবলীলায় নিকেশ করে দেয় তাদের কি শাস্তি হবে না? জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল এস পি বৈদও বলেছেন, “নিরপরাধদের হত্যা করা এবং তাদের সন্ত্রাসবাদী বলে চালানোটা সবচেয়ে বর্বরোচিত অপরাধ এবং যারা একাজে জড়িত তাদের হত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে হবে।”
সেনাদের হাতে নিরপরাধ তিন যুবকের হত্যার এই ঘটনার উন্মোচন কি সেনাদের বন্দুকবাজি তথা আফস্পার নির্বিচার প্রয়োগকে একটুও নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে? কাশ্মীরের ‘নয়া স্বাভাবিক অবস্থা’র আগে অর্থাৎ ২০১৯-এর ৫ আগস্টের পূর্ববর্তী পর্যায়ে যেমন এ কথা ভাবা যেত না, কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা হরণ এবং তাকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করে তুলে সেনা ও আধা-সেনার ঘেড়াটোপে মুড়ে দেওয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে সে কথা ভাবা তো এখন বাতুলতা। এই কদিন আগেই, ১৭ সেপ্টেম্বর এরকম নিরীহ আর এক মহিলার হত্যা সামনে এল। আকিব সফি মাকে নিয়ে প্রতিদিনের মত সেদিনও গাড়ি চালিয়ে সকালে তাদের বেকারিতে যাচ্ছিল। দোকানের কাছাকাছি পৌঁছে সে একটা সেনা কর্ডন দেখতে পেল এবং গোলমালের আঁচ পেয়ে গাড়ি ঘোরাচ্ছিল। আর সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ির পেছনের কাচ ভেদ করে গুলি লাগল আকিবের মায়ের মাথার পিছনে, আর নিমেষেই গাড়ির মধ্যে তাঁর দেহ নিথর হয়ে গেল। এরপরও সেনা-পুলিশের অমানবিকতা একটুও থামল না। আকিবের কথায় – “আমাদের নিয়ে যাওয়া হল কাছের একটা কন্ট্রোল রুমে এবং পরে বাটামালু থানায়, যেখানে আমায় রক্তভেজা জামাকাপড়ে শায়িত মায়ের মৃতদেহ নিয়ে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হল।” পুলিশ বলছে তার মায়ের মৃত্যু নাকি জঙ্গিদের গুলিতে হয়েছে। কিন্তু আকিবদের বিশ্বাস সেনাদের গুলিতেই তার মা নিহত হয়েছে – “তারা সেনা হতে পারে, সিআরপিএফ বা এসওজি হতে পারে, আমরা জানি না।” জঙ্গিদের গুলিতেই আকিবের মায়ের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করার পরও পুলিশের কিন্তু ভয় হয়েছিল যে ওই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাদের প্রতিবাদের মুখে পড়তে হবে – “ওরা আমাদের বলল যে আমরা যেন কাগজে লিখে এই প্রতিশ্রুতি দিই যে কোনো প্রতিবাদ করা হবে না।” তার পরও প্রতিবাদ কিন্তু হয়েছিল। ভারতীয় রাষ্ট্রের কাছে, সেনা-পুলিশের চোখে কাশ্মীরের নাগরিক কি এমনই যাদের জীবন যখন-তখন হরণ করা যায়? নিহত হওয়ার পর সামান্য সম্মানটুকুও তাদের প্রাপ্য নয়? আকিবের হৃদয় নিংড়ানো প্রশ্ন – “আমার মা কী দোষ করেছিল? কেন তাকে এভাবে মরতে হল? একজন কাশ্মীরির জীবন কি এতই সস্তা যে যখন ইচ্ছে হবে তুমি তা ছিনিয়ে নিতে পারবে?”
কাশ্মীরে আফস্পা কতদিন বলবৎ থাকবে? কাশ্মীরের জনগণ কোনোদিনই কি আফস্পার কবল থেকে মুক্ত হতে পারবেন না? এ প্রশ্নের উত্তর এখন বোধকরি কেউই দিতে পারবেন না এবং কাশ্মীরও সেনা-পুলিশের বুটের তলায় নিস্পেষিত হতে থাকবে। সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু একাধিক মামলায় বলেছে যে, অসামরিক এলাকায় বিক্ষোভ দমনে দীর্ঘকাল সেনাবাহিনীর ব্যবহার গণতন্ত্রকে প্রহসনে পর্যবসিত করে। মনিপুরে ১৯৫৮ সালে নাগা বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন চালু হওয়ার ছয় দশক পর আজও সেখানে আফস্পা চালু রয়েছে। আফস্পা কালক্রমে ভারতীয় রাষ্ট্রের কাছে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার আকাঙ্খা ও ক্ষোভ দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠে নানান রাজ্যেই বলবৎ হয়। কাশ্মীরেও ১৯৯০ সালে চালু হয়ে তিন দশকেরও বেশি সময়কাল ধরে আফস্পা বলবৎ রয়েছে এবং সেনা বাহিনীর হাতে অসংখ্য নির্মমতা সংঘটনের মাধ্যম রূপে দেখা দিয়েছে। ২০১৬ সালে এক মামলার রায়ে (যে মামলাটা দায়ের করেছিল মনিপুরে সেনাদের হাতে বিচারবহির্ভূত ধারায় নিহত পরিবারগুলোর সমিতি) সুপ্রিম কোর্ট বলে যে, অসামরিক অঞ্চলের বিক্ষোভ দমনে অনন্তকাল ধরে আফস্পার মতো আইনের ব্যবহার গণতন্ত্রে কখনো চলতে পারে না। বিচারপতি মদন বি লকুর এবং ঊমেশ ললিত তাঁদের রায়ে জানান, অশান্তি দমনে সেনা বাহিনীর ব্যবহার হতে পারে অসামরিক প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করার জন্যে, এবং একটা যুক্তিযুক্ত নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে তার সমাধান হবে এটা ধরে নিয়ে। রায়ে তাঁরা বললেন, “যদি দীর্ঘকাল অথবা অনির্দিষ্ট কালের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থা না ফেরে সে ক্ষেত্রে তার ফলাফল কী হবে? আমাদের মতে এটা স্বাভাবিক অবস্থার পুনরুদ্ধারে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ফলপ্রসূ সহায়তা নিতে অসামরিক প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই বোঝাবে, অথবা বোঝাবে স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে অসামরিক প্রশাসনকে কার্যকরী সহায়তা দিতে সেনাবাহিনীর ব্যর্থতাকে অথবা উভয়কেই। ঘটনা যাই হোক না কেন, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসাকে অছিলা করে দীর্ঘকাল, স্থায়ী বা অনির্দিষ্টকাল ধরে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যেতে পারে না … কেননা তা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই বিদ্রুপ করবে। …” ওই রায়ে আরও বলা হয়, “তারা ‘শত্রু’ শুধুমাত্র এই অভিযোগে বা সন্দেহে আমাদের দেশের নাগরিকদের হত্যা করতে যদি সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়োজিত করা বা কাজে লাগানো হয় তবে শুধু আইনের শাসনই নয় আমাদের গণতন্ত্রও গুরুতর বিপদে পড়বে। …” কাশ্মীরে জঙ্গি সমস্যার কথা কেউই অস্বীকার করবেন না। কিন্তু জঙ্গি আছে বলেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বঞ্চিত কাশ্মীরের সমগ্ৰ জনগণকেই সন্দেহের চোখে দেখা, তাদের সন্ত্রাসবাদী জ্ঞান করাটা কাশ্মীরকে ভারতীয় রাষ্ট্রের হাতে উপনিবেশেই পর্যবসিত করে। সুপ্রিম কোর্টের ওই পর্যবেক্ষণ ভারত রাষ্ট্রের আজকের পরিচালকদের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে বলে তো মনে হয় না। কাশ্মীরকে চির অশান্ত রাখতেই শাসকদের ফায়দা। সাম্প্রদায়িকতা, ইসলামোফোবিয়া ও জাতীয়তাবাদের যে পাঁচনকে তারা ভারতীয় জনগণের মতাদর্শগত খোরাক করতে উঠেপড়ে লেগেছেন, কাশ্মীর হয়ে উঠেছে তার বড় পাকশালা। কিন্তু রাজনৈতিক সমস্যার সামরিক সমাধানের এই উদ্যোগ কি অনন্তকাল ধরে ইতিহাসের প্রশ্রয় পেয়ে যাবে? বিচারবুদ্ধি কি এই কথাটাও বলে না যে, কাশ্মীরকে যথার্থ অর্থে ভারতীয় রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করতে হলে শুধু তার ভৌগলিক ভূখণ্ডই নয়, তার জনগণকেও ভারতের নাগরিক বলে জ্ঞান করতে হবে এবং কাশ্মীরের জনগণের বুক থেকে সেনা ও আফস্পার ভারের অপসারণ ছাড়া তা সম্ভব হতে পারে না? গণতন্ত্রই কি একাত্মতার যথার্থ বনিয়াদ নয়?