কোভিড-১৯ মহামারী। ধারা ১০(২) ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইন, ২০০৫ (ডি এম অ্যাক্ট) মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকার ২৪ মার্চ ২০২০ দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেছিল। যা কার্যকরী হয়েছে ২৫ মার্চ ২০২০ থেকে।
২৯ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নির্দেশ দিলেন লকডাউন সময়কার মজুরি/বেতন নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে। এই সময় লে-অফ বা কাউকে কাজ থেকে ছাঁটাই করা যাবে না।
এপ্রিল মাসে বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠান, মার্চ মাসে যতদিন কাজ হয়েছে তারই মজুরি দিয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারি এবং ইউনিয়নগুলি বুঝতে পারে, লকডাউনের সময়কার মজুরি পেতে তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। শ্রমিক কর্মচারিরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের সামনে ধর্ণা, অবস্থান শুরু করে দিলেন। কেন্দ্রীয় ইউনিয়নগুলো, বিভিন্ন ফেডারেশন এবং কারখানার ইউনিয়নগুলো যৌথভাবে ও এককভাবে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য শ্রম দপ্তরে ভারতের শ্রম বিরোধ আইন ১৯৪৭ মোতাবেক স্মারকলিপি পাঠিয়ে দেয়। শিল্প প্রতিষ্ঠানের ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার’ যেখানে মহামারীতে মজুরি দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে, স্মারকলিপির সাথে তা জুড়ে দেওয়া হয়। উল্লেখ করা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশিকাটি।
শ্রমিক অসন্তোষ ক্রমশ বাড়তে থাকে। শ্রমিক অসন্তোষ ঠেকাতে কারখানা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৪০০০/৫০০০ টাকা অগ্রিম দিয়েছে। শর্ত, কারখানায় কাজ চালু হওয়ার পর বেতন থেকে কয়েকটা কিস্তিতে কর্তৃপক্ষ এই টাকা কেটে নেবেন। এখানে নিয়োগকর্তার স্বার্থ ছিল – লকডাউন উঠে গেলে কাজের লোক পেতে যাতে অসুবিধা না হয়, তার জন্যে অগ্রিম দেওয়া।
মহামারী ও লকডাউনের জন্যে নিয়োগকারীরা এবং সরকার ছিল সুবিধাজনক অবস্থায়, ইউনিয়ন কিছুটা অসুবিধাজনক পরিস্তিতিতে ছিল। এদিকে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার করোনা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার জন্য কোনো সময় দিলেন না। কেন্দ্রের শাসকেরা সমস্ত ক্ষেত্রে যেমন এক তরফা সিদ্ধান্ত নেয় এই ক্ষেত্রেও তাই করা হল।
ইতিমধ্যে নিয়োগকর্তারা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হলেন। ১৮ মে শুনানিতে সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশ দিল লকডাউনের মধ্যে বেতন দিতে না পারলে বেসরকারী সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এই নির্দেশ জুলাই মাস পর্যন্ত থাকবে। এই সুযোগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক লকডাউনে বাধ্যতামূলক মজুরি দেওয়ার যে নির্দেশিকা জারি করেছিল তা প্রত্যাহার করে নিল। এর ফল যা দাঁড়ায় তা হল লকডাউনের বেতন বিশবাঁও জলে চলে গেল। কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া বা ছাঁটাই করা বৈধতা পেল। ১ জুন থেকে আনলক শুরু, লকডাউনের সময়কার মজুরির প্রশ্নটি পিছনে চলে গেল। এখন চলছে আনলক-৪ পর্ব।
২১ আগস্ট ২০২০ ইএসআইসি’র ১২৮তম সভায় কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার প্রস্তাবে ‘অটল বিমিত ব্যক্তি যোজনা’ ইএসআইসি’র একটি প্রকল্প ছিল তার নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। এবং লকডাউনে কাজ হারানো শ্রমিকদের বেকার ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। একজন কাজ হারানো শ্রমিক ৯০ দিনের অর্থাৎ তিন মাসের বেতনের ৫০ শতাংশ পাবেন। খবরে প্রকাশ কোভিড মহামারী লকডাউনের ফলে সংগঠিত ক্ষেত্রে ১ কোটি ৮৯ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্র মিলে মোট ১২ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ইএসআই অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে ৪২ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারি কর্মচ্যুত হয়েছেন। কাজ হারানো বা কর্মচ্যুতি নামে ছাঁটাইকে সহনীয় করা হচ্ছে। চালু হল বেকার ভাতার নামে দু’বছরের জন্য ছাঁটাই ভাতা। কাজ হারানো ইএসআই অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকরা এই সুবিধা পাবেন। কাজ হারানো ব্যক্তি ২৪ মার্চ ২০২০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত তিন মাসের বেতনের ৫০ শতাংশ পাবেন। ১ জানুয়ারী ২০২১ থেকে ১ জুন ২০২১ পর্যন্ত আগের নিয়মের ২৫ শতাংশ ভাতা পাবেন। এই যোজনায় নাম নথিভুক্ত করতে হলে যা আবশ্যক তা হল, কর্মহীন হওয়ার আগে অন্তত দু’বছর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইএসআই তহবিলে আইপি’র চাঁদা জমা থাকতে হবে। কর্মহীন হওয়ার ঠিক আগে টানা ৭৮ দিনের তহবিলে চাঁদা জমা থাকতে হবে। আর, কাজ হারানোর দু’বছর আগে কোনো একটা ত্রৈমাসিকের কোন একটিতে ন্যূনতম ৭৮ দিন তার চাঁদা জমা থাকতে হবে। এই তিনটি শর্ত পূর্ণ হলেই নাম নথিভুক্ত করা যাবে। অন্যথায় হবে না। কর্মী নিজেই ইএসআই ব্রাঞ্চে ক্লেইম করতে পারবেন। তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হবে। এখানে নিয়োগকর্তার কোনো ভূমিকা নেই। ইএসআই-এ শ্রমিক কর্মচারিদের দেওয়া চাঁদা জমা আছে ২২,২৭৯ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার এই তহবিল থেকে ৭০০ কোটি টাকা বেকার ভাতা হিসাবে খরচ করবে।
চারিদিকে ঢাকঢোল পেটানো চলছে, কেন্দ্রীয় সরকার বেকার ভাতা দিচ্ছে। শ্রমিকের দাবি ছিল লকডাউন-মজুরি, হাতে পেল ছাঁটাই ভাতা। কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ এই ৬ মাস কাজ হারিয়েছেন বা ছাঁটাই হয়েছেন। তারা ২ বছরের বেকার ভাতা হাতে নিয়ে সারা জীবন সংসার চালাবেন! ভয়ঙ্কর দিন। সরকার, বিচার ব্যবস্থা, শিল্পপতিদের রামধুন চলছে। মিথ্যা প্রচার আর কথার ফুলঝুরিতে সরকার নিজেদের সমস্ত অক্ষমতা শুধু নয়, অন্যায়গুলোকে ঢাকতে ব্যস্ত। এদিকে মানুষ পথে বসতে চলেছে।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত