পৃথিবীর আলো দেখার আগেই ওদের হত্যা করা হল, লাখে-লাখে। ‘হল’ বললেও তো ঠিক বলা হল না – ওদের হত্যা তো শুধু অতীতের ব্যাপার নয় – বর্তমান এবং ভবিষ্যতেরও ব্যাপার। বলছে সমীক্ষা ও নানা গবেষণা। ওরা কন্যাভ্রূণ। নারীর প্রতি যে বিদ্বেষ আমাদের সমাজ লালন করে, সেই বিদ্বেষ ধেয়ে যায় এমনকি মাতৃগর্ভে। সেখানে তাদের নিকেশ করে পিতৃতন্ত্র তার পরাক্রম জাহির করে – কন্যার জন্মানোকে অনধিকারে পরিণত করে পুরুষতন্ত্র তার আধিপত্যের পতাকা ওড়ায়। কন্যাভ্রূণ হত্যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটা ধারা হলেও সম্প্রতি তা নিয়ে উদ্বেগ আবার চর্চায় এসেছে।
কন্যাভ্রূণ হত্যার দিক থেকে ভারত যে এক অগ্ৰগণ্য দেশ তা সুবিদিত। গবেষকরা বিভিন্ন সমীক্ষা চালিয়ে, তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এক দশক কালে ভারতে প্রতিদিন গড়ে ১,২০০ কন্যাভ্রূণের হত্যা ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটতে থাকবে। তাঁদের হাজির করা পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০১৭ থেকে ২০২৫-এর মধ্যে লিঙ্গ নির্ধারণ করে কন্যাভ্রূণের হত্যা বছরে গড়ে ৪,৬৯,০০০ করে হবে। আর ২০২৬ থেকে ২০৩০ সালে ওই হত্যার বার্ষিক গড় গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৫,১৯,০০০। সরল অঙ্কের হিসেবে, ২০১৭ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ভারতে ৬৮ লক্ষ সম্ভাব্য নাগরিক জন্মের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে শুধু লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য। এই আশঙ্কার কথা, কন্যার জন্ম বিপন্ন হয়ে পড়ার এই বৃত্তান্ত সম্পর্কে সমাজপিতারা, শাসকরা অবহিত নয় এমনটা হতে পারে না। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ চর্চা তাঁদের কাছে অবশ্যই পৌঁছায়। কিন্তু এই পরিঘটনা তাঁদের কি আদৌ বিচলিত করে? কন্যাভ্রূণ হত্যাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করার আইন থাকলেও তাকে যে এমন অবলীলায় নখ-দন্তহীন করে তোলা হচ্ছে, তা নিয়ে কি তাঁরা বিন্দুমাত্র ভাবিত হন?
গত বছর জুলাই মাসে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটা সংবাদকে অনেকেই হয়ত লক্ষ্য করেছিলেন। তবুও আলোচনার সুবিধার জন্য সেটিকে এখানে স্মরণ করা যাক। উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশি জেলার ১৩২টা গ্ৰামে তিন মাসে জন্মানো ২১৬টা শিশুর সবকটিই ছিল পুত্রসন্তান, সেই তিন মাসে একটা কন্যাও ওই গ্ৰামগুলোতে দিনের আলো দেখেনি। পুত্র লাভের আশীর্বাদ এমন অকৃপণভাবে ওই গ্ৰামগুলোতে ঝড়ে পড়েছিল কিভাবে? কোন জাদুদণ্ডের পরশে তা সম্ভব হয়েছিল?
নারী অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট বিভিন্ন সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই গোপনে বা অঘোষিত গর্ভপাতে সক্রিয় ক্লিনিকগুলোর দিকে আঙ্গুল তুলে আসছে। চণ্ডিগড়ের পোস্টগ্ৰ্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল এডুকেশন এণ্ড রিসার্চ-এর ডাক্তাররা ২০১৭ সালে প্রামাণ্য নথির সাহায্যে ভ্রাম্যমান ক্লিনিকগুলোর কার্যকলাপের কথা বিশদে বর্ণনা করেছিলেন। এরা অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের ঘরে-ঘরে গিয়ে আল্ট্রাসাউণ্ড প্রযুক্তির সাহায্যে স্ক্যান করে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করে এবং কন্যাভ্রূণের ক্ষেত্রে এমনকি গর্ভবতীর ঘরেই গর্ভপাত ঘটিয়ে থাকে। ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ নিষিদ্ধকরণ আইনের বিধি বলছে, যে সমস্ত ক্লিনিক আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির ব্যবহার করবে তাদের যথাযথ খাতাপত্র রাখতে হবে, ডাক্তারদেরও গর্ভবতী নারীদের ওপর করা প্রতিটি স্ক্যানকে খাতায় নথিবদ্ধ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে আইন বইয়ের মধ্যেই আটকে থাকে, আর দালাল-ডাক্তার-ক্লিনিকের মালিক-পুলিশ গাঁটছড়া কন্যাভ্রূণ হত্যাকে ফায়দার রমরমা কালো কারবারে পরিণত করে। এই ধরনের ক্লিনিকগুলো এবং অর্থের প্রলোভনের কাছে নীতি-নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দেওয়া ডাক্তারদের ‘অপারেশনই’ যে উত্তরাখণ্ডের ১৩২টা গ্ৰামের ওই অত্যাশ্চর্য ঘটনাকে সম্ভব করে তুলেছিল, তার উল্লেখ বোধকরি না করলেও চলবে।
আমাদের সমাজে মেয়েদের জন্ম এত অবাঞ্ছিত কেন? সমাজ বিশ্লেষকরা এর পিছনে বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছেন। দারিদ্র, পণপ্রথা, পুরুষের দৈহিক শ্রম বড় সম্পদ রূপে গণ্য হওয়া, বংশরক্ষায় পুরুষ উত্তরাধিকারীর চাহিদা, বৃদ্ধ বয়সে অসহায় বাবা-মার পরিচর্যায় পুত্রের প্রয়োজনীয়তা – এ সবই মেয়ের চেয়ে ছেলের জন্য ব্যাকুলতাকে তীব্র করে তোলে বলে মনে করা হয়ে থাকে। এমনকি মৃত্যুকালে ছেলে মুখে আগুন না দিলে মোক্ষ লাভ হবেনা – এই ধর্মীয় বিশ্বাসও ছেলের জন্য কামনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ রূপে দেখা দেয়। কিন্তু মেয়েকে ‘বড় বোঝা’ জ্ঞান করে মাতৃগর্ভেই তার থেকে নিষ্কৃতি লাভের যে তৎপরতা, সব ছাপিয়ে তার পিছনে নির্ধারক হয়ে দেখা দেয় সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা। এর রেশ সমাজের সংস্কৃতিতে প্রবল হওয়ার সাথে-সাথে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরাও তার ঐকান্তিক বাহক হয়ে দেখা দেন। আর সে কারণেই সম্ভবত কন্যাভ্রূণ হত্যার ব্যাপকতা সম্পর্কে অবহিত হয়েও তাকে প্রতিহত করতে শাসকদের তেমন উদ্যোগী হতে দেখা যায় না।
দু-বছর আগে নীতি-আয়োগ তাদের এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, ভারতের ২১টা রাজ্যের মধ্যে ১৭টাতেই শিশুপুত্রের তুলনায় শিশুকন্যার জন্মের হার যথেষ্ট কম বলে দেখা গেছে। ২০১১র জনগণনাও শিশুপুত্র ও শিশুকন্যার জন্মের হারে ফারাককে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান করেছিল। জনগণনায় প্রকাশিত কয়েকটা রাজ্যে ১০০ শিশুকন্যা জন্ম পিছু শিশুপুত্রের জন্মের হার ছিল এইরকম – হরিয়ানা ১১৯.৭, পাঞ্জাব ১১৭.৬, উত্তরাখণ্ড ১১৪.২, দিল্লী ১১৪.২। শুরুতে উল্লিখিত গবেষণাও জানিয়েছে, উত্তরপ্রদেশেই ২০১৭ থেকে ২০৩০-এর মধ্যে কন্যাভ্রূণ হত্যার সংখ্যা হবে সবচয়ে বেশি, প্রায় ২০ লক্ষ। আমরা অতএব দেখতে পাচ্ছি যে, জাতীয় রাজধানী সংলগ্ন রাজ্যগুলো, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, বেশ কিছুকাল ধরে যে সব অঞ্চলে গেরুয়া রাজনীতি জোরালো প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে, সেই সমস্ত অঞ্চলেই সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারা প্রসূত নারী বিদ্বেষ সবচেয়ে প্রকট। “বেটি বচাও, বেটি পড়াও” শ্লোগান এই বলয়ে প্রতিদিনই প্রহসন হয়ে ফেটে পড়ছে। বেটিকে পড়াতে গেলে আগে তো বেটিকে বাঁচাতে হবে। অথচ এই বলয়েই কন্যাভ্রূণ সবচেয়ে অসুরক্ষিত, জন্মের আগেই তাদের ওপর চালানো হচ্ছে হিংসা। কন্যাভ্রূণ রক্ষায় সরকার কতটা আগ্ৰহী, সরকারের একটা নির্দেশিকা তার কিছুটা আন্দাজ দেয়।
গত এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছিল, জন্মের আগে লিঙ্গ নির্ধারণে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত বিধি ৩০ জুন পর্যন্ত মুলতবি রাখা হচ্ছে। কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, করোনার ‘জরুরি পরিস্থিতি’র জন্য সরকারের পক্ষে নজরদারি চালানো সম্ভব হবে না। নারী সংগঠনগুলো তখন প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারকে ওই বিজ্ঞপ্তি তুলে নিতে বলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, ওই বিজ্ঞপ্তির সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে কন্যাভ্রূণর গর্ভপাতে লিপ্ত ক্লিনিকগুলো যথেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। কেউ বলতেই পারেন, বিজ্ঞপ্তি তো মাত্র তিন মাসের জন্য বলবৎ ছিল, তাতে পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তানের অনুপাতে কি এমন আর হেরফের হবে। পরিসংখ্যানের চেয়ে মনোভাবের প্রশ্নটাই এখানে বড়। সরল যুক্তি বলে, আইনকে এভাবে লঘু করে তোলার কোনো যুক্তি কি আদৌ ছিল? সাধারণ সময়ে সরকারের নজরদারির যে পরিচয় পাওয়া যায়, বিধি বলবৎ থাকলে করোনা কালে নজরদারির তেমন ফারাক কি চোখে পড়ত? অতএব, কন্যাভ্রূণ রক্ষায় নারী-বিদ্বেষী মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা চালাতে গিয়ে যেমন ১৯৯৪ সালের ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ নিষেধাজ্ঞা আইনের প্রয়োগের ওপর জোর দিতে হবে, একই সাথে গুরুত্ব দিতে হবে সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারা বিরোধী লড়াইয়ের ওপর, বিজেপির প্রবল প্রভাবের অঞ্চলে যার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।
– জয়দীপ মিত্র