আজকের সময়কালে প্রায় ছয় দশক আগেকার সেই ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা বা খাদ্য সংকটের বিভিন্ন দিকগুলি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ চলছে। কিন্তু এই সেদিন হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটা পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃতদেহগুলি যেখানে পড়ে ছিলো সেই রেললাইনের পাশেই দেখা গিয়েছিল কয়েকটি পোড়া রুটি! ভাইরাল হয়ে যাওয়া এই ছবিটাই যেন আজ হয়ে উঠেছে দেশের প্রান্তিক মানুষের খাদ্য সংকটের প্রতীক! কেবল এ রাজ্যের গ্রামাঞ্চলের জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের একভাগ পরিযায়ী। এটা ২০১১ সালের জনগণনা তথ্য। আজ সেটা নিশ্চিত আরও বেড়েছে। দেখা গেছে ছয়ের দশকে খাদ্য আন্দোলনের সময়কালে গ্রাম থেকে ভুখা মানুষ শহরে আসতো ভাতের ফ্যান চাইতে। আর আজ আসছে দলে দলে কাজের খোঁজে! এভাবেই সংকটের রূপ বদলে গেছে, কিন্তু চরিত্র অপরিবর্তিত। লকডাউনে কর্মহীন এই মেহনতিদের প্রতি দেখা গেলো সরকারের কী নিদারুন বঞ্চনা, অবহেলা! খাদ্যর অধিকারের বড় বড় ভাষণ শোনা যায়! কিন্তু সেটা এদের দেওয়া হয়েছে স্রেফ কাগজে কলমে! অনেক টালবাহানা, দেশ জুড়ে আলোড়নের পর পরিযায়ীদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ফুড কূপন। তাও সেটা লকডাউন চালু হওয়ার দু’মাস পর। একটি সমীক্ষা বলছে যে, ঘরে ফেরা ২০ শতাংশ পরিযায়ীরাও এর সুবিধা পায়নি।
অথচ খাদ্য সংকটকে সামাল দিতে কেন্দ্রীয় খাদ্যসুরক্ষা যোজনা বা রাজ্যের খাদ্যসাথী প্রকল্প নিয়ে প্রচারের ঢাকঢোল বাজানো হচ্ছে। বাস্তবে গরিবরা রেশনে খাদ্যদ্রব্য পাচ্ছে কতটুকু? অধিকাংশরাই পায় দৈনিক ১৬৬ গ্রাম বা মাসে ৫ কেজি চাল! যার মূল্য এক দিনের মজুরির থেকেও কম! কিন্তু লকডাউনে কাজ নেই, অর্থ নেই – সেই চাল ফুটিয়ে গরীবের একবেলা গরম ভাতের গল্পে একটু ডাল বা সব্জীও যে জুটছে না। তা নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যাথা নেই। বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ একেই বলছেন ‘হিডেন হাঙ্গার’ বা লুকিয়ে থাকা অনাহার বা অর্ধাহার! কেউ বা বলছেন ‘ক্ষুধার প্রজাতন্ত্র!’ এর ফলশ্রুতিতে দেহ-ভর সূচকের হিসাবে দেশের ৪৬ শতাংশ মানুষ আজও অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে শিশুদের ৫৩ শতাংশ অপুষ্টিজনিত রোগাক্রান্ত, আর গুরুতর অপুষ্টিতে রয়েছে ২১ শতাংশ। মানবদেহে প্রয়োজনীয় ন্যুনতম ২৪০০ ক্যালোরির থেকে কম পায় দেশের জনসংখ্যার ১০ ভাগের ৭ ভাগ! এই প্রেক্ষাপটে কখন কোথায় যে অনাহার মৃত্যুর মিছিল হবে বা রেশন নিয়ে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না।
দেখা যাচ্ছে সরকারী সংস্কারগুলি সংকট মোচন করতে পারেনি। সৃস্টি করেছে নতুন নতুন সংকটের।
এখন পরিযায়ীদের দিকে তাকিয়ে “এক দেশ এক রেশন কার্ড” এর প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু করোনা সংকটের অনেক আগেই এবছর কেন্দ্রীয় বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি খাতে ৭৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য ভণ্ড কেন্দ্রীয় সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারী গণবন্টন ব্যবস্থাকে ধাপে ধাপে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সম্প্রতি লকডাউনের মধ্যেই নতুন অর্ডিন্যান্স জারি করে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য মজুত রাখার সীমা। এ জন্য সংশোধন করা হয়েছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন। অর্থাৎ এখন থেকে মজুতদারী কালোবাজারিকে বৈধ করে দেওয়া হবে। খাদ্যদ্রব্যর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে কর্পোরেট পুঁজিপতিরা। পাশাপাশি কৃষিপণ্য ব্যবসা সংক্রান্ত আরও দুটি অর্ডিন্যান্সের মধ্য দিয়ে সরকার কৃষিপণ্য ক্রয় বা সরকারী সংগ্রহর দায় থেকে সরে এসেছে। স্বভাবতই গণবন্টন থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে শস্য বা খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহর দায়িত্ব তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট বা বাণিজ্যিক পুঁজির হাতে। এ রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কৃষি পণ্য বিপনন থেকে সম্পূর্ণ হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এ সংক্রান্ত রাজ্যের আইন সংশোধন করে কেন্দ্রীয় নীতির সুরে সুর মিলিয়েছে।
তাই আজ গ্রামে শহরে যে ভয়াবহ খাদ্য সংকট সৃস্টি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের দাবি হয়ে উঠেছে, লকডাউনে কর্মহীন গরিব মানুষদের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা হচ্ছে না কেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার জবাব দাও। করোনা সময়কালে সরকারকে প্রত্যেক ব্যক্তিকে পূর্ণ রেশন দিতে হবে, প্রতি মাসে ইউনিট পিছু ১৫ কেজি চাল/আটা, ১ কেজি তেল, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি চিনি দিতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে আগামী ৬ মাস মাসিক ৭৫০০ টাকা নগদ অর্থ দাও। রাজ্যের রেশন গ্রাহকদের একাংশের (আরকেএসওয়াই-২) বরাদ্দ অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হলো কেন রাজ্য সরকার জবাব দাও। মূল্যবৃদ্ধি রোধে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চরম ব্যর্থতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। ২০০ দিন কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি দাও। এর পাশাপাশি করোনা সংকট সরকারী চিকিৎসার যে চরম অব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছে তাতে দাবি উঠেছে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বাড়াও। জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৩ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করতে হবে।
গত ৩১ আগস্ট ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন ও ১৯৯০ সালের মূল্যবৃদ্ধি-বিরোধী ও বাসভাড়াবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের শহীদ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। গণআন্দোলনে লাঠি-গুলি-কালাকানুন জারি করার সেই ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং মাঠে ময়দানে সে লড়াই ছড়িয়ে দেওয়া আজ সময়ের দাবি। ছয়ের দশকে গ্রামেগঞ্জে লেগে পড়ে থেকে জনসমর্থন বাড়িয়ে বামপন্থীরা খাদ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আজও সেই স্পিরিটকে উর্ধ্বে তুলে ধরা প্রয়োজন।
- জয়তু দেশমুখ