সম্প্রতি জোম্যাটো তার মহিলা কর্মচারিদের জন্য ঋতুকালীন সময়ে সবেতন ছুটি ঘোষণা করেছে এবং তা নিয়ে নেট দুনিয়া ও বিভিন্ন মহলে তুমুল শোরগোল শুরু হয়েছে। অতঃপর যেকোনো বিতর্কের নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুযায়ী যুক্তি ও বিরুদ্ধতার কাড়া-নাকাড়া ক্রমাগত বেজে চলেছে। এই বৌদ্ধিক বিরোধিতার দু’পক্ষই নানারকম আশঙ্কা ও সম্ভাবনার বিষয়ে চিন্তা ব্যক্ত করছেন ও একই সাথে বিষয়টির স্থায়িত্ব ও ফলাফলের বিষয়ে নির্দিষ্ট বোঝাপড়ায় আসতে চাইছেন।
বলা হচ্ছে, লড়াইয়ের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বহুপথ অতিক্রম করে এসে বর্তমানে যতটুকু সমানাধিকার মহিলারা আদায় করে নিতে পেরেছেন তা এই ‘অতিরিক্ত সুবিধা’ পাওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হবে না তো, মহিলাদের সেই লড়াই আবার নতুন করে লড়তে হবে না তো? অথবা, বায়োলজিক্যাল সমস্যার জন্য তো মেডিক্যাল লিভ আছেই, তেমন হলে মেডিক্যাল লিভের এক্সটেনশন হোক; সমস্ত মহিলার জন্যই যে ঋতুকালীন ছুটি আবশ্যিক, এটা ভেবে নেওয়া হচ্ছে কেন, অতিপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তো মেডিক্যাল লিভের এক্সটেনশনই যথেষ্ট। আর তা যদি এক্সটেনডেড হয়ই, তাহলে তা পুরুষদের জন্যও কেন নয়! কারণ পুরুষদেরও অনেক সময়ে স্বাস্থ্যের কারণে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যা হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অজানা। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সম্পাদক ও নারী আন্দোলনের মুখ কবিতা কৃষ্ণান বলেছেন, বিশ্বজুড়ে এমনিতেই মহিলারা অসম ব্যবস্থা ও বৈষম্যমূলক পদ্ধতির মধ্যেই কাজকর্ম করে থাকেন এবং ঋতুচক্র সেক্ষেত্রে বাড়তি এক বোঝা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই সময়ের শারীরিক কষ্টানুভূতি ও মানসিক চাপ প্রকাশ করলেই কি পুরুষতান্ত্রিক ভাবনাচিন্তা অনুযায়ী এটাই ধরে নেওয়া হবে যে মহিলারা পুরুষদের মতো অতটা কাজের নয়?
সামাজিক সত্তা তো বটেই, প্রকৃতিগতভাবেই নারী ও পুরুষের শারীরিক গঠন আলাদা হয়। তবে কেন কর্মক্ষেত্রেও সেটা সার্বজনীনভাবে গৃহীত হবে না! নাকি আমরা সেই সনাতনী ক্যাপিটালিস্ট ভাবধারা ‘এক ছাঁচে সবকিছু ফেলে’ প্রগতির পথের দূরত্ব মাপব? তাহলে ‘শারিরীক ক্ষমতা ও নিজস্বতার বিভিন্নতা’ হিসেবে এনে কর্মচারিদের উৎপাদনশীলতা সর্বোত্তম করতে কর্মক্ষেত্রেও বিবিধ পরিসর থাকার কথা যে বলা হয় তার কী হবে?
সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে চলমান নারী আন্দোলনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতেই আট ঘণ্টা শ্রম দিবস, সপ্তাহান্তে ছুটি, বাথরুম বিরতি, খাবার বিরতি ইত্যাদি আদায় করা গেছে, এমনকি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোনোর অধিকারের জন্যও কম লড়াই হয়নি। আর এই সমস্ত জয়কেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা ‘কাজের সময় নষ্ট’ বা, বলা ভালো ‘টাইম স্টোলেন ফ্রম লেবার টাইম’ অভিধায় অভিহিত করে থাকে। প্রথমবার লাগু হওয়া ঋতুকালীন ছুটিকেও ‘অপ্রয়োজনীয় ও শ্রমসময় চুরি’ বলেই প্রচার করা হবে। কিন্তু আখেরে উপকৃত হবেন মহিলা কর্মচারিরাই। সমস্ত শারীরিক ও সামাজিক ভেদাভেদের কথা মাথায় রেখে কর্মক্ষেত্রের কর্মসম্পাদনের ব্যবস্থা তো এমনই হওয়া উচিত যাতে সমস্ত ধরনের কর্মচারিরা আরও সুবিধাজনক পরিসরে নিজেদের উৎপাদনশীলতাকে সর্বোত্তম করে কর্মক্ষেত্রকেই আরও প্রসারিত করতে পারে।
আমাদের একথা বুঝতে হবে যে, মেডিক্যাল লিভ বাড়ানো কমানোর সাথে ঋতুকালীন ছুটির কোনও সম্পর্ক নেই। ঋতুকালীন ছুটি স্বতন্ত্র ও নির্দিষ্ট স্বাধীনতার দাবি। প্রয়োজনে সকলের জন্যই মেডিক্যাল লিভ বাড়ালে তা তো ভালোই, তাতে কর্মচারিদের জন্য ভালোই হবে। কিন্তু ঋতুস্রাব বা তজ্জনিত অসুস্থতা, দুর্বলতা বা অস্বস্তি তো মেডিক্যাল ইস্যু নয়, বরং ঋতুস্রাব স্বাভাবিক ও ধারাবাহিক বিষয় এবং এটা কোনও রোগ নয়। ঋতুস্রাবের সাথে মহিলাদের স্বাভাবিক উৎপাদনশীলতার ওতপ্রোত সম্পর্ক, আর সেই উৎপাদনশীলতার সম্মান ও স্বীকৃতিই হলো ঋতুকালীন ছুটি।
এই পথে ব্যক্তি-বিভিন্নতার নিরীখে কর্মক্ষেত্রের পরিসরের দাবি তোলার সাথে সাথেই সার্বিক ভাবে সারা দেশে ঋতুকালীন সময় নিয়ে যে অসচেতনতা, কুসংস্কার ও ছুৎমার্গ বজায় আছে তার বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে। জেনে রাখা ভালো শুধুমাত্র পৃথক শৌচাগার না থাকা ও শৌচাগারে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার ও বদলানোর ব্যবস্থা না থাকার দরুন ঋতুমতী হওয়ার পরপরই প্রচুর ছাত্রী স্কুলছুট হয়। সারা দেশের স্কুলছুট ছাত্রীর সংখ্যার নিরিখে তা প্রায় কুড়ি শতাংশ। ফলত শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরে পৃথক ঋতুকালীন সময়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একই সাথে ঋতুকাল নিয়ে যেকোনো ধর্মীয় ছুৎমার্গের প্রচার কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
আর, ঋতুকালীন সময়ে যার কোনও অস্বস্তি হয় না, কোনও অসুবিধা থাকে না, তিনিও ঋতুকালীন ছুটি নেবেন? এটি তার ওয়ার্ক এথিক্সের বিরোধী হয়ে পড়বে না? এই প্রশ্নের উত্তরেও কবিতা বলছেন, বিশেষভাবে সক্ষম মতদাতাদের জন্য নির্বাচন কমিশন ভোটদান কেন্দ্রে আলাদা ব্যবস্থা রাখে, হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের কথা ভেবেই ধাপহীন ঢালু সিঁড়ি তৈরি করা হয়। কিন্তু সমস্ত বিশেষভাবে সক্ষম মানুষই যে হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন এমনতো নয়, আবার যারা হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন না বা ওই নির্দিষ্ট ঢালুপথ ব্যবহার করতে সাধারণ মানুষের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞাও থাকে না। তাছাড়া জোম্যাটো একটি সদ্যোজাত কোম্পানি, ১৯৯০ থেকে বিহারে এটি চালু আছে। কর্মচারিরা বিহার সরকারের কাছে ঋতুকালীন ছুটির দাবি জানিয়েছিলেন, সরকার তা মেনেছেন এবং কর্মচারীরা ঋতুকালীন ছুটির সুবিধাভোগ করছেন। কাজেই কর্মক্ষেত্রে যদি ক্রমাগত ঋতুকালীন ছুটির দাবি না জানানো যায় তা কখনই বাস্তবায়িত হবে না, এমনকি বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যখন কর্মক্ষেত্রে হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ জানালে তা মহিলাদের ভণিতা বলেই ধরে নেওয়া হয়, তেমনই ঋতুকালীন ছুটির আবেদনকেও একই ভাবে হয়তো ট্রিট করা হবে।
যেখানে কর্মচাররিদের কোনও লড়াকু সংগঠন নেই সেখানে এমনকি মাতৃত্বকালীন ছুটিকেই মান্যতা দেওয়া হয়না এবং তা নিয়ে আরও আনুসাঙ্গিক বিষয়ের সাথে জুড়ে মহিলাদের ‘কামচোর’, ‘সুবিধাবাদী’ ইত্যাদি নানা অভিধায় ভূষিত করা হয়, সেখানে জোরদার লড়াই ছাড়া ঋতুকালীন ছুটি আদায় করা এককথায় অসম্ভব।
তাই শ্রম-আইনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে ঋতুকালীন ছুটির মান্যতা দেওয়ার দাবিতে লড়াই যেমন চলবে, তেমনই ঋতুস্রাব নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার, ছুৎমার্গ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও জোরদার লড়াই চালাতে হবে।
- সংগ্রাম মণ্ডল ও সৌমি জানা