প্রতিবেদন
ওয়েস্টার্ন ঘাট
sed

একটা খুব সোজা প্রশ্ন করি শুরুতেই, আপনি যে বাড়িটাতে থাকেন সেখানে এসে গভর্নমেন্ট যদি আপনাকে বলতে শুরু করে যে এই বাড়িটি আপনার না, আপনি বেআইনিভাবে এখানে রয়েছেন – অথচ গত পঁচাত্তর বছর ধরে আপনার পরিবার এখানেই থাকে। কেরালার ওয়েস্টার্ন ঘাট জুড়ে দলিত আদিবাসীদের নিজেদের জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে দেয় গভর্নমেন্ট। এই নিয়েই ২০১৩ সালে জয়ান বলে একজন চিত্রপরিচালক মালায়লাম ভাষায় একটি সিনেমা তৈরি করে, ‘প্যাপিলিও বুদ্ধা’।

পুঁজিপতি, বুর্জোয়াদের দেশের গরিব জনগণকে শোষণ করার ইতিহাস প্রতিবার আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে ফেলে। প্যা পিলিও বুদ্ধা আসলে একটি বিলুপ্তপ্রায় ও মূল্যবান প্রজাপতি বিদেশের বাজারে এর দাম খুব চড়া। সিনেমাটির প্রথম দিকে দেখা যায় অন্যতম চরিত্র জ্যাবক, একজন বিদেশি লোক, শংকরকে সামান্য কিছু হাত খরচা দিয়ে এই প্রেসাশ প্রজাপতিটি তাকে দিয়ে বিদেশের বাজারে বিক্রি করার জন্য বেশ কিছু সময় ধরে ওয়েস্টার্ন ঘাটে রয়েছে। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। দেশি ও বিদেশি উভয়কার বুর্জোয়া শ্রেণি দেশের গরিব শ্রেণীকে দিনের পর দিন শোষণ করে আসছে নিজেদের স্বার্থে। উড়িষ্যার নিয়ামগিরিতে ‘ভেদান্ত গ্রুপ’ নিজেদের লাভের জন্য সেখানকার দলিত আদিবাসীদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকারের সাহায্য নিয়ে, ঠিক যেমন এই সিনেমাটিতে তুলে ধরা হয়েছে।

সিনেমাটির শেষের দিকে একটি দৃশ্যে বলা হচ্ছে যে এই দলিত আদিবাসীরা যদি সরকারের জায়গা দখল করে থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষেরা থাকবে কোথায়? সমাজের শ্রেণী বৈষম্য কি ভীষণ পরিমাণে মানুষের মাথায় ঢুকে বসে থাকলে এরকম কথা বলা যায়! আর এই কথাটা একদম মিথ্যে নয়, বর্তমান ভারতবর্ষে দলিত আদিবাসীদের মানুষ বলেই গণ্য করা হয় না, তারা অপমান-ঘৃণা আর রাষ্ট্রের অত্যাচার ছাড়া আর কিছুই পায় না। ঠিক যেমন মোদি-শাহের ফ্যাসিবাদী সরকার দিল্লির ঝুপড়িতে থাকা ৪৮ হাজার গরিব মানুষকে মানুষ বলেই মনে করে না, হঠাৎ করে একদিন তাদেরকে উচ্ছেদের অর্ডার দিয়ে দেয়। ঠিক যেমন করে কোন আদিবাসী মহিলার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হয়ে গেলে রাষ্ট্র তা ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না, তার প্রচন্ড অবাক লাগে!

শ্রেণী বৈষম্য ও জাতিভেদ প্রথা ভারতবর্ষে কী ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে, তা এই সিনেমাটি দেখেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। একদল সমাজকর্মী তথা ফিল্মমেকার এই ওয়েস্টার্ন ঘাটে এসে নিপীড়িত এই দলিতদের ওপর সিনেমা বানাচ্ছে, তাদের নিয়ে দুটো কথা বলছে, আর ওদিকে রাতের বেলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে গিয়ে বলে ফেলছে যে দলিতদের আন্দোলন নিয়ে সমস্যা আছে, কারণ দলিত আদিবাসীরা শুধুই ভান করছে। এটুকুই প্রমাণ করে দেয় দলিত আদিবাসীদের উপর দেশ জুড়ে চলে আসা অত্যাচারের কথা।

অ্যান্টি এনআরসি আন্দোলনে আলিগড়, জেএনইউ, জামিয়ার ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশ গুলি চালাতেও পিছপা হয়নি। সিনেমাটিতে শঙ্করকে থানার মধ্যে বেদম শারীরিক অত্যাচার করা হয়, জেএনইউ থেকে সে পড়াশোনা করেছে সেটাই তার সবচেয়ে বড় ‘অপরাধ’। সিনেমা এবং বর্তমান সময়ে এই জায়গায় হুবহু মিলে যাচ্ছে – দুদিন আগেই জেএনইউ’এর প্রাক্তন ছাত্র উমর খালিদকে অ্যাদরেস্ট করা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে ১১ লক্ষ পাতার চার্জশিট তৈরি করা হয়েছে, আর অন্যদিকে দলিত আদিবাসীদের উপর চলে আসা অত্যাচার, লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে রাষ্ট্র একটা বাক্যও খরচা করতে রাজি নয়। সিনেমাটির একটি দৃশ্যে যখন শঙ্করকে থানায় মারা হচ্ছিল, বারবার বলা হচ্ছিল ‘নকশাল’ শব্দটি, বারবার বলা হচ্ছিল ‘দলিত টেররিস্ট’ কথাটি। যাদেরকে এই রাষ্ট্র মানুষ বলেই গণ্য করে না তাদেরকে টেররিস্ট বলছে, আর অন্যদিকে আরএসএস যা প্রকৃত জঙ্গির আস্তানা, তাদেরকে দেশের সর্বোচ্চ ভক্ত বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। আর করবে নাইবা কেন – দলিতদের উপর অত্যাচার করা থেকে শুরু করে কাশ্মীরে কালাকানুন চালু, উমর-সাফুরা-ভারভারা রাওদের বন্দী বানানো – সবকিছুই নাগপুর ও দিল্লির মধ্যে পরামর্শ করে নেওয়া সিদ্ধান্ত।

সিনেমাটির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, মঞ্জুশ্রী, একজন আদিবাসী মহিলা, তিনিও আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বপ্ন দেখেন। মঞ্জুশ্রী একদিকে অটো চালান টাকা উপার্জনের জন্য, অন্যদিকে মেপ্পারা অঞ্চলের আদিবাসী বাচ্চাদের জন্য একটি স্কুল চালান। মঞ্জুশ্রী তাঁর জন্ম থেকে দেখে দেখে আসছেন তাদের ওপর চলতে থাকা এই অত্যাচার, তিনি আবার এই দলিত আন্দোলনে বেশ সক্রিয়। তবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন মহিলা অটোচালক অটো চালিয়ে স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালে বাদবাকি অটোচালকেরা অর্থাৎ লিঙ্গবৈষম্যক পূর্ব এই সমাজ ঠিক হজম করে উঠতে পারে না, তাদের অস্বস্তি হয় মাথায়, শরীরে, চোখে। মঞ্জুশ্রী তাদের কুমন্তব্য আর ব্যবহারের পাল্টা জবাব দিলে তারা কেউই আর মানুষ থাকতে পারেনা। পরিকল্পিতভাবে তাঁকে একাধিক পুরুষ মিলে ধর্ষণ করে, তাঁর দেহের উপর প্রস্রাব করে, তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। আমরা আসিফাকে ভুলিনি, আসিফার ধর্ষণকারীদের মুক্তির দাবিতে বিজেপির মন্ত্রীরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে মিছিল করেছে – আমরা তাও ভুলিনি। আমরা উত্তর প্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সেই বক্তব্যও ভুলিনি, যেখানে তিনি বলেছিলেন মুসলিম মহিলাদের কবর থেকে বের করে ধর্ষণ করা হবে! এই রাষ্ট্র ধর্ষক, এই রাষ্ট্র মহিলাদের সমানাধিকারের বিরুদ্ধে, এই রাষ্ট্র শুধু ভেদাভেদ চায়।

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব না, এই দাবিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপিকা মেরুনা মূর্মু ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ালে আরেক ছাত্রী তাঁর জাত নিয়ে, রিজার্ভেশন নিয়ে কুমন্তব্য করে এবং সেই মন্তব্যকে ধরেই বাংলায় বিজেপির লোকজন অ্যান্টি-রিজারভেশন প্রোপাগান্ডা চালায়। ছাত্র-ছাত্রীদের মনের মধ্যে দাঙ্গাবাজ বিজেপি দলিতআদিবাসী বিরোধী, মানববিরোধী ভাবনা-চিন্তা ঢোকানো ছাড়া আর কিছুই করছে না, বিজেপি চায়না সকলে পড়াশোনার সমান অধিকার পাক, না হলে কি আর নয়া শিক্ষা নীতি চালু করে!

তবে সে বিজেপি হিটলার মুসোলিনি যেই হোক না কেন, কেউ কোনোদিনও নিপীড়িত মানুষের আন্দোলন থামাতে পারেনি, আজও পারবে না। সিনেমাটির শেষ দৃশ্যে যুবক-যুবতীরা একজোট হয়ে আন্দোলন করে, রাষ্ট্রের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকে তাদের মাতৃভাষায়। পুলিশ তাদেরকে অসম্ভব মারে, গ্রেফতার করে – ঠিক যেমনটা ওমর খালিদের সাথে করেছে। কিন্তু তাই বলে কি আন্দোলন থেমেছে? না থামেনি, বরং আরও শক্তিশালী হয়েছে দলিত আদিবাসীদের আন্দোলন, ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন, মহিলাদের আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষকদের আন্দোলন, আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আন্দোলন।

যত হামলা করো সব সামলে নেব, চ্যালেঞ্জ তোমায় যদি মারতে পারো – আমরা জিতবোই! আম্বেদকর ভগৎ সিংয়ের ছাত্রছাত্রীরা হারতে পারে না!

- আকাশ ভট্টাচার্য  

খণ্ড-27
সংখ্যা-34