বিবৃতি
দিল্লী দাঙ্গার তদন্ত যে ভাবে চালানো হচ্ছে তার বিরোধিতায় ১০০০ নাগরিকের বিবৃতি
st


(দিল্লী দাঙ্গার ঘটনাগুলোতে দিল্লী পুলিশ যেভাবে তদন্ত চালাচ্ছে তার তীব্র বিরোধিতা করে ১০০০ জনেরও বেশি নাগরিক এক জরুরি বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁরা আবেদন জানিয়েছেন, তদন্ত এমনভাবে চালানো হোক যাতে জনগণের আস্থা অর্জন করা যায়। জোরজবরদস্তি ‘স্বীকারোক্তি’ আদায় এবং সাজানো সাক্ষ্যপ্রমাণের অকাট্য নিদর্শন তুলে ধরে তাঁরা দিল্লী পুলিশ কমিশনারেটকে আশ্বস্ত করতে বলেছেন – এই রীতিগুলোকে বন্ধ করতে হবে এবং পরিচ্ছন্ন ও নিরপেক্ষ তদন্ত চালিয়ে দাঙ্গার প্রকৃত সংঘটকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। বিবৃতিতে সাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন চিত্র পরিচালক অপর্ণা সেন, প্রাক্তন সংস্কৃতি সচিব জহর সরকার, ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ, প্রাক্তন রাজ্যপাল মার্গারেট আলভা, শিক্ষাবিদ জয়া হাসান, পার্থ চ্যাটার্জী, জয়তি ঘোষ, রাজনীতিবিদ বৃন্দা কারাত, কবিতা কৃষ্ণাণ ও অন্যান্যরা। পুরো বিবৃতিটির ভাষান্তর এখানে রাখা হচ্ছে।)

প্রতি দিল্লী পুলিশ

আমরা নাগরিকরা দিল্লী দাঙ্গার তদন্ত যেভাবে চালানো হচ্ছে তার বিরোধিতা করছি –
আপনাদের তদন্তে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনুন
সাক্ষ্যপ্রমাণ সাজাতে জোরজবরদস্তি “স্বীকারোক্তি” আদায় বন্ধ করুন
উমর খলিদ সহ নাগরিকদের মিথ্যাভাবে ফাঁসানো বন্ধ করুন
রাষ্ট্র-বিরোধী ষড়যন্ত্রের রং চড়াতে অন্যায়ভাবে ইউএপিএ-র প্রয়োগ বন্ধ করুন

উমর খলিদ ২০২০র ১ সেপ্টেম্বর দিল্লী পুলিশ কমিশনার শ্রী এস এন শ্রীবাস্তবকে যে চিঠি দিয়েছেন, যাতে বলপূর্বক আদায় করা বিবৃতির মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সাজানোর দিল্লী পুলিশের প্রচেষ্টার ন্যক্কারজনক নিদর্শন রয়েছে, সেই সম্পর্কিত সংবাদ আমাদের শঙ্কিত করেছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, দিল্লী পুলিশ (স্পেশাল সেল) জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এক যুবকের কাছ থেকে দিল্লী দাঙ্গা সম্পর্কে জোরজবরদস্তি মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করে তার ভিডিও তোলে। ওই যুবককে হুমকি দেওয়া হয় যে সে স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকার করলে তাকে ইউএপিএ আইনে গ্ৰেপ্তার করা হবে। আতঙ্কিত হয়ে সে ওই জুলুমের কাছে নতিস্বীকার করে, এবং পরে বিবেক তাড়িত হয়ে যা ঘটেছে তা প্রকাশ করে।

আমরা এই জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে, যিনি ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমের একাংশের কলঙ্ক লেপনের ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন, সেই যুবক স্কলার উমর খলিদকেই এখন সাজানো সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দাঙ্গার ঘটনাগুলোতে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে। উমর খলিদ আইনের ঊর্ধ্বে নন এবং পুলিশের তদন্তে তাঁকে সহযোগিতা করতে হবে। কিন্তু আইনের প্রক্রিয়াকে যখন শর্টকাট ও গুরুত্বহীন করে তোলার চেষ্টা হয়, নাগরিকের স্বাধীনতা তখন গুরুতররূপে বিপন্ন হয়ে পড়ে।

এর আগে অন্যান্য নাগরিকরাও জানিয়েছেন যে, দিল্লী দাঙ্গার ঘটনাগুলোতে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁদের ওপরও জোর খাটানো হয়েছিল।

নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যমের তদন্তে এই বিষয়টা ধরা পড়েছে : দিল্লী পুলিশের পেশ করা দয়ালপুর থানার অঙ্কিত শর্মা সম্পর্কিত চার্জশিটে (এফআইআর নং ৬৫/২০) চার ব্যক্তির হুবহু একই স্বীকারোক্তি রয়েছে। দয়ালপুর থানার রতনলাল সম্পর্কিত চার্জশিটে (এফআইআর নং ৬০/২০) সাতটা অভিন্ন স্বীকারোক্তি রয়েছে। এবং জাফরাবাদ থানার একটা চার্জশিটেও (এফআইআর নং ৫০/২০) দশ জনের স্বীকারোক্তিতে হুবহু মিল রয়েছে। এছাড়া, গোকুলপুরি থানার দিলওয়ার নেগি সম্পর্কিত চতুর্থ একটা চার্জশিটে (এফআইআর নং ৩৯/২০) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা ১২ জনের স্বীকারোক্তির মধ্যে ৯ জনের স্বীকারোক্তিতে প্রায় আক্ষরিক মিল খুঁজে পেয়েছে।

জোর করে আদায় করা স্বীকারোক্তি এবং মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণের এই নকশাটা অত্যন্ত শঙ্কাজনক। আমরা দিল্লী পুলিশের কাছে আর্জি জানাচ্ছি – মিথ্যা ও জোরজবরদস্তি আদায় করা এই সাক্ষ্যপ্রমাণের মোকাবিলা করুন, আইন এবং কার্যপ্রণালীর অবশ্যমান্যতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন এবং তদন্তকে পরিচ্ছন্ন ও ন্যায়সংগত ধারায় পরিচালিত করুন যাতে সেই ভয়ংকর হিংসার প্রকৃত অপরাধীদের গ্ৰেপ্তার করা যায়, যে হিংসায় ৫৩ জন নিহত হয়েছেন, শতাধিক আহত হয়েছেন এবং সহস্রাধিক মানুষের সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে।

দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা লিখিতভাবে জানাচ্ছি উত্তর পূর্ব দিল্লীর দাঙ্গার ঘটনাগুলোতে চালানো তদন্তের ধরন সম্পর্কে আমাদের আপত্তির কথা, আইনের শাসনের কাছে এই বিষয়টা কী ধরনের গুরুত্ব বহন করে তার কথা, নাগরিক স্বাধীনতা এবং প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার কথা।

পুলিশ সম্পর্কে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার হওয়াটা জরুরি। উত্তর-পূর্ব দিল্লীর দাঙ্গার ঘটনাগুলোর তদন্ত একদেশদর্শী হিসেবে চালানো হচ্ছে, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারী ও ওই আন্দোলনের সমর্থকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে।

আমরা চাই দিল্লী পুলিশ কমিশনারেট আমাদের এই আশ্বাস দিন যে – সাক্ষ্যপ্রমাণ সাজাতে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের রীতি অবিলম্বে বন্ধ করা হবে; যারা এই কাজগুলো করবে তাদের দায়ী করা হবে; এবং তথাকথিত এই স্বীকারোক্তি ও সাজানো সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে উমর খলিদ বা অন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।

জোরজবরদস্তি আদায় করা এই স্বীকারোক্তিগুলোকে ইউএপিএ প্রয়োগেরও ভিত্তি করা যায় না। এবং এই আইনকে বিচার-বিবেচনাহীনভাবেই প্রয়োগ করা হচ্ছে যাতে অভিযুক্তদের কাজে রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের একটা চেহারা দেওয়া যায়। এই মামলাগুলোর সবকটি থেকেই ইউএপিএ তুলে নেওয়ার জন্য আমরা দিল্লী পুলিশের কাছে আর্জি জানাচ্ছি।

খণ্ড-27
সংখ্যা-33