খাদের নীচে গড়িয়ে পড়া দেশীয় অর্থনীতিতে সরু একটা রূপালি রেখা দেখা গেছিল কৃষি ক্ষেত্রে। কিন্তু, গোটা অর্থনীতির ভঙ্গুর কাঠামোয়, চাহিদার ঘোর সংকটের বাতাবরণে যে এটাও দীর্ঘস্থায়ী হবে না তা আমরা দেশব্রতীর ৩ সেপ্টেম্বর সংখ্যার একটা লেখায় বলেছিলাম। খুব সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত তথ্য তাই প্রমাণ করলো।
আশানুরূপ রবি ফসল প্রথম ত্রৈমাসিকে কৃষি ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি ও সাময়িক চাহিদা বাড়ালেও সম্প্রতি যে নতুন তথ্যগুলো আসতে শুরু করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে আবার দাম বা মুল্যের পতন নতুন এক কৃষি সংকটের ইঙ্গিতবাহী। ফুল বাগিচা-দুগ্ধজাত পণ্য-পোল্ট্রি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উৎপাদিত পণ্যে দাম পড়তির দিকে।
কিছু সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ফের উন্নত মজুরি ও কাজের খোঁজে তাঁদের আগেকার কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলেও, এখনো বিরাট অংশটা নিজ নিজ এলাকাতেই রয়েছেন। পরিযায়ী শ্রমিকরা তাঁদের কর্মক্ষেত্র থেকে প্যান্ডেমিকের আগে পর্যন্ত গ্রামে তাঁদের পরিবারের জন্য যে টাকা পাঠাতেন, তা গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রাখতো। যেমন, সরকারী তথ্য অনুযায়ী, বিহারের রাজ্য জিডিপির ৩৫ শতাংশই হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্রামে পাঠানো উপার্জনের টাকা। আর, এটাই অ-কৃষি পরিবারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতো। ২০১৭-র আর্থিক সমীক্ষার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা (এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়ার) আনুমানিক ১৩.৯ কোটি। আর, শিল্প সংস্থাগুলোর হিসাব, ফি বছর গোটা দেশের পরিযায়ী শ্রমিকরা তাদের পরিবারের কাছে উপার্জনের যে অর্থ প্রেরণ করে তার পরিমান আনুমানিক দুলক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিহার ও উত্তর প্রদেশ, এই দুই রাজ্যে উক্ত পরিমানের প্রায় ৬০ শতাংশ প্রেরিত হয়। ওড়িষ্যা-ঝাড়খন্ড-তামিলনাড়ু-অন্ধ্র প্রদেশ হলো সেই সমস্ত রাজ্য যেখানে ভালো পরিমানে যায় এই প্রেরিত অর্থ। আমাদের এ রাজ্যে এ সম্পর্কিত প্রামান্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। লকডাউনের পর কাজ হারা পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজ নিজ ঘরে ফিরে আসায় এই বিপুল অর্থের ঘাটতির কবলে পড়েছে নিম্ন আয় সম্পন্ন রাজ্যগুলি।
এবার নতুন এক স্বাস্থ্য সংকটের মুখে পড়তে চলেছে গ্রামীণ ভারত। ধাপে ধাপে আনলক পর্বে শহুরে ভারত থেকে কোভিড এবার গ্রামীণ ভারতের দিকে এগোচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন দেশে নতুন করে এক লক্ষ মানুষ করোনা সংক্রামিত হচ্ছেন, আর নতুন নতুন জেলাগুলোতে হাজারেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। একেই স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর চুড়ান্ত অপ্রতুলতার মধ্যে নতুন করে যদি কোভিড সংকট গ্রামীণ ভারতে ঘনিয়ে ওঠে, তবে আর্থিক দিক ছাড়াও সামাজিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়বে সুদুরপ্রসারি। আর, চাহিদা যেটুকু তৈরি হচ্ছিল, সেটা আরও নিম্নগামী হবে।
প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ ও ইকনমিক স্ট্যাটিস্টিক্স এর স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রধান প্রণব সেন দুটি উদ্বেগের দিক তুলে ধরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বিপুল রবি ফসল একটা নতুন সংকটকে ডেকে এনেছে। দেশের একটা প্রান্ত, যেখানে ফলেছে বিপুল ফসল সেখানে আবার ট্রাকটরের চাহিদা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেশের আরেকটা প্রান্তে অন্য সংকট – সেটা হচ্ছে লাভজনক দাম না পাওয়া। আর এইগুলো হচ্ছে সেই সমস্ত রাজ্য, যারা পরিযায়ী শ্রমিকদের পাঠানো আয়ের উপর বেশ নির্ভরশীল।
দ্বিতীয় উদ্বেগের দিক হল, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর আর্থিক সংকট চাহিদা সৃষ্টির উপর প্রভাব ফেলছে। এখনো পর্যন্ত গ্রামীণ উৎপাদিত পণ্যের ৪০-৪৫ শতাংশ শহরমুখী হয়, বাকি সিংহভাগই গ্রামীণ বাজারের উপর নির্ভরশীল। ফলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রি হতে পারছে না চাহিদার অভাবে, যা ডেকে আনছে নতুন এক সংকট।
জিএসটি বাবদ রাজ্যগুলোর যে পাওনা কেন্দ্রের কাছে ছিল তাতে রীতিমতো টান পড়েছে। এর প্রভাব রাজ্যগুলোর অর্থনীতিতেও পড়তে শুরু করেছে। সরকারের তথ্য দিয়ে প্রণব সেন দেখিয়েছেন, ২০২০-২১-র প্রথম ত্রৈমাসিকে গত বছরের সাপেক্ষে রাজ্য সরকারগুলোর আয় কমেছে ১৮.২ শতাংশ, আর খরচ বেড়েছে নামমাত্র ২.৭ শতাংশ। বেশ কিছু রাজ্য খরচের উপর বড় ধরনের রাশ টানায় চাহিদা আরো সংকটাপন্ন হয়ে উঠবে, যা, শেষ বিচারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে সংকোচনে শ্বাসরোধকারী অর্থনীতিকে।
ক্রিসিল এর প্রকাশ করা তথ্য জানাচ্ছে, মধ্যবর্তী পর্যায়ে ভারতের প্রকৃত জিডিপির থেকে স্থায়ীভাবে লুপ্ত হবে ১৩ শতাংশ, যা এশিয়-প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনীতির তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি! স্থায়ীভাবে লুপ্ত হওয়ার অর্থ হল আর কোনোদিনই জিডিপির ঐ মূল্যটি পুনরুদ্ধার করা যাবে না। আরো সহজে বললে, এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে ৩০ লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের অর্থনীতি লোপাট হয়ে যাবে। এর পরিণাম – বিরাট মাত্রায় বেকারত্ব ও ছদ্মবেশী কর্মসংস্থান বা ডিসগাইসড এমপ্লয়মেন্ট।
সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনোমি (সিএমআইই)-র সিইও মহেশ ভ্যাস জানিয়েছেন, এক আতঙ্কজনক বেকারত্বের কোলে ঢলে পড়ছে ভারত। তিনি বলেছেন, প্রাক প্যান্ডেমিক পর্বেই দেশে কর্মহীন ছিলেন ৩.৫ কোটি। প্যান্ডেমিকের ছোবলে আরও দুকোটি বেতনভুক মানুষ কাজ হারায়। যা আবার ফিরে পাওয়ার আশা রীতিমতো দুষ্কর। এই ৩.৫ কোটির মধ্যে ২০ লক্ষ প্রতি মাসে যুক্ত হচ্ছেন শ্রম বাজারে। যাদের বয়স বছর ১৫ থেকে ৫৯-র মধ্যে। অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ক্ষেত্রে কাজের জন্য ভিড় বেড়েছে, যাকে ছদ্মবেশী কর্মসংস্থান বলেই আখ্যা দেওয়া যায়। যত বেশি সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ যুক্ত হচ্ছেন কৃষি ক্ষেত্রে, ততই জোরালো হয়ে উঠবে নূন্যতম সহায়ক মূল্যের দাবি, যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে পঞ্জাব, হরিয়ানার বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র জুড়ে। ভারতের কৃষিক্ষেত্র কোনোদিনই লাভজনক ছিল না, আর বর্তমানে আরো বেশি বেশি মানুষ তার সাথে যুক্ত হওয়ায় তা আরও অলাভজনক হয়ে পড়বে।
অকৃষি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি বিনিয়োগ করার বদলে ব্যাঙ্ক মারফত ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়ায় অর্থনীতির হাল ফিরে আসার সব সম্ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছে।
গভীর থেকে গভীরতর সংকটের কবলে দেশের অর্থনীতি। করোনা আক্রান্ত আর কোনো দেশের অর্থনীতি, এমনকি পাকিস্তানও এতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েনি। এদিকে, প্রতিদিন সংক্রমণের সংখ্যা ও গতির নিরিখে ভারত আজ বিশ্বে পয়লা নম্বরে।
মোদীর ভারত আর কত প্রশ্নেই যে রেকর্ড করবে তা বলবে আগামী দিনগুলো।
– অতনু চক্রবর্তী