মোদী সরকার এক নির্ভেজাল বিপর্যয় -- বেড়েই চলেছে কোভিড, মুখ থুবড়ে পড়েছে জিডিপি
mod

এখন আমাদের সামনে রয়েছে সরকারের নিজেরই প্রকাশ করা ২০২০-২১ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের অর্থনৈতিক ফলাফল। গত বছরের এই ত্রৈমাসিকের তুলনায় জিডিপি ধসে গেছে একেবারে ২৩.৯ শতাংশ, ভারতের সঙ্গে তুলনা চলতে পারে বিশ্বের এমন সমস্ত দেশের মধ্যে যেটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট ফলাফল। এর আগে গত চার দশকে ভারতের অর্তনীতিতে বৃদ্ধির হার কখনও ঋণাত্মক হয়নি। এটা একটা প্রাথমিক হিসেব এবং অর্থনীতিবিদদের ধারণা চূড়ান্ত পরিসংখ্যান এর চেয়েও খারাপ হবে বলে মনে হয়। ভারতের প্রাক্তন প্রধান পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন মনে করেন অর্থনীতির সংকোচন হয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। তিনি তাঁর হিসেবের মধ্যে অবিধিবদ্ধ ক্ষেত্রটিকেও ধরেছেন যে ক্ষেত্রের কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য এখনও আমাদের কাছে নেই।

যে সরকার অর্থনীতির ক্ষয়ের কথা কখনও স্বীকার করতে চায়নি, সেই সরকারই এখন এই ক্ষয়কে ‘দৈব দুর্বিপাক’ হিসাবে, লকডাউনের কারণে অর্থনীতিতে ঘটা বিপর্যয়ের স্বাভাবিক পরিণতি বলে চালাতে চাইছে। এটা স্পষ্টতই এক মস্ত বড় মিথ্যা। বিমুদ্রাকরণের পর থেকে বেশ কিছু সময় ধরেই ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে মন্দা দেখা যাচ্ছে। ২০১৮-১৯ বর্ষ থেকে পরপর আটটা ত্রৈমাসিকে ভারতের জিডিপির পতন হতেই থেকেছে, লকডাউন পরবর্তী পর্যায়ে বৃদ্ধি ব্যাপক হারে ঋণাত্মক হওয়ার আগে বৃদ্ধির হার ৮.২ শতাংশ থেকে কমে ২০২০-র মার্চে শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে দাঁড়ায় একেবারে ৩.১ শতাংশে। ধারাবাহিক মন্থরতা অর্থনীতিকে এখন এনে ফেলেছে একেবারে রসাতলে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন দেশই কোনো না কোনো ধরনের লকডাউনের আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু কোথাও তা অর্থনীতিতে এই ধরনের বিপর্যয় ঘনায়নি। সবচেয়ে কঠোর ও দানবীয় লকডাউন সবচেয় বিপর্যয়কর পরিণামই ঘটিয়েছে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রগুলি ধরে ধরে জিডিপির পতনের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে, এই পতন শুধু নির্মাণ, পরিবহন, বিমান চলাচল, আতিথেয়তা এবং পর্যটনের মতো ক্ষেত্রগুলিতেই সীমিত নেই, যে ক্ষেত্রগুলিতে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। এমনকি প্রধানত বিচ্ছিন্ন করে রাখা খনন ক্ষেত্র অথবা জন পরিষেবাগুলিরও – সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সাধারণের প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর যোগানের ওপর গুরুত্ব দিলে যেগুলিতে বৃদ্ধি দেখা যেত – ব্যাপক হারে সামগ্ৰিক পতনে যথেষ্ট অবদান রয়েছে। একমাত্র যে ক্ষেত্রটিতে সামান্য ধনাত্মক বৃদ্ধি দেখা গেছে তা হল কৃষি। কিন্তু জিডিপিতে কৃষির অবদানের হার ক্রমেই কমে আসছে আর কৃষি ক্ষেত্রের সামান্য বৃদ্ধি তাই সামগ্ৰিক পরিসংখ্যানের উন্নতি ঘটাতে পারে না।

ভয়াবহ সংকোচনের এই পরিস্থিতি থেকে অর্থনীতির কি নিজের থেকেই পুনরুজ্জীবন ঘটতে পারে? সরাকার এবং তার দায়িত্বশীল অর্থনৈতিক প্রশাসকরা বোধকরি এমনই একটা খোয়াব দেখে থাকেন। তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ ইংরাজি ‘ভি’ অক্ষরের আকারে পুনরুজ্জীবনের পূর্বাভাস দিচ্ছেন, যার অর্থ হল, যে তীব্র হারে অর্থনীতির পতন হয়েছিল সেরকম দ্রুত গতিতেই তা চাঙ্গা হতে শুরু করবে। কিন্তু যাঁরা বিশ্ব অর্থনীতির প্রবণতাকে পর্যবেক্ষণ করে থাকেন তাঁদের মধ্যে ক্রমেই আরও বেশি-বেশি পর্যবেক্ষক জানাচ্ছেন যে, পুনরুজ্জীবনের রেখাচিত্রটি দেখতে ইংরাজি ‘ভি’ বা এমনকি ‘ইউ’ অক্ষরের মতনও হবে না, তা হবে ‘কে’ অক্ষরটির মতো, যেখানে কিছু অংশের (বলা ভালো, কর্পোরেট সংস্থার) বৃদ্ধি ঘটলেও অন্যান্য অংশের অবনতি হতে থাকবে, ফলে ফারাকের বৃদ্ধি ঘটবে বা অসাম্যের মাত্রা বাড়বে। তবে যে কোনো ধরনের পুনরুজ্জীবনেরই মূল শর্ত হল জরুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। ভূল নীতি এবং নিষ্ক্রিয়তার পরিণামেই এই বিপর্যয় ঘটেছে, পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রয়োজন ফলদায়ী নীতি এবং দৃঢ় পদক্ষেপের ভিত্তিতে এতদিন অনুসৃত পথের আশু সংশোধন।
বিনিয়োগ, চাহিদা এবং উপভোগ – এই তিনটি বিষয়ই

ভারতের অর্থনীতির সংকোচনের পিছনে মূল কারণ বলে দেখা যাচ্ছে। বিপুল পরিমাণে কাজ ও আয় নষ্ট হয়েছে যা লক্ষ-লক্ষ মানুষকে ক্ষতিগ্ৰস্ত করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক যৌথ সমীক্ষার আনুমানিক হিসেব হল, কোভিড-১৯ অতিমারী পরবর্তী পর্যায়ে নির্মাণ সহ সাতটি মূল ক্ষেত্রে ৪১ লক্ষ যুবক কাজ হারিয়েছেন। ভারতীয় অর্থনীতির নজরদারী কেন্দ্র জানিয়েছে এপ্রিল মাসের পর থেকে ১ কোটি ৮৯ লক্ষ বেতন ভিত্তিক কাজ নষ্ট হয়ে গেছে। এই কাজ চলে যাওয়ার সাথেই এসেছে ব্যাপক হারে মজুরি হ্রাস, যার ফলে আয় ও সঞ্চয়ের প্রচুর পরিমাণে হ্রাস ঘটেছে যা উপভোগ, চাহিদা এবং অতএব বিনিয়োগকে দমিয়ে রাখতেই পারে।

এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হল জরুরি ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে তার ব্যয়ে বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। এই বৃদ্ধির পরিকল্পনায় যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে সেগুলো হল – আয় নষ্ট হওয়ার ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে নগদ টাকা হস্তান্তর, গণবণ্টন ব্যবস্থাকে সর্বজনীন করে তুলে প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য মাসে ১০ কেজি খাদ্যশস্য প্রদান সুনিশ্চিত করা, এমএনআরইজিএ প্রকল্পের অধীনে কর্মদিবস বাড়ানো এবং এই প্রকল্পেরই ধারায় শহর কর্মসংস্থান প্রকল্প চালু করা এবং সমস্ত ক্ষুদ্র ঋণ ও সুদ/কিস্তি পরিশোধ স্থগিতের সময়কালকে সম্প্রসারিত করা। মোদী সরকার এর বিপরীত পথটাই বেছে নিয়েছে – সে রাজ্যগুলোর পাওনা বকেয়া জিএসটি মেটাচ্ছে না, আর জনধন অ্যাকাউন্টগুলোতে টাকা পাঠানোর কথা না তোলাই ভালো। টাকার অভাবে জর্জরিত রাজ্য সরকারগুলোও বেতন প্রদানে বিলম্ব করছে এবং প্রয়োজনীয় খরচগুলোতে কাটছাঁট করছে, যা সরকারী ব্যয়, পরিষেবা প্রদান ও চাহিদাকে সংকুচিত করে তুলছে।

লকডাউনকে আচমকাই ঘোষণা করা হয়েছিল সাময়িক নিয়ন্ত্রণ ও কষ্ট স্বীকারের এক পদক্ষেপ রূপে যা ভারতে কোভিড সংক্রমণের রেখাচিত্রকে ফলপ্রসূভাবেই একেবারে নীচে নামিয়ে আনবে। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে চালু রাখা কঠোর লকডাউন ভারতে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতিকে মন্থর করতে পারেনি, তা শুধু সংক্রমণের শীর্ষ স্তরে পৌঁছানোর কালকে কিছুটা বিলম্বিত করেছে, ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার ছ-মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও সংক্রমিতদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হয়ে তার রেখাচিত্র তীব্রভাবে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এখন আবার অতিমারি অত্যন্ত শঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলে মাত্র দু-সপ্তাহেরও কম সময়ে সংক্রমিতদের সংখ্যায় নতুন ১০ লক্ষ সংক্রমিতকে যুক্ত করলেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করা হচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষায় বসতে বাধ্য করা হচ্ছে আর ভোটারদেরও বাধ্য করা হচ্ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে যুক্ত হতে।

সরকার অতিমারি এবং অর্থনীতি উভয় ফ্রন্টেই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করার নামে সরকার ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর এক নতুন বুলি চালু করেছে আর প্রধানমন্ত্রী এর গুরুত্বকে পর্যবসিত করেছেন জনগণকে ভারতে তৈরি খেলনা কেনা, দেশি কুকুর পোষা এবং ফোনে অ-চীনা অ্যাপ ব্যবহারের পরামর্শ দানের মধ্যে। অন্যদিকে আদানি ও আম্বানিদের মধ্যে অধিগ্রহণের তুমুল ধুম পড়েছে, তারা তাদের নিয়ন্ত্রণকে সম্প্রসারিত করে নিয়ে যাচ্ছে পরিকাঠামো ও সংযোগের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে। প্রাধান্যকারী গণমাধ্যমসমূহ চটকদার কায়দাবাজিগুলো নিয়ে মাতামাতি করলেও জনগণ কিন্তু এই চিত্রনাট্য এবং নাচানোর কারুকলাকে ক্রমেই আরও বেশি করে প্রত্যাখ্যান করছেন। ছাত্র-ছাত্রীরা ইন্টারনেটে মোদীর ভিডিওকে এত ডিসলাইকের ঢেউয়ে ডুবিয়ে দিচ্ছে যে বিজেপি ডিসলাইক বোতামটাকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েই নিজেদের বাঁচানোর কথা ভাবতে পেরেছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় ডিসলাইককে প্রবল রাজনৈতিক প্রতিরোধে পরিণত করার সময় তরুণ ভারতের কাছে সমুপস্থিত; যে সরকারটা শুধু বিপর্যয়েরই জন্ম দিতে এবং জনগণের ওপর নিদারুণ যন্ত্রণা চাপিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত, নির্বাচনে তাকে প্রত্যাখ্যান করাটাও তরুণ ভারতের কাছে জরুরি হয়ে উঠেছে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)   

খণ্ড-27
সংখ্যা-33