দুটো টুইটের জন্যে প্রশান্ত ভূষণকে দোষী সাব্যস্ত করে ১০০ পাতারও বেশি এক রায় দেওয়ার পর বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও তাঁর সহকর্মীরা আরও একটা লম্বা রায় দিয়ে সাজার পরিমাণ ঘোষণা করলেন। প্রশান্ত ভূষণকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এক টাকা জরিমানা জমা দিতে বলা হয়েছে, আর তা না দিলে তিন মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে এবং তার সাথে তিন বছর ওকালতি পেশার ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয় যে, প্রশান্ত ভূষণ জরিমানা দেওয়ার বিকল্পটাকেই বেছে নিয়েছেন, কেননা, তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে টুইটগুলোর জন্যে তিনি কোনো মার্জনা ভিক্ষা করবেন না, আর এর জন্য সুপ্রিম কোর্ট আইনসিদ্ধভাবে যে শাস্তি নির্ধারণ করবে তিনি খুশিমনে তাকে মেনে নেবেন।
আদালত অবমাননার এই মামলায় বিচারপতি অরুণ মিশ্র যে দুটো রায় ঘোষণা করেন তার মধ্যে ১৪ আগস্টের রায়ে টুইট দুটোর জন্যে প্রশান্ত ভূষণকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, আর আদালত চাপ প্রয়োগ করে তাঁর কাছ থেকে মার্জনা ভিক্ষা আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার পর ৩১ আগস্টের রায়ে সাজা ঘোষণা করা হয়। ভারতের বিচার বিভাগের ইতিহাসে চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারী ও উদ্ভট রায়গুলো নিয়ে তালিকা তৈরি হলে তার যে কোনো তালিকাতেই এই রায় দুটোর অবশ্যই স্থান হবে। দুটো টুইটকে আদালতের মর্যাদা হানি করা ও তাকে অস্থিতিশীল করে তোলার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করার পর তথাকথিত এই গুরুতর অপরাধের শাস্তি স্বরূপ এক টাকার প্রতীকী জরিমানা নির্ধারণ করাটা আদালতের পক্ষে চূড়ান্ত সামঞ্জস্যহীনতার লক্ষণকেই প্রকাশ করে। এই মামলায় আদালত এই ধারণারই জন্ম দিয়েছে যে সে নিজেকে এমন এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে নিয়ে গিয়েছিল যেখান থেকে বেরিয়ে আসাটা তার পক্ষে দুরূহ হয়ে দেখা দিয়েছিল।
আমরা কিন্তু গোটা বিষয়টাকে এমন এক বিচ্যুতি বলে গণ্য করতে পারি না যেখানে এই উদ্ভট রায়ের পর সবকিছুকে ভুলে যাওয়া যেতে পারে। আদালত সুস্পষ্টভাবেই একটা দৃষ্টান্তের অবতারণা করে নির্দিষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছিল। টুইটার সংস্থার কাছে বার্তাটা ছিল যে তাকে ‘যথোচিত আচরণ’ করতে হবে, তার মঞ্চকে নিয়ন্ত্রিত করতে ও বিধি-নিষেধের নিগড়ে বাঁধতে হবে এবং বিরোধী মত প্রকাশের প্রতি মুক্তহস্ত হলে চলবে না। এবং তা অভপ্রেত ফল দিল। সুপ্রিম কোর্ট তার রায় দেওয়ার আগেই টুইটার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আলোচ্য টুইটজোড়াকে মুলতুবি করে দেয়। ওই বার্তার লক্ষ্য প্রশান্ত ভূষণ এবং আপামর জনসাধারণও ছিল। ভূষণ চাপের কাছে নতিস্বীকার না করলেও সুপ্রিম কোর্ট এই সুযোগে এমন একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করল যাতে করে অন্যান্য সমালোচনামূলক স্বরকে ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়।
তীব্রতর ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে জনগণ ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের জন্য যে লড়াই চালাচ্ছেন, তার কাছে এই গোটা আখ্যানটার দুটো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। প্রশান্ত ভূষণ জনগণের যে স্বতস্ফূর্ত সমর্থন ও সংহতি পেয়েছেন তা সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে, ভারতের জনগণের বড় অংশই গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান বিপদ সম্পর্কে সচেতন রয়েছেন এবং তাঁদের সমস্ত শক্তি দিয়ে একে রক্ষা করতে তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নিজের অবস্থানে দৃঢ় থেকে এবং চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে মার্জনাভিক্ষায় অস্বীকৃত হয়ে প্রশান্ত ভূষণ অত্যন্ত জোরালোভাবেই জনগণের এই অঙ্গীকারকে মূর্ত করেছেন। প্রত্যয়ের এই দৃঢ়তা এবং লড়াইয়ের এই নাছোড় মনোভাব দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার জন্য অপরিহার্য গুণাবলী। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত বারোজন এবং আরো অনেকে যেমন ভোগ করছেন, সেরকমভাবে আমাদের যদি মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর জেলে কাটাতে হয়, অথবা আমরা যদি অরুন্ধতি রায়ের মতো একদিনের কারাবাস বা প্রশান্ত ভূষণের জন্য একটাকা জরিমানার মতো লঘু সাজা পেতে সমর্থও হই, সব ক্ষেত্রেই আমাদের এই গুণাবলীর প্রয়োজন।
অন্য শিক্ষাটা হল আইনি সংস্কার এবং বিচারবিভাগের জবাবদিহির বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করা। আদালত অবমাননা অথবা দেশদ্রোহ অথবা মানহানি আইনের মতো ঔপনিবেশিক যুগের মতবাদ এবং দানবীয় আইন, অথবা এনএসএ, ইউএপিএ বা আফস্পার মতো আইনগুলোকে নিয়মিতভাবে ব্যবহার করা হয় বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে, বিরোধী মত প্রকাশের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনতে এবং বিচার-বহির্ভূত নিপীড়ন ও হিংসা চালানোকে শাস্তিহীন করে তুলতে। স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্রে এই আইনগুলোর কোনো স্থান থাকতে পারে না। সর্বশেষ এই ঘটনার পর আইনবিশারদদের আন্তর্জাতিক কমিশনও ভারতের অবমাননার জন্য শাস্তিযোগ্য আইনগুলোকে পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েছে। যখন আমরা দেখি যে, ক্ষমতাধর ও সুবিধাভোগীরা নিয়মিতভাবে আইনের শাসনকে লঙ্ঘন করছেন এবং রাষ্ট্র প্রণালীবদ্ধভাবে সাধারণ নাগরিকদের, বিশেষভাবে দরিদ্র ও মতাদর্শগতভাবে বিরোধী ভাবাপন্নদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে ও তাদের ক্ষমতার হানি ঘটাচ্ছে, বিচারবিভাগের জবাবদিহির প্রয়োজন কতটা জরুরি তখন তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমাদের ইতিহাসে আগস্ট হল প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার মাস। ফ্যাসিবাদী জমানা আমাদের ইতিহাসের বিকৃতিসাধন করে তাকে নতুন ধারায় লিখতে চাইছে এবং আরও চাইছে সংবিধানের সার্বিক বিপর্যয় ঘটিয়ে ও জনগণের ওপর দমন চালিয়ে তাদের “বিজয় ও কীর্তিগুলোকে” জাহির করতে। এই সময়ে কিন্তু প্রতিরোধকে তীব্রতর করে তুলে আমাদের বিজয়গুলোর উদযাপন ও সেগুলোকে সংহত করে তোলাটাও জরুরি। খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা ব্লুমসবেরিকে দিল্লীর সাম্প্রদায়িক হিংসা নিয়ে সংঘের দুরভিসন্ধিমূলক আখ্যান প্রকাশ থেকে সরে আসতে বাধ্য করাই হোক, অথবা আদালত অবমাননা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পিছু হটা, এলাহাবাদ হাইকোর্টের ডঃ কফিল খানের মুক্তির নির্দেশ দেওয়া এবং জাতীয় সুরক্ষা আইনে তাঁর ওপর চাপানো অভিযোগ বাতিল করাই হোক – এই ধরনের প্রতিটি ঘটনার নৈতিক যাথার্থ্য প্রতিপাদিত হওয়া ও বিজয়কে পুঁজি করে ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনের নিজেকে অব্যাহত রাখতে ও শক্তিশালী করে তুলতে হবে।
আর এই নৈতিক বিজয়ের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রতিশোধলিপ্সু এবং মজ্জাগত জাতপাতবাদী প্রকৃতি সম্পর্কেও আমাদের আরও বেশি করে অবহিত হতে হবে। প্রশান্ত ভূষণকে মাত্র একটাকা জরিমানা করে অব্যাহতি দেওয়া হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে মুম্বইয়ের এক দলিত ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী তরুণ সুবর্ণ সালভের জামিনের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বণ্ড দিতে বলা হয়েছে। জেএনইউ-র ছাত্রছাত্রীদের ওপর ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে এবিভিপি-র হামলার বিরুদ্ধে মুম্বইয়ে শান্তিপূর্ণ সংহতিমূলক প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার জন্য তাকে গ্ৰেপ্তার করা হয়। কাফিল খান বা সুবর্ণ সালভেরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করলে রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরুবাদী ও মনুবাদী প্রবণতাই তাদের অনেক বেশি বিপন্ন করে তোলে। অতএব বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইকে রাষ্ট্রের এই সংখ্যাগুরুবাদী ও মনুবাদী প্রবণতাকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ সেপ্টেম্বর ২০২০)