১৫ মার্চ, ২০১৯। ছোট্ট দেশ নিউজিল্যান্ডে ঘটে ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। দুটি মসজিদে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী ব্রেন্টন ট্যারেন্টের বন্দুক-হামলায় প্রার্থনারত অবস্থায় প্রাণ হারিয়ে ছিলেন ৫০ জন নিরপরাধ মানুষ। আহত শতাধিক। সেই ঘটনায় মর্মাহত প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন যেভাবে নিজের ক্ষোভ লজ্জা বেদনা প্রকাশ করেছিলেন তা সেই দেশের মুসলিম নাগরিকদের তো বটেই, সেই সৎ আবেগ গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ঘটনার বর্ষপূর্তিতে তিনি দিনটিকে ‘নিউজিল্যান্ডের অন্ধকারতম দিন’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর প্রতিশ্রুতিমত অস্ত্র-আইন সংশোধিত হয়েছে। অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাও ঘোষিত হয়েছে।
২০০২-এ প্রশাসনের মদতে তিনদিন ধরে চলা গুজরাট গণহত্যায় (যাকে পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বলে আখ্যা দিয়েছেন) বিশ্ববাসী সাক্ষী থেকেছিল সুপরিকল্পিত ক্রূরতম নিষ্ঠুরতম নারকীয় এক হত্যালীলার। ২০০০-এরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া এই হামলা চালিয়েছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী একাধিক সংগঠন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিযুক্ত হয়েও ক্লিনচিট পেয়ে গিয়েছিলেন। আজ অবধি, ভাষণপটু (অধুনা) প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে দুঃখপ্রকাশ করে একটি শব্দও দেশবাসী শোনেনি।
২০০৮-এর ২৯ সেপ্টেম্বর। মালেগাঁও-তে নুরাজি মসজিদের সামনে বাইক বিস্ফোরণে ৬ জনের প্রাণ গিয়েছিল, আহত হয়েছিলেন শতাধিক মানুষ। এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছিলেন সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সাত সদস্য। সাধারণ মানুষ এইভাবে বলি হয়েই চলেছেন কখনও জঙ্গী সংগঠনের, কখনও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হামলার। কাশ্মীরে গত কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার সাধারণ মানুষ। জঙ্গী নিধনের নাম করে বহু সাধারণ নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর তো ভূস্বর্গ পুরোপুরি সামরিক বাহিনীর দখলে। গত বছর কাশ্মীর থেকে কফিনবন্দি হয়ে ফিরেছিলেন মুর্শিদাবাদের পাঁচ ভূমিপুত্র। তারা সকলেই মুসলিম, পেটের তাগিদে আপেলের মরশুমে গিয়েছিলেন বাগানে খাটতে। জঙ্গি হামলায় নিহত হন। কাশ্মীরের শোপিয়ানে কিছু দিন আগে আরশিপোরা অপারেশনে সাজানো এক এনকাউন্টারে তিনজন নিরীহ যুবককে সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল, সম্প্রতি সেনা আধিকারিকরা স্বীকার করেছেন। মায়ানমারে প্রশাসনিক সন্ত্রাসে নিহত, ভিটেছাড়া, সর্বস্বান্ত হয়েছেন রোহিঙ্গা জনসাধারণ। আক্রমণকারীরা বৌদ্ধ। আমেরিকায় কিছু দিন আগে নিহত হয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড, মিনিয়াপোলিসের পুলিশের বর্বরতায়। তারপরও কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা হয়েছে আমেরিকায়। এইভাবে মানবাধিকার লাঞ্ছিত, লঙ্ঘিত হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। এইসব ঘটনায় কি সমস্ত হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল? না, তা করা যায়? কোনো সভ্য সমাজ তা করতে পারে না।
কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষে বর্তমানে এমন একটি সরকার ক্ষমতায় আছে, যার ক্ষমতায় আসাটাই সাম্প্রদায়িক বিভাজন আর জাতি বিদ্বেষকে ভর করে। তাই অবলীলাক্রমে একটি গোষ্ঠীকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে দেগে দিতে তাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না। মুড়ি বা পান্তা খেলে, লুঙ্গি পরলে, দাড়ি রাখলেই সে মুসলমান, আর মুসলমান মানেই সে ‘সন্ত্রাসবাদী’! আর এই শাসকদল দেশের সমস্ত সম্পদ লুঠে মানুষকে হৃতসর্বস্ব করলেও একটা জিনিষ সাধারণ্যে বিতরণে তারা দরাজ এবং ক্লান্তিহীন — দলিত, সংখ্যালঘুদের প্রতি আকণ্ঠ ঘৃণা, বিদ্বেষ আর অবিশ্বাস! তাদের অনুগৃহীত সংবাদমাধ্যমগুলি নজিরবিহীন ‘দায়বদ্ধতা’য় সেই বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে সমাজ দেহের প্রতিটি রক্ত কণিকায়। এরাজ্যেও তার বিরাম নেই। গদীলোভী মোদীভক্ত ছোট, বড়, মেজো, সেজো বিজেপি নেতারা তাদের ‘লাশ ফেলা’ ভাষণে অনবরত সেই বিষ উগড়ে চলেছেন। সেই বিষবৃক্ষের ফল ফলতে শুরু করেছে। আসছি সে কথায়।
অর্থনীতির বিধ্বংসী পতন (“দৈব দুর্বিপাক”!), ১২ কোটি মানুষের কাজ হারানো, দৈনিক প্রায় লাখখানেক করোনা-সংক্রমণ— এসবে মোদী সরকারের ঐতিহাসিক অবদানকে আড়াল করতে কখনও সীমান্তে হাস্যকর তাল ঠোকার, কখনও সুশান্ত-রিয়া-কঙ্গনা উপাখ্যানের আমদানি করতে হয়েছে। এবার দেশের মানুষের খাদ্য সুরক্ষাকে ধ্বংস করে দেশের কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পাস হয়ে গেল নতুন কৃষি আইন। আর এই সর্বনাশকে আড়াল করতে নতুন এপিসোড — ‘নিয়া’র তৎপরতা! ক’দিন আগে এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীকে ডেকে পাঠানো হল। এবার একেবারে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা মুর্শিদাবাদের গ্রাম থেকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল ৬ ‘জঙ্গি আল কায়েদা সদস্যকে’। কেরল থেকেও। এরা কারা? হত দরিদ্র প্রবাসী শ্রমিক, কাঠ মিস্ত্রি, ছাত্র, ক্ষেতমজুর। এরা ‘সন্দেহভাজন’। তাদের অপরাধ তো প্রমাণিত হয়নি এখনও! কিন্তু ‘দায়বদ্ধ’ মিডিয়া সবিস্তারে নানা লোম খাড়া করা কাহিনি নামিয়ে ফেললো বলে!
আসলে ভয় হয়। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ দিন দুই আগে এক খবরে প্রকাশ, জঙ্গী সন্দেহে ধৃত বেশ কয়েকজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে কয়েক দশক ধরে জেলবন্দি রাখার পর সম্প্রতি জানা গেছে — তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ। ‘নিয়া’র এই তৎপরতায় সাধারণ মানুষ ‘বলি’ হবেন না তো?
এবার আসি একটু পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজের কথায়, যাদের প্রতি বিজেপি-আর এস এস-এর ঘৃণা ক্রমশ ব্যাপ্ত হচ্ছে সমাজে। এরা এই রাজ্যের জনসংখ্যায় ২৭.১% (২০১১-র জনগণনা অনুসারে)। ২০১৪-তে Snap & Guidance Guild-এর এক সমীক্ষায় প্রকাশ — মুসলিম জনসংখ্যার ১৭.৩% নিরক্ষর, ১১.৮% প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরোতে পারেননি ৮০% কায়িক শ্রম বা দিনমজুরির সঙ্গে যুক্ত। মাত্র ১৭% মানুষ শহরে বাস করেন। মাত্র ০.৪% অধ্যাপনা, চিকিৎসা, ওকালতি ইত্যাদি পেশায় যুক্ত। ‘পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানের জীবনের বাস্তবতা : একটি প্রতিবেদন’ শীর্ষক রিপোর্টে প্রকাশ —মুসলিম জনসংখ্যায় স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়াশুনো ৪.৮৫%; স্নাতকোত্তর ১.৮৬%; সরকারী চাকরিতে আছেন ৩-৪%; মনমোহন সিং সরকারের আমলে গঠিত সাচার কমিটির বহুচর্চিত রিপোর্ট ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের করুণ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেছিল। চমকে দিয়ে এই রিপোর্ট জানিয়েছিল – পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের অবস্থা দলিতদের থেকেও খারাপ। গ্রামীণ মুসলিম প্রধান অঞ্চলে শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬-এ। তারপর গঙ্গা যমুনা ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। দেশে-রাজ্যে সরকার পাল্টে গেছে। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থার কিছু হেরফের হয়নি। কোনও সরকারই আন্তরিক উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে তাদের ব্যবহার করেছে। কিছু প্রসাধনী সংস্কার অবশ্য হয়েছে। বাংলার মসনদ যাদের চাই-ই চাই, সেই দিলীপ-সায়ন্তন-রাহুল কোম্পানি কতটুকু জানেন বাংলার এই দ্বিতীয় বৃহত্তম নাগরিক সমাজ সম্পর্কে? আমরা শহরবাসীই বা কতটুকু জানি যারা টিভি-র সামনে বসে গোল গোল চোখ করে মুগ্ধ বিস্ময়ে মিডিয়ার কল্পকাহিনিগুলো শুনি আর ঝালিয়ে নিই নিজের অবচেতনে থাকা জাতিবিদ্বেষ?
দু’দিন আগে সল্টলেকের সি এল ব্লকের অতিথিশালায় কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষকের সঙ্গে, শুধু মুসলিম হওয়ার জন্য চরম অমানবিক ব্যবহারের ঘটনা দুর্ভাগ্য ক্রমে আমরা সবাই জানি। শুধু একটি বিষয় — সেই হতবাক শিক্ষকদের অপমান-গোটা বাংলার চিন্তা চেতনা সংস্কৃতি সমাজবোধের অপমান। আজও বাঙালি হিন্দু-মুসলিম প্রতিবেশীরা ঈদ-বিজয়ায় পরস্পর কোলাকুলি করে মিষ্টিমুখ করেন। সেই ঐতিহ্য আমরা ভুলে যাব রামনবমীর নামে শিশুদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া গোমূত্রপায়ীদের প্ররোচনায়? কখনও না! বাংলায় এদের ঘৃণাভরা প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের বর্ষীয়ান শিক্ষকের চোখের জলের দাম মিটাবো!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত