প্রতিবেদন
কাফিল খানের মুক্তি ও আদালত
kafil

বর্তমান ভারতে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির হাতে যাঁরা চরম উৎপীড়নের শিকার হয়েছেন ডাক্তার কাফিল খান তাঁদের অন্যতম। প্রতিহিংসা তাড়িত হয়ে তদন্তকে প্রহসনে পরিণত করে মিথ্যা অভিযোগ এনে কী কেন্দ্রের, কী বিভিন্ন রাজ্যের গেরুয়া সরকার তাদের সমালোচক বিভিন্ন ব্যক্তির কন্ঠকে স্তব্ধ করতে জেলে আটক রাখার পথকেই অস্ত্র করেছে। আবার এঁদের মুক্তির দাবিতেও গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জনআন্দোলন। জনসমাবেশের মাধ্যমে মুক্তির সোচ্চার দাবি ওঠানো এবং তার সাথে আদালতে জনস্বার্থ মামলা সহ ব্যক্তিগত স্তরে বিভিন্ন আইনি উদ্যোগও সক্রিয় হয়েছে। কাফিল খানের মুক্তির দাবিতে একদিকে গণতান্ত্রিক উদ্যোগ সচল হয়েছিল, অন্যদিকে তাঁর পরিবারের সদস্যরা (বিশেষভাবে তাঁর মা) হন্যে হয়ে ছুটোছুটি করেছেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে এলাহাবাদ হাইকোর্ট। অবশেষে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ১ সেপ্টেম্বর মাঝরাতে মথুরা জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেলেন জাতীয় সুরক্ষা আইনে আটক ডাক্তার কাফিল খান।

আদালত তাদের রায়ে কি বলেছে? এককথায়, যোগী আদিত্যনাথ সরকার যে অভিযোগে ডাক্তার কাফিল খানকে গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করেছিল, আদালত তাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করেছে। ডাক্তার কাফিল খানের বিরুদ্ধে যোগী সরকারের অভিযোগ ছিল – আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএএ-বিরোধী বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে তিনি “ধর্মীয় ভাবাবেগকে উস্কিয়ে তুলেছিলেন”, এবং চেষ্টা করেছিলেন “ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বিবাদ উস্কিয়ে তুলতে” যাতে “বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলা যায়”। এবং আরও অভিযোগ ছিল, তিনি আলিগড় শহরের শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিলেন। এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি গোবিন্দ মাথুর ও বিচারপতি সৌমিত্র দয়াল সিং-এর বেঞ্চ তাঁদের রায়ে জানালেন, “সম্পূর্ণ বক্তৃতাটা পাঠ করলে আপাত দৃষ্টিতে তা ঘৃণা বা হিংসা ছড়ানোর কোনো উদ্দেশ্যকে দেখায় না। বক্তৃতা কোথাও আলিগড় শহরের শান্তি ও সুস্থিতিকে বিপর্যস্ত করার উপক্রম করেনি। বক্তৃতা নাগরিকদের মধ্যে জাতীয় সংহতি ও ঐক্যের আহ্বানই জানিয়েছে। বক্তৃতা কোথাও হিংসায় অনুমোদন দেয়নি”।

তাহলে আলিগড়ের জেলাশাসক কিসের ভিত্তিতে হিংসা, বিদ্বেষ উস্কিয়ে তোলার অভিযোগ এনেছিলেন? আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া তাঁর সিএএ-বিরোধী গোটা বক্তৃতাটা বিশ্লেষণ করার পর বিচারপতিদের সুচিন্তিত অভিমত হল, “জেলাশাসক বক্তৃতাটার প্রকৃত অভীষ্টকে উপেক্ষা করে তার ইচ্ছেমাফিক অধ্যয়ন করেছেন এবং বাছাই করা গুটিকয়েক বাক্যাংশের উল্লেখ করেছেন”। গেরুয়া ফ্যাসিস্তরা তাদের দুরভিসন্ধির বাস্তবায়নে, প্রতিহিংসার চরিতার্থতায় কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, কেমন বেশরম হয়ে উঠে গণতন্ত্রের সামান্য আব্রুটুকুকেও অবলীলায় ছুঁড়ে ফেলছে, বিচারপতিদের রায়ে তা পুরোপুরি উন্মোচিত হয়ে গেছে। বিচারপতিরা অকপটে বলে দিয়েছেন, “এ কথা বলতে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই যে, জাতীয় সুরক্ষা আইনে কাফিল খানকে বন্দী করে রাখা ও তাঁর বন্দী দশার সময়সীমা বাড়ানো – আইনের চোখে এর কোনোটাই সংগতিপূর্ণ নয়”।

কাফিল খানের বিরুদ্ধে যোগী সরকারের বিদ্বেষের উৎস সন্ধানে আমাদের স্মরণে আনতে হবে ২০১৭ সালে গোরখপুরের বাবা রাঘব দাস মেডিক্যাল কলেজে ৬৩টি শিশুমৃত্যুর মর্মন্তুদ ঘটনাকে। শিশুরা মারা গিয়েছিল অক্সিজেনের অভাবে। অক্সিজেন সরবরাহকারী সংস্থা বারবার চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও তাদের পাওনা মেটানো না হওয়ায় তারা অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। ডাক্তার কাফিল খানই শিশুদের বাঁচাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন, নিজের পকেটের টাকা দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার আনিয়ে শিশুদের শ্বাস সচল রাখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অথচ, এই ডাক্তার কাফিল খানকেই যোগী সরকার চিকিৎসায় অবহেলা, দুর্নীতির অভিযোগ এনে প্রথমে সাসপেন্ড ও পরে ২০১৭’র ১ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে। কিন্তু কেন? কাফিল খান একটা সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “আমাকে জেলে পোরা হয়েছিল কারণ আমি ৭০টা শিশুর ঘাতক ব্যবস্থাকে উন্মোচিত করেছিলাম বলে এবং অন্য কোনো কারণে নয়”। যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা শিশুদের প্রাণবায়ু সচল রাখাকে উপেক্ষা করার মতো নির্মম হয়, শিশুদের বাঁচাতে অক্সিজেন সরবরাহকে অব্যাহত রাখায় কোনো গুরুত্ব দেয় না, সেই ব্যবস্থার সমালোচনা গেরুয়া প্রশাসন সহ্য না করতেই অভ্যস্ত। কাফিল খান আরও জানিয়েছেন, যোগী আদিত্যনাথ ২০১৭ সালে তাঁকে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে দেখে নেব”। সেবারও এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশে তিনি ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল মুক্তি পান। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে রাজ্য সরকার এক সদস্যের এক তদন্ত কমিটি বসায়। মুখ্য সচিব হিমাংশু কুমারের সেই তদন্ত কমিটি তাঁকে সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বলে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ “অসংগতিপূর্ণ ও ভিত্তিহীন”। ওই তদন্ত রিপোর্টে তাঁর কাজের প্রশংসাও করা হয়। কাফিল খান কিন্তু উত্তরপ্রদেশ ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সমালোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। সিএএ-বিরোধী সমাবেশগুলোতে অংশ নিয়ে নিজের বক্তব্য রাখা থেকে বিরত হন না।

প্রতিশোধলিপ্সু যোগী সরকারের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তাঁকে ফের গ্ৰেপ্তার করে মুম্বই বিমান বন্দর থেকে এবছরের ২৯ জানুয়ারী। কয়েক দিন পর ১০ ফেব্রুয়ারী তাঁর জামিন মঞ্জুর হলেও মুক্তি না দিয়ে তাঁকে আটকে রাখা হল। আলিগড়ের জেলা শাসক তাঁর ভাষণের বিকৃত ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করায় তাঁর ওপর জাতীয় সুরক্ষা আইন প্রয়োগ করা হল, যে নিপীড়নমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই এল এলাহাবাদ হাইকোর্টের আলোচ্য রায়।

কাফিল খান জানিয়েছেন গ্রেপ্তারের পর তাঁর ওপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাঁকে যেমন পা ওপর মাথা নীচু করে ঝুলিয়ে প্রহার করা হয়, তেমনি গ্ৰেপ্তারের পর ৭২ ঘণ্টা জল ও পাঁচ দিন কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। তাঁকে এই উদ্ভট প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, তিনি এমন কোনো পাউডার তৈরি করেছেন কিনা যা দিয়ে মানুষকে হত্যা করা যায় এবং যোগী সরকারের পতন ঘটানোর জন্য জাপান গিয়েছিলেন কিনা। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি যোগী শাসনের আওতার বাইরে থাকতে চলে গেছেন জয়পুর, কংগ্ৰেস শাসিত রাজস্থানে। তিনি শ্লেষাত্মক ঢঙে উত্তরপ্রদেশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বিকাশ দুবের মতো ভুয়ো সংঘর্ষে তাঁকে হত্যা না করার জন্য। আজ গণতন্ত্রের ওপর হামলা তীব্রতর হয়ে উঠেছে। মোদী সরকার যখন কোনো ধরনের সমালোচনা ও বিরোধিতা সহ্য না করে সরকারের সমালোচকদের নির্বিচারে জেলে পুরছে, সেই সময় গণতন্ত্রের সুরক্ষায় আদালতের জোরালো ইতিবাচক ভূমিকাই জনগণের কাছে আকাঙ্খিত।

কিন্তু আদালতের অভিমুখ প্রশাসনের সুরে সুর মেলানোর দিকেই প্রবলভাবে ঝোঁকা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় আটকদের মুক্তিকে আটকানোর সরকারের অভিপ্রায় আদালতের সমর্থন পাচ্ছে। এই মামলায় আরও কিছু ব্যক্তিকে জড়িত করে গ্রেপ্তার করার দুরভিসন্ধি সচল রয়েছে। দিল্লী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তদন্তকে ভীমা-কোরেগাঁও-এর ধারায় চালিত করে দাঙ্গার প্রকৃত সংঘটকদের আড়াল করে নিরপরাধ সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভকারী ও সেই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো সমর্থকদের অভিযুক্ত করার ষড়যন্ত্র সুস্পষ্ট আকার নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে গুরুতর অপরাধ বলার পরও তার জমি মন্দির নির্মাণের জন্য তুলে দিয়েছে মসজিদ ধ্বংসের সংঘটকদের হাতেই। এমনকি প্রশান্ত ভূষণ টুইট মামলাতেও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সংকেত হল – আদালতের এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনাকে সে অভিপ্রেত বলে মনে করছে না। যে সমালোচনার অধিকার গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত, সেই অধিকারের প্রতি অনীহা দেখালে তা স্বৈরাচারী শক্তির কাছে মদত হয়েই ওঠে। এই রকম এক তমসাচ্ছন্ন পরিমণ্ডলে এলাহাবাদ হাইকোর্টের এই রায় আশার এক আলোকবিন্দুর মতো। কিন্তু এর দীপ্তিতে এমন ঔজ্জ্বল্য নেই যা তরঙ্গায়িত হয়ে ঘন তিমিরকে ভেদ করতে পারে। কেননা, বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে আজ শাসনতন্ত্রের অনুগামী হওয়া, প্রশাসনকে না চটানোর প্রবণতা যথেষ্ট প্রবল বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে। শাসকের অনাচারকে তিরস্কার করে শাসককে গণতন্ত্র ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ করার রায় থেকে বিচ্ছুরিত আলোক রেখাকে শুষে নিচ্ছে শীর্ষের তিমির। অতএব, কাফিল খানের মুক্তির নির্দেশ দেওয়া এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বা তাবলিগি জমায়েত সম্পর্কে প্রশাসনের দুরভিসন্ধিকে উন্মোচিত করা বোম্বে হাইকোর্টের রায়ের মতো ইতিবাচক রায়গুলোকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি বিচার ব্যবস্থার শীর্ষকে গণতন্ত্রমুখী, জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি দায়বদ্ধ করার লড়াইকেও অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-32