সম্পাদকীয়
এখানে চলছে এক অপশাসন
ede

তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী হাঁক দিলেন মোদী সরকারের ‘তাণ্ডব’ থামাতে হবে। দলের এক ভার্চুয়াল ছাত্র সমাবেশ থেকে ঐ ডাক শোনানো হল। আহ্বানটা দেশজোড়া প্রেক্ষিতে দিলেও তার বিশেষ লক্ষ্য-উদ্দ্যেশ্য যে বাংলার ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন, তা চাপা থাকেনি। নেত্রীর মোদ্দা কথা হল, দেশে স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হলে বাংলার ছাত্রসমাজ তথা লোকসমাজকে তাঁর পাশে থাকতে হবে, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে টিএমসি-কে ফের ক্ষমতায়  আনতে হবে।

মত-পথ-চরিত্রের বিচারে মমতা সরকার নিশ্চয় মোদী সরকারের সমতুল্য নয়, অথবা টিএমসি অবশ্যই বিজেপির সমগোত্রের দল নয়। কিন্তু তবু এ প্রশ্ন অসঙ্গত নয় যে, মোদী-তাণ্ডব রুখে দেওয়ার প্রশ্নে মমতার হাঁকডাকের নৈতিক অধিকার থাকে কী করে? তা দাবি করলেও তার আবেদনের সারবস্তু বা কার্যকারিতা কতটুকু?

কেন্দ্রে মোদী জমানা কায়েমের পর থেকে টিএমসি যে বিরোধিতায় সরব হয়নি তা নয়। মুখ খুলেছে মূলত রাজ্যের প্রতি অর্থনৈতিক বঞ্চনা, যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর এককেন্দ্রিক হস্তক্ষেপ চাপিয়ে দেওয়া, বিদ্বেষ-বিভাজনের সমাজনীতি- রাজনীতি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে। যদিও এনপিআর অভিযান তৃণমূল সরকার প্রথম প্রথম শুরু করে দিয়েছিল, পরে গণক্ষোভের আঁচ পেয়ে গুটিয়ে নেয়। অন্যদিকে, কোভিড অতিমারী ও লক ডাউন অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে মোদী সরকার তান্ডব শুরু করে। কিন্তু দেশের প্রেক্ষিতে বিজেপির বিপ্রতীপে টিএমসি অবস্থান নেয় নামমাত্র কয়েকটি ইস্যুভিত্তিক। কাশ্মীরের ওপর থেকে সাংবিধানিক বিশেষাধিকার প্রত্যাহার, বাবরি মসজিদ ভাঙার মতো অপরাধ ও রামমন্দির প্রতিষ্ঠার শিলান্যাস পূজানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে খুব একটা সোচ্চার হয়নি। কয়লা, রেল, খনি, প্রতিরক্ষার মতো মূল মূল ক্ষেত্রের বড় মাত্রায় বেসরকারীকরণের পদক্ষেপ নিয়ে বিশেষ মুখ খোলেনি। তবে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে নিষ্ঠুর-নির্লজ্জ বিরোধ বাঁধে পরিযায়ী শ্রমিকদের দায়দয়িত্ব নেওয়া নিয়ে। মমতা সরকার সবচেয়ে সরব কোভিড ও আমফান মোকাবিলার প্রয়োজনে কেন্দ্রের কাছে পর্যাপ্ত আর্থিক সাহায্যের দাবিতে। আর, সদ্য কংগ্রেস ও আর পাঁচটা রাজ্য সরকারের সাথে মিলে জিএসটি ক্ষতিপূরণ এবং জয়েন্ট ও নিট পরীক্ষা সংক্রান্ত ইস্যুতে। কিন্তু এই ধারার মতিগতি টিএমসি-কে আকর্ষণের কোনো নতুন মাত্রা এনে দিতে কাজ দেয়নি। বরং অন্য কিছু ঘটনা ও প্রবণতার কারণে মমতা সরকার সম্মুখীন হচ্ছে জনগণের আরও ক্ষোভ ও অসন্তোষের।

তৃণমূলের অপশাসন চিহ্নিত মূলত তিনটি কারণে – দুর্নীতি, দলতন্ত্র ও দমনতন্ত্র। আর, কোভিড সংক্রমণ, অতিমারী ও লকডাউনের পরিস্থিতিতে তিনটি প্রবণতাই আরও বেড়েছে। শুধু তাই নয়, চরম অপদার্থতা প্রকাশ হয়ে চলেছে সবচেয়ে জরুরী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে। কোভিড ও আমফান পরিস্থিতিতে রেশন ও সরকারী অন্যান্য ত্রাণ বিলিবণ্টনে, পিপিই সরঞ্জাম কেনার দরপত্র নির্ণয়ে দুর্নীতির কথা চাপা নেই। সবক্ষেত্রেই শাসকদলের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পাকা, ছড়ি ঘোরাচ্ছে দলতন্ত্র। তার তথ্য মিলেছে জেলায় জেলায় পঞ্চায়েত সূত্রে। দুর্নীতির উৎস সন্ধান ও ব্যবস্থা নেওয়ার নামে মাঝেমধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর পৌরহিত্যে দরবারি আসর বসে, কার্যকরি কিছু হয় না।

টিএমসি যুক্তরাষ্ট্রীয়তার প্রশ্নে যতটা সরব, ততটাই খড়গহস্ত বিরোধী শক্তিগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে। ত্রাণ কাজে, কোভিড বা অন্যান্য চিকিৎসায় নজরদারী রাখার ব্যাপারে কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচী সংগঠিত করা, সব প্রশ্নেই। বিধিনিষেধের বেড়াজাল তুলে আটকানোর চেষ্টা হয়েছে অন্যদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে। শাসকদলের কর্মসূচী রয়েছে বলে আগে লকডাউনের দিন ঘোষণা করেও পরে প্রত্যাহার হয়, আর বিরোধীদের বহুল পরিচিত কর্মসূচী আটকাতে লকডাউন চাপিয়ে রাখা হয়। এমনকি ফ্যাসিস্ত দল বিজেপি অনেক প্রশাসনিক সুবিধা পায়, বাম দলগুলোর আবেদন সচরাচর অনুমোদন পায় না। প্রায়শই নামিয়ে আনা হয় পুলিশী দমন, ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় মিথ্যা মামলায়।  লক ডাউন কায়েম রাখতে সাধারণ মানুষের ওপর চলে অমানবিক পুলিশী আচরণ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখানে শাসকের উৎপীড়নে অবরুদ্ধ। এখানে চলছে এক অপশাসন। এরাজ্যে বিজেপির অনুপ্রবেশের জন্য টিএমসি যথেষ্ট দায়ী। অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে তার। তাই টিএমসি যখন আবার বিজেপিকে ঠেকানোর একচেটিয়া ঠিকেদারী দাবি করে তখন তার উপযুক্ত বিকল্প তুলে ধরার ভূমিকা নিতে হবে বাম শক্তিকে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-31