ভারতের প্রথম সারির মিডিয়ায়, বৈদ্যুতিন থেকে মুদ্রণ মায় প্রায় সমস্ত প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যমে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কুৎসা ও কলঙ্ক ছড়ানোয় প্রতিযোগিতার বান ছুটছে। এ নিছক কোনও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগের সম্প্রচার নয়। লাগাতার অনুধাবন করলেই বোঝা যায় চলছে পরিকল্পিতভাবে পেছনে লাগার প্রবণতা। পরোক্ষে হিন্দুত্বের রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে ফায়দা তোলার রসদ যোগানো। সম্প্রতি এরকম একটি বজ্জাতির কেস গড়ায় সুপ্রীম কোর্টে। বিচারপতি প্রকাশ্যে সংশ্লিষ্ট চ্যানেল কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে বিরল হুঁশিয়ারী দেন এই মন্তব্য করে যে, এভাবে একটা গোটা সম্প্রদায়কে কালিমালিপ্ত করার অধিকার থাকতে পারে না, এ চলতে দেওয়া যায় না, এসব উপস্থাপনা সংবিধান ও আইন বিরোধী। চ্যানেলটির সংবাদ পরিবেশনে বলা হয়েছিল, ইউপিএসসি অর্থাৎ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় যেসমস্ত মুসলিম পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন, সেন্ট্রাল সার্ভিস পদে নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের নাকি পাশ করানো হয়েছে কারসাজি করে, তারা নাকি সরকারী ঐসমস্ত পদে স্থলাভিষিক্ত হয়ে ‘অনুপ্রবেশকারী’র কাজ করবেন, এর পিছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র, রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দুনিয়ার অর্থরাশি, রয়েছে ইসলামিক রাষ্ট্রবাদী সন্ত্রাসবাদের ছায়া, ভারতে অন্তর্ঘাত-নাশকতা চালানোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য! গোটা প্রসঙ্গটা চিত্রিত করা হয়েছে এভাবে। কিন্তু ইউপিএসসি সরকার নিযুক্ত একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, যদিও একে কেন্দ্রের শাসকদলের কলকাঠিতে অঘোষিত নিয়ন্ত্রণের সর্বময় অপচেষ্টা চলে এবং সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী দৃষ্টিদূষণ অনুযায়ীই, তাই এজাতীয় কেন্দ্র থেকে অন্তত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কর্মপ্রার্থীদের কোনও সুযোগই থাকতে পারে না বিশেষ সুবিধা পাওয়ার। তাছাড়া এই পরীক্ষা যে তিনটি ধাপে নেওয়া হয় তার প্রাথমিক ধাপে শেষবার মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় আট লক্ষ, তারপরে দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় পনের হাজার। তারপর সবশেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন আটশ ঊনত্রিশ জন। এদের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে নিয়োগপত্র পাওয়ার সংখ্যা সামান্য মাত্র।
গত কয়েক বছরে এই সেন্ট্রাল সার্ভিসে মুসলিম সম্প্রদায় থেকে চাকরি পাওয়ার সংখ্যা একটু-আধটু বেড়েছে, তবু তা শতাংশের বিচারে অত্যন্ত নগণ্য, চার-পাঁচ শতাংশের মতো। অতএব তাদের বিশেষ সুবিধাভোগী প্রমাণের কোনও ‘যুক্তিজাল’ টেঁকে না। তবু মিডিয়া চ্যানেল সেরকমই চিত্রিত করেছে, করে থাকে। চ্যানেলে চ্যানেলে চলে এরকম আরও কতই না কুৎসা, কুনাট্য প্রদর্শনের রঙ্গ। চলে ছাপানো সংবাদপত্রেও। ঠোকরানো হয় মুসলিম মানেই তার দেশাত্মবোধে থাকে সন্দেহ, তারা যত না ভারতীয় তার চেয়ে মনে-প্রাণে নাকি অনেকবেশী ‘পাকিস্তানী’ বা ‘বাংলাদেশী’! যথেচ্ছ তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় ‘জেহাদী’। জীবন-জীবিকার যে কোনো বিষয়ে জেরবার করা হয় নানা প্রশ্নের ঝড় তুলে। সওয়াল করা হয় মুসলিমদের কোনো অংশেরই কেন ওবিসি সুবিধা পাওয়া উচিত নয়। অথবা কাঁচা বাড়ি পাকা করতে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার নাগাল পেতে কালঘাম ছুটিয়ে দেওয়া হয়। আর তা স্বাধীনভাবে করতে দেখলে, তা সে জমি বা পরিযায়ী শ্রম বেচা টাকায় হলেও সন্দেহ ছড়ানো হয়, গুজব রটানো হয়, সব হচ্ছে নিশ্চয়ই ‘জেহাদী’ বনে যাওয়ার বিনিময়ে পাওয়া টাকায়! কোনো-না-কোনো ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের নাম জুড়ে দিলেই হল। গ্রেপ্তার হওয়ার খবর করার সাথে সাথে ‘গোপন অস্ত্রশস্ত্র’ পেয়ে যাওয়ার তৈরি তথ্য শোনানো শুরু হয়ে যায়, তা সম্ভব না হলেও সন্দেহের জাল বিছিয়ে রাখা হয়।
সর্বোপরি ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের সংযোগ ‘কবুল করা’, বিভিন্ন নাশকতা পরিকল্পনার হদিশ পাওয়া ইত্যাদি খবর থাকে। চলে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’, গ্রেপ্তারেই যুক্তি জাহিরের তুবড়ি ছোটানো হয় বিচার সেরে ফেলার – কঠিন শাস্তি দেওয়ার রায় কি কেমন হওয়া দরকার! এরকম বহু কারসাজি পরবর্তীতে আদালতের বিচারে উন্মোচিত হয়েছে। মাঝখান থেকে বাধ্য করা হয়েছে বছরের পর বছর বিনা বিচারে বা সাজানো রায়ে কারারুদ্ধ থাকার দূর্ভোগ পোহাতে, জীবন হয়ে গেছে তছনছ। এনসিআরবি-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট উল্লেখ করেছে, কারাদন্ডপ্রাপ্তদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এভাবে ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে মিডিয়া বস্তুত পরিবেশকে পরিণত করছে হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক সন্দেহ, অবিশ্বাস, বিদ্বেষ-বিভাজন সৃষ্টির মৃগয়াভূমিতে। সুবিধা লুটছে ফ্যাসিস্ট শাসক শক্তি, ‘মব লিঞ্চিং’-এ মদত যোগাতে বা ‘এনআইএ’-‘এসটিএফ’-র হামলা নামাতে। সুবিধা হচ্ছে মিডিয়া মালিকশ্রেণীরও, শিহরণ তোলা খবর বিকোনোর দৌলতে সরকারপক্ষের নেপথ্য হাতযশে খুলে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনী ব্যবসা বাড়ানোর বাজার। গৈরিক শাসকের ঔদ্ধত্যে মদত পাচ্ছে আজ্ঞাবহে প্রভাবিত হওয়া মিডিয়া। বম্বে আদালত নিন্দা করলেও প্রধানমন্ত্রী সংসদে আবারও করলেন মিথ্যাচার, বললেন, করোনা ছড়িয়েছে গত মার্চ মাসের দিল্লীর তবলিগি জমায়েত থেকেই। সব মিলে এ হল কায়েমী স্বার্থের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক যোগসাজশের প্রকল্প।