গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ কেন্দ্রীয় কমিটির একটি অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দিনটি ছিল আমাদের প্রিয় কমরেড স্বপন মুখার্জীর চতুর্থ প্রয়াণ দিবস, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে সভার সূচনা হয়। এরপর, কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠকের পর থেকে আমরা আমাদের যে সব কমরেড, শুভার্থী ও বিশিষ্ট প্রগতিশীল ব্যক্তিত্বদের (কবি রাহাত ইন্দোরি, নারীবাদী শিক্ষাবিদ ইলিনা সেন, প্রশাসক মনোজ শ্রীবাস্তব, কমরেড বসির আহমেদ, ভগবান দাস (ঝাড়খণ্ড), কমরেড সিডি ডিমরি (দিল্লি), কমরেড অমরীক সিং সামাওন এবং সরবজিৎ কাউর (মানসা, পাঞ্জাব), কমরেড রহিম শেখ, রাণু দাশগুপ্ত ও আনু মিত্র (পশ্চিমবঙ্গ), কমরেড মোতি মাহাতো, বাবন পাশোয়ান, মহাবীর রাম, কালেশ্বর রাম, মন্টু মানঝি, নাথুনি রাবনি ও জগদীশ রাম (বিহার), কমরেড সূর্য (আইসা কর্মী, হায়দ্রাবাদ) এবং অন্যান্য) হারিয়েছি তাঁদের উদ্দেশে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শোকজ্ঞাপন করা হয়।
এক মাস আগে, কেন্দ্রীয় কমিটির বিগত বৈঠকের পর থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখের মধ্য দিয়ে বৈঠক শুরু হয়। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলা অতিমারি এবং অর্থনীতির ধারাবাহিক পতন – দু’টিকেই মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। গোটা বিশ্বে কোভিড-আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে ভারত এখন দু’নম্বরে, যেখানে সংক্রমিতের সংখ্যা ৪০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, আর নথিভুক্ত কোভিড মৃত্যুসংখ্যার নিরিখে ভারতের অবস্থান এই মুহূর্তে তৃতীয়, মৃতের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান আর্থিক বছরের ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন ২০২০) জিডিপি’র ধ্বস – লক ডাউন আর তার সঙ্গে অর্থনীতির পতনের দীর্ঘকালীন প্রবণতার বিধ্বংসী প্রভাবকেই তুলে ধরেছে। সরকার এটাকে ‘দৈব দুর্বিপাক’ বলে চালানোর চেষ্টা করছে এবং অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে জনসাধারণের চাহিদা ও ব্যয়বৃদ্ধির জন্য মানুষের আয়হীনতার ক্ষতিপূরণের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতেও অস্বীকার করছে। ফলে আসন্ন দিনগুলিতে, অর্থনীতি ও মানুষের জীবনজীবিকার ক্ষেত্রে এক অশুভ সংকেত ঘনিয়ে উঠছে। সরকার এই পরিস্থিতিকে ‘আত্মনির্ভরশীল ভারতের’ বিজ্ঞাপনী চমকসর্বস্ব প্রচার, এবং চিনা অ্যাপগুলির পর্যায়ক্রমিক নিষিদ্ধকরণ ও তীব্র রাষ্ট্রীয় পীড়ন দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর শক্তিশালী মিডিয়া, এই ‘গোপন করার’ খেলায়, অক্লান্ত প্রচারের মাধ্যমে বিভ্রান্তি, ঘৃণা উন্মাদনা উগড়ে চলেছে – আর এইভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত আর বিভাজিত করার চেষ্টায় এই শয়তানির সাথে সঙ্গত করে যাচ্ছে।
এই দৃশ্যপটের বিপরীতে আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ, যা বিশেষভাবে প্রতিভাত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আদালত-অবমাননার বিচারের বিরুদ্ধে প্রশান্তভূষণের প্রতি দেশজোড়া সংহতিজ্ঞাপনে, আর এই উন্মত্ত অতিমারির মধ্যে পরীক্ষা নেওয়ার বিরুদ্ধে বারংবার ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ এবং চাকরির জন্য যুবসমাজের জোরালো দাবি ঘোষণার মধ্যে। বেশ কয়েকটি জ্বলন্ত প্রশ্নে শ্রমিক, কৃষক ও মহিলাদের আন্দোলনও দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
এই ঘটনাপ্রবাহের প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটি বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখেছে এবং এক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা ও হস্তক্ষেপ বাড়িয়ে তোলার জন্য ধারাবাহিক সংগঠিত প্রয়াসের আহ্বান রেখেছে।
(১) আইসা, ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রদের কাছে যাওয়া, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং প্রতিবাদ কর্মসূচীর উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়ে ছাত্র এবং যুব প্রশ্নে কার্যকরী হস্তক্ষেপ ঘটিয়েছে। আরওয়াইএ বেকারত্বের বিরুদ্ধে যুববিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। চাকরির দাবি ক্রমশ বিস্ফোরক মাত্রায় পৌঁছাচ্ছে এবং এই ক্ষেত্রে কার্যকরী উদ্যোগ আরওয়াইএ-কে বলিষ্ঠতর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবে। আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-বিচলিত ছাত্র যুবদের গণতান্ত্রিক দিশার অভিমুখী করতে ও ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রযুবদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ সুদৃঢ় করতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এই লক্ষ্যে, সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও গণতন্ত্রের দাবিতে ছাত্রযুবদের ব্যাপকতম অংশের অংশগ্রহণের জন্য যাবতীয় প্রয়াস নিয়ে, ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলি আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ‘ভগৎ সিং জন্মদিবস’ উদযাপনের আহ্বান রাখতে পারে।
(২) মহিলাদের, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলির উৎপীড়ন ও হুমকির বিরুদ্ধে এবং ঋণমুক্তির দাবিতে বিশাল প্রতিবাদ আন্দোলনে ধারাবাহিক অংশগ্রহণও যথেষ্ট উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। এই প্রতিবাদের ফলে, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার দালালরা এই অতিমারী পরিস্থিতিতে ঋণগ্রহিতাদের হেনস্থা করার কৌশল থেকে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। যেসব অঞ্চলে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত আছেন, সেখানে মহিলাদের প্রতিবাদগুলি পঞ্চায়েতগুলিকে দিয়ে, যতক্ষণ না বেকারত্বের সংকট কাটছে, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলির দালালদের গ্রামে না ঢোকার নির্দেশ জারি করাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি এখন মহিলাদের হুমকি দিতে শুরু করেছে যে আন্দোলন চালিয়ে গেলে ভবিষ্যতে আর তাদের ঋণ দেওয়া হবে না।ঋণগ্রহীতাদের জন্য অবিলম্বে ত্রাণ ও ঋণমুক্তি নিশ্চিত করার এবং বর্তমানে ও ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এটাই আমাদের প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য। দীর্ঘমেয়াদী দাবি থাকবে – মহিলা এবং দরিদ্রদের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলি থেকে বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা। এই প্রশ্নে আমাদের শেষ দেশজোড়া প্রতিবাদে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। আমাদের আসন্ন সংসদ অধিবেশনের সময়ে, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর ঋণমুক্তি ও ঋণ-ত্রাণের দাবিতে আরেকটি দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচীর পরিকল্পনা নিতে হবে।
(৩) গত মাসে কৃষকদের বেশ কয়েকটি সাড়া জাগানো প্রতিবাদ ও বিভিন্ন অংশের শ্রমিকদের ধর্মঘট পালিত হয়েছে। কৃষক সংগঠনগুলির ঐক্যবদ্ধ মঞ্চে (এআইকেএসএসসি) ১৪ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। এআইসিসিটিইউ-ও আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর দেশজোড়া প্রতিবাদে নামছে। আর তার পরেই ২৩ সেপ্টেম্বর রয়েছে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ঐক্যবদ্ধ মঞ্চের যৌথ প্রতিবাদ কর্মসূচী। রেল, প্রতিরক্ষা কারখানার শ্রমিক, এবং চা ও অন্যান্য শিল্পের কর্মীরাও ধর্মঘট সহ বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। আন্দোলনের এই সমস্ত আহ্বানেই আমাদের সক্রিয় সমর্থন থাকবে।
(৪) আমাদের কমরেডদের উদ্যোগে অল ইন্ডিয়া লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর জাস্টিস (এআইএলএজে) সমস্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লাগাতার বিবৃতি প্রকাশ, প্রতিবাদ কর্মসূচি ও ওয়েবিনারের মাধ্যমে উৎসাহ জাগানো আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছ। আদালত অবমাননা আইনকে কাজে লাগিয়ে প্রশান্তভূষণকে চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আইনজীবী ও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ, পাশাপাশি কেন্দ্র ও কয়েকটি রাজ্যের প্রতিহিংসাপরায়ণ বিজেপি সরকারের, কর্মী সংগঠক আইনজীবী, চিকিৎসক ও ছাত্রদের নিশানা করা ও হেনস্থা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এবং উৎসাহব্যঞ্জক। এইসব প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে অর্জিত ছোট মাপের সাফল্যগুলি (প্রশান্তভূষণের আদালত অবমাননা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নিজের অবস্থান থেকে নেমে আসা, কাফিল খানের মুক্তি, দেবাঙ্গনা কলিতার, যাঁর ক্ষেত্রেও অভিযোগের যথেষ্ট ভিত্তি ছিল না, জামিন-আদেশ, তবলিঘি জামাত এবং কোভিড১৯-এর নামে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক নিশানা করাকে নাকচ করে বম্বে হাইকোর্টের রায় তার কিছু দৃষ্টান্ত) লক্ষ্য করা ও স্বাগত জানানোর পাশাপাশি, আমরা বিচারব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক চেতনার সামগ্রিক ও ধারাবাহিক ক্ষয় এবং কার্যনির্বাহী প্রশাসনকে সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ করার পরিবর্তে প্রশাসনের শীলমোহর হয়ে যাওয়ার প্রবণতাকেও আমরা লক্ষ্য করছি। কেন্দ্রীয় কমিটি, ভীমা কোরেগাঁও এবং দিল্লি হিংসা মামলায় তদন্তের নামে সংগঠক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের লাগাতার নিশানা করা ও কারারুদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়েছে।
(৫) বাঘজান তৈলক্ষেত্রের অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়ে সর্বস্ব খোওয়ানো, বাস্তুহারা মানুষদের দুর্দশা লাগাতার স্থানীয় প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার তাদের কষ্টের প্রতি চরম উদাসীন। বাঘজানের শিকার অসহায় মানুষদের জন্য আসাম ও তার বাইরে আমাদের বৃহত্তর সংহতি গড়ে তুলতে হবে। ইআই-বিজ্ঞপ্তি এবং নয়া শিক্ষানীতি ২০২০-র বিরুদ্ধেও আমাদের প্রতিবাদকে তীব্রতর করতে হবে।
খুব শীঘ্রই বিহার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, অতিমারী আর লকডাউননের এই বিশেষ সংকটের মধ্যেই। কেন্দ্রীয় কমিটি আমাদের সাংগঠনিক প্রস্তুতি এবং বিহারে বাম ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতা সংক্রান্ত প্রতিবেদন শুনেছে। এনডিএ প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে মানুষের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে রুখে দিতে ও ব্যাহত করতে মরিয়া। বড় বড় মিছিল এবং জনসভা যখন করা যাবে না, আমাদের তৃণমূল স্তরে নিবিড় প্রচারের শক্তিকে যথাসাধ্য কাজে লাগাতে হবে। কেন্দ্রীয় কমিটি সমস্ত রাজ্য ইউনিট, গণসংগঠন এবং কমরেডদের কাছে বিহার নির্বাচন প্রয়াসে মুক্ত হস্তে দানের আবেদন জানাচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটি তামিলনাড়ু কমিটিকে পার্টির বিহার নির্বাচনী প্রচারে ৫০,০০০ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ জানায়। কেন্দ্রীয় কমিটি আগামী বছরের প্রথমদিকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম (কার্বি আঙলঙ সহ) এবং তামিলনাড়ুতে অনুষ্ঠিতব্য বিধানসভা নির্বাচন সম্পর্কে তাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনও শুনেছে।
- প্রভাত কুমার, কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে