অনীক পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক দীপংকর চক্রবর্তী কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন। দীপংকরদাকে নিয়ে কবি বীরেন্দ্র কবিতা লিখেছেন, দীপংকরদাকে তাঁর বই উৎসর্গও করেছেন। দীপংকরদা তাঁর অনীক পত্রিকার জন্যে কবিতা চাইলে সেই প্রার্থনা মঞ্জুর বীরেন্দ্রকে করতেই হতো। আর জন্যেই আমরা অনীক-এর পৃষ্ঠায় বীরেনদার অনেক কবিতা পেয়েছি। অন্যদিকে দীপংকরদাও কবি বীরেন্দ্রকে আন্তরিকভাবেই শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর কবিতার ছত্র উদ্ধৃত করে তিনি বারবার ‘অনীক’-এর পৃষ্ঠায় তাঁর তথা অনীক-এর প্রতিবাদকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। কবিও তাঁর সাম্প্রতিক লেখা রাজনৈতিক কবিতা অযাচিতভাবেই পাঠাতেন অনীক-এ আর বলতেন অনীক ছাড়া এসব কবিতার যোগ্য জায়গা আর কোথায় পাবো? এভাবেই তিনি এই পত্রিকাটির ওপর তাঁর আস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।
কবি বীরেন্দ্র প্রয়াত হন ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুলাই বৃহস্পতিবার। সেই জুলাই মাসের অনীক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত হয়েছিল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে লেখা বীরেনদার সেই বিখ্যাত কবিতা জন্মভূমি আজ । আর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সম্পাদক স্বয়ং লিখেছিলেন ‘কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ শীর্ষক সম্পাদকীয়। সেই সম্পাদকীয়তে দীপংকরদা বীরেনদার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন :
বীরেনদা আমাদের কবি ছিলেন, আমাদের অর্থাৎ তৃতীয় শিবিরের। গদির সুখ পাওয়া এক বাম রাজনৈতিক দলের অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সত্ত্বেও, বীরেনদা লেখেন :
আজ তোমরা রাজত্ব পেয়েছো/ আর তিন রাত্তির না ফুরুতেই/ তোমাদের মুখের চেহারা গেছে বদলে—/ যা ছিলো একদিন সূর্যের কাছে প্রার্থনা/ এখন তা গা-ছমছম ভূতের ভয়!
এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে অনীক-সম্পাদক আরও লিখেছিলেন : প্রথাগত ‘বাম’পন্থার ব্যর্থতা কবি বীরেন্দ্রকে যে অবস্থানে আসীন করেছিল তাকে ‘ধান্ধাবাজ বামপন্থী’রা বলতেন উগ্রপন্থা। রক্তাক্ত, দুঃসাহস প্রদর্শনের এবং এক মুক্ত ভারতের স্বপ্নে উদ্বেল তারুণ্যের হাসিমুখে আত্মবলিদানের সময় কবি বীরেন্দ্র সেই নির্ভীক তারুণ্যের মধ্যেই তাঁর প্রত্যাশিত স্বপ্নের নবজন্ম দেখে কলমের আয়ুধ হাতে পথে নেমে এসেছিলেন সমস্তরকম ভয়ভীতি উপেক্ষা করেই। এই সময়েই কবি উপলব্ধি করেছিলেন যে আগুন ছাড়া ভালোবাসা মিথ্যে বই আর কিছু নয়।
অনীক পত্রিকার পরের সংখ্যাতেই (অর্থাৎ অগাস্ট ১৯৮৫) আবার ‘বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণে’ আরও একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংখ্যাটি ছিল কবি বীরেন্দ্র স্মরণ সংখ্যা। এই সংখ্যায় দীপংকরদা ‘সমকালের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর’ শিরোনামায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন কবিকে নিয়ে।
দীপংকরদার মুখে একটা কথা অনেকবারই শুনেছি। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় আনন্দবাজার পত্রিকার কর্তৃপক্ষকে শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে হঠাৎ ব্যস্ত হতে দেখা গিয়েছিল। সে সময় এই পত্রিকার তরফে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই চীন-বিরোধী প্রচারের লক্ষ্যেই ধারাবাহিকভাবে পশ্চিমবাংলার লেখক-বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে শিল্পীর স্বাধীনতা রক্ষার নামে চীনকে আক্রমণকারী বলে চীন-বিরোধী উগ্রজাতীয়তাবাদের প্রচার শুরু হয়েছিল। আমাদের তৎকালীন পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা এই শিল্পীর স্বাধীনতা রক্ষার নামে চীন-বিরোধী জিগিরে সামিল হয়েছিলেন। এই দলে কবি বীরেন্দ্রও নাম লিখিয়েছিলেন। পরে কবি বীরেন্দ্র নিজের ভুল বুঝতে পেরে একটি দৈনিক সংবাদপত্রে ধারাবাহিকভাবে নিজের ভুল স্বীকার করে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এমনকি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দেও তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন :
ভারত-চীন সংঘর্ষের সময় আমি যে-সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলাম, তাকে এখন সম্পূর্ণ-ই ভ্রান্ত মনে করি।
— এই হলেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সেই ঘটনার ৬৮ বছর পর বর্তমান দেশের ফ্যাসিস্ত সরকার পুনরায় দেশের জনসাধারণের অসমাধেয় সমস্যাবৃদ্ধির মুখে দাঁড়িয়ে এই করোনাকালেও আবার চীন-বিরোধী জিগির তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এখনও অবশ্য শিল্পীর স্বাধীনতা রক্ষার দাবি সামনে এনে হাজির করায়নি কেউ, তবে তেমন সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। বিশেষত বিহার-পশ্চিমবাংলার মতো আসন নির্বাচনে চীন-বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিস্তদের খুবই কাজে আসতে পারে।
১৯৭৫-এর ২৫ জুন থেকে ১৯৭৭-এর ২১ মার্চ পর্যন্ত জারি ছিল ইন্দিরা শাহির আমলের জারি করা কুখ্যাত জরুরি অবস্থা। এরপর নির্বাচনের মুখে বন্দিমুক্তির দাবি সামনে চলে আসে। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সেসময় প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা ক্ষমতায় এলে বন্দিমুক্তির ব্যবস্থা করবে। এই বন্দিমুক্তির দাবিতে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সামিল হয়েছিলেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং। এখানে একটি তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে। গত শতকের সত্তরের দশকে কবির আত্মজ নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বিপদাপন্ন হয়েছিলেন। কবি নিজে নকশালপন্থার সমর্থক না হওয়া সত্ত্বেও নকশালপন্থীদের মধ্যে তাঁর প্রার্থীত স্বপ্নের মুক্তির সন্ধান পেয়েছিলেন। তাই আত্মজের এই রাজনীতির সম্পৃক্ততার জন্য নিজে কখনো রুষ্ট হননি। বরং সেই সত্তরের কালো দিনগুলিতে আত্মজের বিপন্ন অবস্থায় তাদের দলীয়দের কাছে গিয়ে তার আশ্রয়ের প্রার্থনা করে সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন! শেষপর্যন্ত এক ‘অনুজ কবির প্রশ্রয়ে’ আশ্রয় মেলায় কবি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। — এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সাধারণত নকশাল-দরদি ব্যক্তিরও নকশালপন্থীদের প্রতি বৈরূপ্য প্রদর্শনের মনোভঙ্গি গ্রহণ সঙ্গত ছিল। কিন্তু কবি বীরেন্দ্র সেপথে হাঁটেননি। সংবেদনশীল কবি তাঁর বিপন্ন আত্মজকে আশ্রয় দিতে না-পারার কারণ যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে তিনি এই নকশালপন্থীদের প্রতি বিরূপ হননি। তিনি এতটাই বড়ো মনের মানুষ ছিলেন।
সাতাত্তরের নির্বাচনে কংগ্রেসি শাসনের পতন এবং বাম জমানার অভ্যুদয় হওয়া সত্ত্বেও এই বন্দিমুক্তি আন্দোলন অব্যাহত ছিল কেননা বন্দিমুক্তি নিয়ে অনেক টালবাহানা চলেছিল। এই সময় বন্দিমুক্তি হবে এই প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে কবি বীরেন্দ্র প্রশ্ন তুলেছিলেন :
হবে
কিন্তু মহাশয়, কবে?
এইসময় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে নকশালপন্থীরা কবি বীরেন্দ্রর সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকেন। কবি তাঁদের কাছে হয়ে ওঠেন ‘আমাদের কবি’। চতুর্থ এবং পঞ্চম ট্রাইবুনালের বন্দিরা যথাসময়ে মুক্তি না পাওয়ায় কবি বীরেন্দ্রর উদ্বেগের অন্ত ছিলোনা। তিনি সেইসব বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। সুযোগ আসতেই তিনি আলিপুর কোর্টে গিয়ে বন্দিদের সঙ্গে দেখা করেন। বন্দিরাও খুশিতে উদ্বেল। কবি স্বয়ং এসেছেন তাঁদের দেখতে, তাঁরা অনেকে কৃতজ্ঞতা ও আবেগে কবির হাত স্পর্শ করেন। বাড়ি ফিরে এসে কবি লিখেছিলেন :
আমি অনেক যুবককে একত্র হতে দেখেছি
জলসায়, খেলার মাঠে, সভায়, মিছিলে, মনুমেন্টের নীচে —
কিন্তু কখনো জীবনের ঐকতানকে, এতো গভীর প্রেমের মতো অনুভব করিনি।
এতগুলো বছর পর এখনও আবার এক বন্দিমুক্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়া সত্ত্বেও দেশের বর্তমান ফ্যাসিস্ত সরকার ক্রমাগত তার অপছন্দের লোকজনকে একের পর এক মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার করে চলেছে। অশীতিপর এবং অসুস্থ কবি ভারভারা রাও সহ বিভিন্ন স্থরের প্রতিবাদী কণ্ঠ রুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এই সরকার অতীতের অনেক রেকর্ড ম্লান করে দিয়েছে। আইনজীবী, অধ্যাপক, সাংবাদিক, ছাত্র, ডাক্তার, বিজ্ঞানী সহ প্রতিবাদকারিদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে ডেকে নিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কিম্বা গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে সরকারের বশীভূত করার ফ্যাসিস্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে! এই দুষ্কর্মের কোনোরকম প্রতিবাদকেও গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। আশি বছরের অসুস্থ কবি ভারভারা রাও সহ তাঁর সহবন্দিদের মুক্তির অনুরোধ জানিয়ে দেশ এবং বহির্দেশের বিভিন্ন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের পাঠানো আবেদনপত্রকেও এই সরকার এবং তার বিচারব্যবস্থা গুরুত্ব না দিয়ে ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেছে। এমনকি বন্দি কবি ভারভারা রাওয়ের জামাইকেও সম্প্রতি এলগার পরিষদ কেসে শমন পাঠিয়েছে সরকার-পোষিত এনআইএ। পশ্চিমবাংলার এক তরুণ বিজ্ঞানীকেও এনআইএ ডেকে পাঠিয়েছে। এমনকি একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন কবির কলা মঞ্চ-এর তিনজন সদস্যকেও এনআইএ ডেকে পাঠিয়ে তাদের নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে! কোনরকম প্রতিবাদকে এই সরকার বরদাস্ত করতে রাজি নয়। সম্প্রতি এক ছবিতে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি কবি ভারভারা রাও-কে দেখা গেল কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের এক বামপন্থী পুস্তক প্রকাশকের ঘরে। সময়টা ছিল ১৯৮৫, কবি বীরেন্দ্রর প্রয়াণের অবব্যহিত পরের ঘটনা। জানা গিয়েছে কবি ভারভারা রাওয়ের অন্যতম প্রিয় কবি ছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আজ সেই কবির বয়স আশি। তিনি আজ কারান্তরালে। আর কবি বীরেন্দ্রর এটাই জন্মশতবার্ষিকী বছর। এক অদ্ভুত সমাপতন।
কবি বীরেন্দ্র সরাসরি প্রতিবাদের রাস্তায় যেতে পছন্দ করতেন। বিলম্বিত অথা প্রলম্বিত প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁর আস্থা খুবই কম ছিল। আর এর ফলেই দেখেছি সত্তরের দিনগুলিতে যখন প্রায় সবাই ঘরের নিভৃত আশ্রয়ে ঢুকে পড়েছেন প্রতিবাদ শব্দটিকে অভিধান থেকে অবসৃত করে, তখন তিনি এক দুঃসাহসে ভর করেই রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁর প্রতিবাদের আয়ুধ হাতে নিয়েই। এসময়ে তিনি সময়ের দাবি মেটাতে এমন অনেক কবিতাই লিখেছেন যা আদতে কবিতা পদবাচ্য হতে পারে না। কবি একথা জানতেন। নিজে উত্তরকালে স্বীকারও করেছেন। তবে বলেছেন যে সময়ের দাবিই তাঁর কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছিল।
কবির জন্মশতবর্ষে আমরা কি সময়ের দাবির প্রতি কবির মতো দায়বদ্ধ হতে পারি না?
-- অশোক চট্টোপাধ্যায়
সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০