গত সপ্তাহে, লোকসভায় কৃষি সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিল পাস হলো, তাও ধ্বনি ভোটের মারফত। এই বিলগুলি হল,
এদের মধ্যে তিন নম্বর বিলটি হল পুরোনো বিলের সংশোধনী।
লোকসভায় যবে থেকে বিলগুলি এসেছে, তবে থেকেই, ভারতের কৃষিসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কৃষক সংগঠনগুলি, বিশেষত সবুজ বিপ্লব বেল্টর বড় কৃষক সংগঠনগুলি এই বিলগুলি বাতিল করার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। আড়াই শতাধিক কৃষকের সংগঠন অনশন কর্মসূচীতে ধর্নায় বসেছে।
ক্ষমতাসীন জোটের শরিকদের মধ্যেও তিনটি বিল বিভেদ সৃষ্টি করেছে। শিরোমণি আকালি দল থেকে নির্বাচিত সাংসদ ও সরকারের শরিক হরসিমরাত কৌর বাদল, তাঁর মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। আসুন এই বিলগুলোকে এক এক করে আলোচনা করা যাক।
১) The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill, 2020
এই বিলের প্রভাব বোঝার জন্য প্রথমে আমাদের এপিএমসি (কৃষি উত্পাদন বাজার কমিটি) আইনটা বুঝে নিতে হবে। কারণ এই নতুন আইনটা রাজ্যগুলির এপিএমসি আইনগুলোকে সরিয়েই প্রণীত হবে।
এপিএমসি (Agricultural Produce Market Committee) হল রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত আড়ৎ। এখানে কৃষকরা লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্টদের কাছে বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারেন। বর্তমানে, সারা দেশে এই মুহূর্তে এরকম ২,৪৭৭ খানা প্রধান আড়ৎ রয়েছে। এছাড়া এদের নীচে রয়েছে ৪,৮৮৩টি সাব-মার্কেট ইয়ার্ড। এই প্রণালীর মাধ্যমে, রাজ্য সরকারগুলি কৃষিক্ষেত্রের বাজার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে কৃষকরা তাঁদের উৎপাদনের যথাযথ মূল্য থেকে বঞ্চিত না হন। এই বাজারগুলি সরকারী খাদ্যশস্য কেনার নোডাল পয়েন্ট হিসেবেও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কথা ঠিক যে এই আড়ৎগুলোকে কেন্দ্র করে নানা রকম দুর্নীতির চক্র গড়ে উঠেছে।
কিন্তু, সেই সমস্যা প্রতিকার করার চেষ্টা না করে সরকার এই আইন দিয়ে আড়তের এই দেশব্যাপী নেটওয়ার্কটাকেই ভেঙে দিতে চলেছে। নতুন এই আইন লাগু হলে একজন ব্যবসায়ী দেশের যেকোনো প্রান্তে গিয়ে যে কোনও কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনতে পারবেন। বাজারের নিয়ম মেনে নির্ণীত হবে পণ্যের মূল্য। এখন কথা হলো এসব শুনতে বেশ ভালো লাগে। কিন্তু আপনিই ভেবে দেখুন যে ক্রেতা যদি বহুজাতিক কর্পোরেট হয়, আর বিক্রেতা যদি হন জনৈক প্রান্তিক চাষি, তাহলে ডিমান্ড সাপ্লাই এর কি হবে?
এদেশে এই মুহূর্তে মোট কৃষি জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ হলেন ছোট বা মাঝারি কৃষক। এখন কোনো বিদেশী বা দেশি বহুজাতিকের সাথে দরদাম করে পণ্যের দাম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাদের কী অবস্থা হবে তা নিশ্চয়ই বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না।
আরেকটা জরুরি কথা। বর্তমানে এই এপিএমসিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজ্য সরকার। এই বিল লাগু হলে তা আর থাকবে না। তার মানে ন্যূন্যতম সমর্থন মূল্য বা MSP থেকে শুরু করে খাদ্য শস্য অধিগ্রহনের যাবতীয় অধিকার – সবই রাজ্য সরকারের এক্তিয়ার থেকে বেড়িয়ে কিছু মুষ্টিমেয় বহুজাতিকের কুক্ষিগত হবে।
২০১৪ সালে, তার একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বিজেপি নেতারা বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় এলে তাঁরা কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার ব্যবস্থা করবেন। যাবতীয় চক্ষুলজ্জা হারিয়ে আজ কৃষকদের ন্যূন্যতম অধিকারও কেড়ে নিতে তৎপর।
প্রধানমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলেছেন যে, নতুন আইন লাগু হলেও এমএসপি, এপিএমসি এগুলো তাদের নিজের জায়াগাতেই থাকবে। সেগুলোকে সরানো হবে না। ডাঁহা এবং নির্জলা মিথ্যা। আপনিই ভেবে দেখুন যখন কর্পোরেট ক্রেতারা কৃষকদের কাছ থেকে অবাধে মাল কেনার ছাড় পাবেন, তখন এমএসপি বা এপিএমসি’গুলির কী পরিণতি হবে!
সরকারের তরফ থেকে আরো বলা হচ্ছে যে এই বিল, অবাধ লেনদেনের পথে বাধা সৃষ্টিকারী যাবতীয় প্রাচীনপন্থী আইনকে সরিয়ে দেবে, যার ফলে কৃষকদের আয় বাড়াবে। বাস্তব যদিও এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে। ২০০৬ সালে, বিহারের এনডিএ সরকার তাদের রাজ্য এপিএমসি আইন বাতিল করে দেয়। তার ফল কি হল? আজ, দালালদের একটি বিশাল তন্ত্র বিহারের স্থানীয় বাজারগুলি থেকে শস্য সংগ্রহ করে তা অন্যান্য রাজ্যের এপিএমসিকে বেশি দামে বিক্রি করে। মানে কি হলো? একদিকে এপিএমসি অপসারণের ফলে, কৃষকরা খোলা বাজারের আড়ৎ মাফিয়াদের সামনে একদম অরক্ষিত হয়ে পড়লেন, আয় তো তাদের কমলই, উল্টো দিকে দুর্নীতির একটা নতুন তন্ত্র উন্মোচিত হল।
তার মানে সহজ ভাষায় বললে, সারা দেশের কৃষক এখন এই একই সংকটের মুখে পড়তে চলেছেন।
২) The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement of Price Assurance and Farm Service.
এই আইনটি কৃষকদের সরাসরি নানাবিধ কৃষি ‘স্পনসর’দের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবার অনুমতি দেয়। (বাংলায় নীল চাষ এই রকমভাবেই শুরু হয়েছিল। তারপর যেটা হয়েছিল, সে ইতিহাস আমাদের জানা।) ভেঙে বললে এই আইন অনুযায়ী এবার চুক্তিবদ্ধ হলে কৃষকরা তাদের ‘স্পনসর’দের চাহিদা ও ইচ্ছা মতো চাষ করতে বাধ্য থাকবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই কায়দায় ‘সরাসরি চুক্তি’র মারফত ক্রেতা বিক্রেতাকে কাছাকাছি আনার চেষ্টা হয়েছে, এবং তার ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ। স্থানীয় খাদ্যাভাস থেকে মাটির উর্বরতা, জল স্তর থেকে স্থানীয় পোকামাকড়ের জীবনচক্র এমনকি বাস্তুতন্ত্রকে পাকাপাকিভাবে বিষিয়ে দিয়েছে বহুজাতিক কর্পোর্রেটদের লোভ।
এবার আসুন দেখা যাক যদি কোনো আইনি বিবাদ হয় তাহলে কি হবে? কারণ আইনি চুক্তি হলে আইনি বিসম্বাদ ও থাকবে। কোনো আইনি মতবিরোধ দেখা দিলে কি হবে?
আন্তর্জাতিক স্তরে কৃষি বহুজাতিক কর্পোরেটদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। বিপুল অর্থের মালিক এই সংস্থাগুলির প্রধান শক্তি হচ্ছে এদের পোষা উকিল বাহিনী। কোনো আইনি বিবাদ দেখা দিলে এই সুশিক্ষিত উকিল বাহিনীর আইনি মারপ্যাঁচের সামনে এক সাদামাটা প্রান্তিক বা মাঝারি কৃষক কি করে টিকবেন? সারা পৃথিবীতে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যেখানে সাদামাটা কৃষকেরা এই বহুজাতিকদের আইনি প্যাঁচে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন।
এই আইন ভাগচাষি ও ভূমিহীন কৃষকদের অবস্থা আরও দুর্বিষহ করে তুলবে। কোনও আইনী সুরক্ষা না থাকলে ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকদের উচ্ছিন্ন হবার ঘটনা বাড়বে বই কমবে না।
৩) Essential Commodities (Amendment) Bill
মূল আইন ১৯৫৫ সালে পাস হয়। পরাধীন ভারতের একের পর দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দিয়েছিলো, যে মজুতদারী আর কালোবাজারি বন্ধ না করলে, কোনো ভাবেই আমাদের দেশে সবার জন্যে সুলভে খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব নয়। এই বোধ থেকেই ১৯৫৫ সালের ইসিএ বা এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট, খাদ্যশস্যের মজুত রোধে রোধে কার্যকর পদক্ষেপ ছিল।
নয়া-উদারপন্থী অর্থনীতিবিদদের একটা দল বেশ কিছুদিন ধরে এই কুতর্ক চালাচ্ছেন যে আজ আমাদের দেশে এই আইনের কোনো প্রয়োজনা আর নেই। কারণ খাদ্য সংকট মিটে গেছে। এই লাইনেই আরেক পা এগিয়ে বর্তমান আইনকে সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সংশোধনীতে বলা হয়েছে যে বর্তমান আইনটি শুধুমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির মতোই বিশেষ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে ব্যবহৃত হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও এই কথা বলা হয়েছে যে আমাদের দেশ কৃষি ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে এবং আজ আর এই আইনের প্রয়োজনীয়তা নেই।
এই যুক্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রথমত আমাদের দেশে ক্ষুধার্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তারমানে খাদ্য শস্যের বন্টন প্রণালীতে মজুতখোরদের উপস্থিতি সমেত আরও গাফিলতি আছে। তাছাড়াও, আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদন এখনো মৌসুমি বায়ু সহ নানাবিধ শর্তের উপর নির্ভর করে। বাজারে কৃষিপণ্যের লভ্যতাও অনেকাংশে এইসব ঘটনার উপর নির্ভর করে। জাতীয় পরিস্থিতিতে, আইনটির প্রস্তাবিত লাঘবকরণ কেবল বড় ব্যবসায়ী এবং তাদের মাফিয়াকেই মজবুত করবে।
অর্থনীতিবিদদের একটি বিশেষ অংশ প্রায়ই এই যুক্তি দেন যে পুরো কৃষি সেক্টরটিকেই অবাধ বাণিজ্যের আওতায় আনা উচিত। তাঁরা বলেন যে ‘বাজার-বিরোধী’ বাধা ও সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপগুলি আসলে কৃষিক্ষেত্রে উন্নতির প্রধান অন্তরায়।
তবে, এই অর্থনীতিবিদরা যে বিষয়টি উল্লেখ করতে ভুলে যান, এমনকি আমেরিকার মতো সচ্ছল দেশগুলিতেও তাদের কৃষিক্ষেত্র রক্ষায় বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি ব্যয় করে।
প্রশ্ন উঠতেই হবে তাহলে সারা দেশের কৃষিক্ষেত্রকে ধ্বংসের সামনে নিয়ে গিয়ে লাভটা কার হবে?
কারণগুলি খুঁজে বের করা খুব কঠিন নয়। বর্তমান সরকার, ক্ষমতায় আসার প্রথম দিন থেকেই তার নির্বাচনী স্পনসরদের সেবা দেওয়ার জন্য সত্যই কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে। এটি কারুর জানতে বাকি নেই যে বর্তমান নেতৃত্বে বিজেপি নির্বাচনী ব্যয়ের সমস্ত রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। প্রায় খবরের সবকটি কাগজ ও চ্যানেল তারা কিনে ফেলেছে। এই বিপুল অর্থ তারা পেলো কোত্থেকে? বা যারা বিজেপিকে তাঁদের তেজরতি খুলে চাঁদা দিয়েছেন বা দিচ্ছেন তারা এর বদলে কি চান? অতি বৃহৎ পুঁজিপতিদের একটা ছোট কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী গোষ্ঠী প্রথম থেকেই এই সরকারের জন্যে আর্থিক এবং রাজনৈতিক সাহায্য দিয়ে আসছেন। আম্বানি ও আদানি গোষ্ঠীর বিশেষভাবে সরকার ঘনিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারটা কারুরই অজানা নয়। ঠিক যেমন অজানা নয় চাঁদা দেওয়ার বিনিময়ে একের পর এক বিশেষ সুবিধা তাঁরা এই সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন। এবং ইদানিংকালে মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এবং গৌতম আদনির মালিকানাধীন আদনী গোষ্ঠী তাদের কৃষি এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলিতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করছে।
- বিস্ময় বসু