চিকিৎসা যখন মহার্ঘতম পণ্য
carr

আলো আঁধারিতে সময়ের এক অদ্ভুত সুড়ঙ্গ পেরোচ্ছি আমরা। কোভিড সংক্রমণের বলি একান্ত প্রিয়জনকে শেষ দেখার উপায়টুকুও হয়তো থাকছে না। যাঁর প্রাণরসে পুষ্ট হওয়া কিংবা যার হাতে হাত রেখে জীবনের বহু চড়াই উতরাই পেরোনো, বা ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল দিনে যার সঙ্গে মিছিলে পা মেলানো, উদ্দাম বিতর্কে জড়িয়ে পড়া — সেই সব প্রিয়জন! এটা আজ এক বেদনাদায়ক অনিবার্যতা।

কিন্তু স্বঘোষিত এক ‘সেরা’ হাসপাতালে এসে অ্যাম্বুল্যান্সে শায়িতা গর্ভধারিণীকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে যেতে দেখা? ৮০,০০০ টাকা দিয়ে কয়েক ঘন্টা আগে বেড বুক করার পরেও? এটাও কি অনিবার্যতা?

হ্যাঁ, তমলুকের নাজিম খানের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তাই-ই। ভর্তির মুহূর্তেই তিন লক্ষ টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না — এটা জানিয়ে পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলেন। তাতেও অনড় কর্তৃপক্ষের নির্বিকার জবাব ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’! অনন্যোপায় নাজিম আবু ধাবিতে কর্মরত দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও দু'লক্ষ টাকা জমা করেন হাসপাতালের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। তাতেও হয়নি। হোয়াটস অ্যাপে সেই লেনদেনের ছবি দেখাতে বলা হয়। এরপর চিকিৎসক এসে অ্যাম্বুল্যান্সে শোয়ানো লায়লা বিবিকে যখন সিপিআর দেন — তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ। কল্লোলিনী তিলোত্তমা সাক্ষী রইলো এক জঘন্য অপরাধের। শুধু তাই নয় — এক নির্মম বাস্তবতার!

স্বাস্থ্য দপ্তরের কড়া হুঁশিয়ারি ছিল — কোভিড রোগীকে ফেরানো যাবে না। স্বাস্থ্য কমিশনের নির্দেশ রয়েছে — কোভিড-রোগী ভর্তির সময় ৫০,০০০ টাকার (চিকিৎসার আনুমানিক খরচের ২০%) বেশি নেওয়া যাবেনা। ভর্তির সময় টাকা না থাকলে, অন্তত ১২ঘন্টা রোগীকে পরিষেবা দিতে হবে। রোগীকে চিকিৎসার মাধ্যমে স্থিতিশীল করে তবে অন্যত্র পাঠানো যাবে। এসব নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চলেছে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসা, যেখানে চিকিৎসা একটা মহার্ঘ পণ্য মাত্র।

নাজিম খান এসেছিলেন অনেক আশা নিয়ে — কোভিড আক্রান্ত মা-কে সেরা চিকিৎসায় বাঁচিয়ে তুলতে। ফিরে গেলেন মাকে হারিয়ে লাঞ্ছিত, অপমানিত, বিপর্যস্ত হয়ে। টাকা তো গেছেই। কিছুই জানা ছিল না তার। সরকারি হেল্পলাইনও নয়। শুভানুধ্যায়ীদের কথায় এসেছিলেন, ‘পূর্ব ভারতের সেরা দশটি হাসপাতালের অন্যতম’ একটিতে। ডিসান হসপিটাল অ্যান্ড হার্ট ইন্সটিটিউট-এ। ২০০৮-এ যাত্রা শুরুর তিন বছরের মধ্যে যার মিলেছে এনএবিএইচ এবং তারপর এনএবিএল স্বীকৃতি। দশ তলা সুউচ্চ সৌধের দম্ভও অভ্রংলিহ! অত্যাধুনিক পরিকাঠামো, ‘বিশ্বমানের পরিষেবা’, শুধু নাকি ধনীদের জন্যই নয়, ‘গরিব এবং সাধারণ মধ্যবিত্তের’ জন্যও! এই কথাগুলো বোধ হয় সরকারি স্বীকৃতি শংসাপত্রগুলো হাতিয়ে নেওয়ার জন্যেই বলতে হয় — আসলে শুধুই কথার কথা! নাজিম অন্তত তাই-ই জেনে গেলেন! নিশ্চয়ই আরো অনেক ভুক্তভোগীই ইতিমধ্যে জেনেছেন।

শুধু তো ডিসান নয়, কলকাতায় বেসরকারি ২৬টি কোভিড হাসপাতালের মধ্যে আরও কয়েকটির নামও উঠে এসেছে। কোভিড আক্রান্তের চিকিৎসায় অস্বাভাবিক বিল করা, টাকা আদায়ের জন্য রোগীর পরিজনদের সঙ্গে অমানবিক ব্যবহারের অভিযোগে। দিনকয়েক আগে শহরের আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে (মেডিকা) শ্যামনগরের দরদী এক কোভিড আক্রান্ত চিকিৎসক প্রদীপকুমার ভট্টাচার্য প্রয়াত হয়েছেন। চিকিৎসার বিল হয়েছিল ১৮ লক্ষের বেশি। স্থানীয় অনেক সংগঠন বিল কমানোর অনুরোধ জানায়। ব্যতিক্রমী এই চিকিৎসকের পরিবারের পাশে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন বহু মানুষ তাদের মধ্যে অনেকেই তাঁর চিকিৎসাধন্য হতদরিদ্র মানুষজন। অবশেষে স্বাস্থ্য কমিশনের হস্তক্ষেপে বিল কিছুটা কমে। তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। বেসরকারী এই স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা এতটা বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পায় কেন? সরকারের নির্দেশগুলোও কি নেহাতই কথার কথা? কেন উপযুক্ত নজরদারি নেই? অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেই? ‘কেন নেই’ সকলেই জানেন। আইন প্রশাসন বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী সকলের আনুকূল্যেই ব্যবসা এমন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকে উদারীকরণের হাওয়ায় বাইপাসের ধারে গজিয়ে উঠেছিল বেসরকারী চিকিৎসা ‘হাব’। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে উঠে আজ তা মহীরূহ — নাগালের বাইরে চলে গেছে।

নাজিম ডিসান হাসপাতালের বিরুদ্ধে আনন্দপুর থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য কমিশনও মামলা রুজু করেছে। আমরা চাই এই খুনীদের উপযুক্ত বিচার ও শাস্তি হোক। মুখরক্ষার জন্য শুধু দু’একজন কর্মচারিকে বরখাস্ত বা হাজতবাস করিয়ে কর্তৃপক্ষ যেন পার না পায়! কর্মচারিরা তাদের আজ্ঞাবহ মাত্র। সমস্ত সরকারী স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়া হোক। এবার অন্তত সরকার সতর্ক হোক যাতে লায়লা বিবির মতো আর কাউকে এইভাবে হারাতে না হয়!

কিন্তু তারপরেও কথা থাকে। গরিব এবং সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য সুলভ চিকিৎসা মিলতে পারে একমাত্র সরকারি ব্যবস্থাপনায় সরকারি হাসপাতালে, যদি সত্যিই সরকারের সেই সদিচ্ছা থাকে। সেই সদিচ্ছাটুকু আছে কিনা এটাও একটা প্রশ্ন!

– জয়ন্তী দাশগুপ্ত  

খণ্ড-27
সংখ্যা-29