মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’ গল্পের প্রথম দৃশ্যেই মৃত্যুঞ্জয় প্রথমবার রাস্তায় একজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিল, যা তাকে উত্তেজিত করে তোলে, তাকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে সে মৃত্যুর সর্বোচ্চ ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে পায়; চিত্র পরিচালক জন আব্রাহামের ‘আম্মা আরিয়ান’ সিনেমাটিতে পুরুষাণ নামের একটি ছেলে স্কলারশিপ পেয়ে দিল্লি যাওয়ার পথে রাস্তায় একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখে, মুখটা বেশ চেনা চেনা। সে জানতে পারে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে, কাজেই সেই মুহূর্তের পর পুরুষাণের মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করতে থাকে, তাকে যেন কিছু একটা করতেই হবে, মৃত ছেলেটির মা-কে বিষয়টা জানাতেই হবে, না হলে শান্তিতে থাকা যেন কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। পুরুষাণ বেরিয়ে পড়ল।
ভারতবর্ষে বেশ কিছু সময় ধরে শিক্ষার বেসরকারীকরণের বিরোধিতায় এক বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলন চলছে। এই সিনেমাটির একটি দৃশ্যে দেখানো হয় মেডিকেল স্টুডেন্টদের আন্দোলন চলছে, সেখানে একটি পোস্টারে লেখা “আমরা শিক্ষাব্যবস্থার বাণিজ্যকরণের বিরুদ্ধে, আমাদের লড়াই সেই সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে যা পুঁজিবাদকে সাহায্য করে”- এ থেকে বোঝা যায় এই লড়াই সমগ্র দেশজুড়ে বহুকাল ধরেই চলছে। আর একদিকে পুরুষাণ লড়াই চালিয়ে যায় যদি মৃত ছেলেটির পরিচয় জানা যায় -- এক-দুজন যাকে সম্ভব তাকেই ধরেই মর্গে নিয়ে যাচ্ছে, কারণ ছেলেটি কে তা জানতেই হবে!
নাম জানা গেল। ছেলেটির নাম হরি, তবলা বাজায়, বেশ লম্বা ছিপছিপে চেহারা, শান্ত প্রকৃতির। নাম যখন জানা গেছে এবার তার মাকে খবরটাও দিতে হবে।
“ফ্রি! ফ্রি! নেলসন ম্যান্ডেলা!” বলে শ্লোগান দিতে দিতে বেশ কিছু ছেলের দল একটি কামরার ভেতরে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে ফিজিক্যাল অ্যাক্ট করে যাচ্ছে এবং আরেকজন একটি টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে তাদের সাথে গলা মেলাচ্ছে। একের পর এক আরো কিছু মানুষ জড়ো হলো পুরুষাণের সাথে, যারা কমবেশি যেটুকু জানে হরির ব্যাপারে। তারপর তারা ছোট একটা ডকে আরো একজনের কাছে গেল, সেখানে জেলেরা পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার মারছে জায়গায় জায়গায়, প্রতিটা বর্গ এক একটা আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে যেন।
জন আব্রাহাম হলেন চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র, ‘অডিসা কালেক্টিভ’ নামক একটি মুভমেন্ট শুরু করেন এক উন্নত সমাজ ব্যবস্থার লক্ষ্যে, ঘটকের মতন তিনিও মার্কসবাদে বিশ্বাস রাখতেন, তাঁর এই ‘আম্মা আরিয়ান’ ছবিটির দৃশ্য, দৃশ্যে ব্যবহৃত শব্দ, দ্বন্দ্ব তাঁর এই ফিলোসফির প্রতিফলন মাত্র। সাধারণ মানুষের ওপর পুলিশের অত্যাচার কি পর্যায়ে চলে গেলে একজন মহিলা অচেনা কাউকে দেখলেই নিজের ভাইকে আর ঘর থেকে বেরোতে দেয়না, ভয় পায় যদি পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলে, ভয় পায় যেটুকু মানসিক ভারসাম্য রয়েছে সেটুকুও যদি সে হারিয়ে ফেলে! কাজেই তার ভাইয়ের আর পুরুষাণ ও অন্যান্যদের সাথে মিলে ‘আম্মি’কে খুঁজতে বেরোনো হলো না।
হরিকে পুলিশ তার এক পরিচিতের বাড়িতে গ্রেপ্তার করতে এলে এক মহিলার ব্যাপারে কু-মন্তব্য করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখে একটা সপাটে থাপ্পড় মারলে ঠিক যে রকম আওয়াজ হয়, তেমনিই আওয়াজ হয়েছিল যখন হরি ওই পুলিশ অফিসারটিকে থাপ্পর মারে, যার ফলস্বরূপ তার সমস্ত আঙ্গুলগুলো ভেঙে দেওয়া হয়।
স্টেট সবসময় মানুষের সেটুকুই স্বাধীনতা পছন্দ করে, যতটুকুতে তাদের কোনো ক্ষতি হয় না। এই ভারত বর্ষ ৭৪% শ্রমিকশ্রেণীর দেশ, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এখানে শ্রমিকদের হাতে কোনো ক্ষমতাই নেই, তাদের জীবনের সুরক্ষা বলেও কিছুই নেই, দুবেলা ঠিকমতো পেট ভরে খেতে পারবে কিনা সেটাও জানেনা, আর নিজেদের অধিকারের কথা বললে বা প্রশ্ন করলে নকশাল-আদিবাসী বলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জেলে ভরে দেওয়া হয়, নির্মম অত্যাচার করা হয়। ঠিক এরকম ঘটনাগুলোই জন তাঁর সিনেমাটিতে সোজা সাপটাভাবে দেখিয়েছেন, তাদের সংগ্রাম, আন্দোলনের কথা বলেছেন। একটি দৃশ্যে দেখা যায় শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলছে আর অপরদিকে স্টেটের পুলিশ এবং গুন্ডারা তাদের ওপর কিভাবে হামলা চালাচ্ছে। তবে সংগ্রাম থামানো কোনদিন যায়নি।
আমার মনে আছে ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ সিনেমাটির একটি সংলাপ ঘটক বলছে, “We are confused, utterly confused”. এই হরি চরিত্রটিও আলাদা কিছু ছিল না- একদিকে রক মিউজিক চলছে, আর ও হাতে চে-র বই নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে -- ক্যামেরা ধীরে ধীরে প্যান করল চলে থেকে মার্ক্স, মার্ক্স থেকে চেয়ারম্যান মাও-এর দিকে, যা স্পষ্ট করে দেয় তখনকার র্যাডিক্যাল লেফট পলিটিক্সের কথা।
থানায় বোম পড়ল, পুলিশ তো ভয়ে আর থানা থেকে বেরোচ্ছে না, হরি এবং তার সাথীরা বন্দুক লুট করেছে। বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে তখন এই একই চিত্র।
‘আম্মা আরিয়ান’এ বইয়ের পাতা খুলে প্রশ্ন করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বুদ্ধিজীবীগণ কী লেকচার দিয়েছে, কে কত দামি জামা কাপড় পরেছে তা কেউ জিজ্ঞেস করবে না; কিন্তু এই দেশের পরবর্তী প্রজন্ম একদিন জিজ্ঞেস করবে যে তারা কোথায় ছিল, যখন দেশের গরিব মানুষদের উপর অত্যাচার হচ্ছিল, তাদের সমস্ত স্বপ্নকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছিল- কোথায় ছিল তারা!
সিনেমা হল একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যম, যেখানে একটা দৃশ্যে দুর্ভিক্ষের ছবি পরপর স্ক্রিনে ভেসে উঠছে, হরি যেন আমাদের প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছে, যেন বলছে রাস্তায় নেমে সংগঠিত আন্দোলনই মুক্তির একমাত্র পথ। এই দুর্ভিক্ষের সময় যখন পুঁজিবাদীরা চড়া দামে খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করে দিচ্ছে, তখন অন্যদিকে আরেকজন মানুষ, যারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে, তারা মার্চেন্টের কাছ থেকে চাল লুট করে সবার মধ্যে বিলিয়ে দেয় -- এ যেন রাষ্ট্রের একরূপ হার! তারপর সেই লড়াকু মানুষগুলোকে কি আর আটকানো যায়, তারা সব মশাল হাতে বেরিয়ে পড়ল, তারা যেন বলছে -- যত হামলা করো সব সামলে নেব, চ্যালেঞ্জ তোমায় যদি মারতে পারো!
সিনেমাটিতে প্রতিবার একজন বিভিন্ন মুখশ্রী নিয়ে এসে বলতে থাকে -- আমিই সেইই হাজার চুরাশির মা, আমিই গোর্কির উপন্যাসের সেই মাদার, নকশাল আন্দোলন কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি শহীদের মা আমিই- আমি আজও অপেক্ষা করছি আমার সন্তানের। এই অপেক্ষা ততদিন চলতে থাকবে যতদিন না আমার সন্তানদের স্বপ্ন পূরণ না হয়। বর্তমানের সাথে তুলনা করে বললে সিনেমাটিতে রোহিত ভেমুলা বা সারজিল বা নাজিবের মায়েদের দেখা যাচ্ছে, তাঁরাও একইভাবে রাষ্ট্রের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে -- ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’!
এই লড়াই মুক্তির লড়াই, এই লড়াই লিবারেশানের লড়াই। আর ‘আম্মা আরিয়ান’এর অর্থ হল -- আমি আমার মাকে বিষয়টা জানাতে চাই।
--- আকাশ ভট্টাচার্য