লকডাউনের সুযোগে দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও গবেষণাকে শুকিয়ে মারতে চাইছে মোদি সরকার
gegt6

২২ মার্চ সারা দেশ ব্যাপি অপরিকল্পিত লকডাউন ঘোষণার পর চারমাস অতিবাহিত। দেশের কোণায় কোণায় অস্তিত্বের সংকটের বিবিধ চিত্র, মোদি সরকারের অকর্মণ্যতার করুণ নিদর্শন। আর্থ-সামাজিক পুঁজির বংশানুক্রমিক সুবিধা ব্যতিরেকে এই টালমাটাল সময় টিঁকে থাকাই প্রায় অসম্ভব। এই নিদারুণ অনিশ্চয়তার মাঝে দেশের ৩২৬ লক্ষ গবেষক এই মুহুর্তে চরম সংকটে, আর তাদের আগামী ভবিষ্যৎ ততোধিক ধোঁয়াশার মধ্যে বিলীন।

ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের উচ্চশিক্ষার উপর করা সার্ভের তথ্য অনুযায়ী ভারতে ৯৯৩টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩৯,৯৩১টি কলেজ এবং ১০,৭২৫টি একক ইন্সটিটিউট বর্তমান। ভারতে প্রতি বছর ৩ কোটি ৭৪ লক্ষ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য নথিভুক্ত হন। ৩২৬.১ লক্ষ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার কাজে যুক্ত। শুধুমাত্র ২০১৮ সালে ৪০,৮১৩ জন পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য নথিভুক্ত হয়েছেন। গবেষণার কাজের সাথে যুক্ত মানুষরা শুধুই শিক্ষার্থী নন, তাদের গবেষণা লব্ধ ফল দেশের জ্ঞানচর্চা ও প্রগতির কাজে ব্যবহৃত হয়। করোনার দাওয়াই ভ্যাক্সিনের পথ চেয়ে সমাজকে তাকিয়ে থাকতে হয় কোনো গবেষকের সফল অনুসন্ধান ও পরীক্ষার অপেক্ষায়। আবার দেশের নাগরিকদের বাস্তবিক ছবি তুলে ধরতে সামাজিক নিরীক্ষণের কাজে গবেষকদের শ্রম ও অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগে। সমাজের ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতির দিশায় কাঁচামাল সরবরাহ করেন এই গবেষকরাই। করোনাকে অজুহাত করে উচ্চশিক্ষার সাথে যুক্ত ছাত্রছাত্রীর প্রতি দায় ঝেড়ে ফেলেছে কেন্দ্র। গবেষণার কাজ, লাইব্রেরী, পরীক্ষাগারের প্রবেশ, শিক্ষা-সামগ্রী ব্যবহারের সুযোগ বা গাইড/ সুপারভাইজারের পরামর্শ – গবেষণার জন্য জরুরি এই প্রতিটি প্রয়োজন বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। গবেষকদের প্রাপ্য সরকারী ফেলোশিপ বা স্কলারশিপগুলি পাচ্ছেন না এরা। নির্দিষ্ট রাজ্য সরকার কিছু ব্যবস্থা নিলেও সামগ্রিকভাবে ইউজিসি বা এমএইচআরডি-র তরফ থেকে এই প্রসঙ্গে মুখে কুলুপ আঁটা হয়েছে।

gretr

 

খড়গপুর আইআইটি-র জিওলজির এক গবেষকের কথায়, মার্চ মাস থেকে রিসার্চের কাজ বন্ধ। লাইব্রেরী বা পরীক্ষাগারই গবেষণার মূল ক্ষেত্র হওয়ায় গবেষণার কাজ নূন্যতম এগোয়নি বিগত সময়। অন্যদিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যার এক গবেষক বলছেন, স্কলারশিপের টাকা নিয়মিত না মেলায় তিনি গবেষণার কাজ ছেড়ে জীবনধারণের জন্য অন্য চাকরির খোঁজ করে চলেছেন। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটির কাছে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া বিলাসিতা মনে হচ্ছে। গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গাইডের পরামর্শ সুষমভাবে সকল গবেষকরা পাচ্ছেন না। তদুপরি পিএইচডি বা এমফিলের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া বা পরীক্ষার সবটাই অনলাইনে। নির্দিষ্ট ব্যান্ডউইথের সুবিধাযুক্ত যথার্থ ইন্টারনেট ব্যবস্থা ছাড়া এই পরীক্ষাগুলির আবেদন বৃথা যাবে। আপনি টাকা দিয়ে আবেদনপত্র পূরণ করার পর, পরীক্ষার সময় আপনার মেশিনের ইন্টারনেট ব্যবস্থা পরীক্ষাকেন্দ্রের নির্দেশের যথোপযোগী না হলে পরীক্ষা বাতিল হয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি তাদের প্রকাশিত এমফিল, পিএইচডির আবেদনপত্রে এই মর্মে আবেদনকারীর লিখিত সম্মতিও নিয়ে নিয়েছে। প্রসঙ্গত, এই গবেষকদের একটা অংশ শহরাঞ্চলে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন, যারা লকডাউনের ফলে বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্রের মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলির সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এই বহুসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বাক্য খরচ করেনি উচ্চশিক্ষা মন্ত্রনালয়। বরং উচ্চশিক্ষার সাথে যুক্ত বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজগুলি লকডাউনের অজুহাতে বন্ধ এবং কবে সেগুলি খুলবে কেউ জানে না। এই প্রজেক্টগুলির কাজ উচ্চাশিক্ষায় যুক্ত বড়ো অংশের ছাত্রছাত্রীদের রোজগারের সংস্থান ছিলো। এগুলির অবর্তমানে এই বৃহৎ অংশের যুবসমাজের জীবন-ধারণের পরিপূরক কোনো পথের ব্যবস্থা সরকার খোলা রাখেনি। মহামারীর সময় গবেষকের কাজ স্থগিত থাকা বা পুনরায় শুরু নিয়ে নূন্যতম নির্দেশিকা অনুপস্থিত। গবেষণাক্ষেত্রে পরিকল্পিত উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত এই অবহেলায় বেকারত্বে ধুঁকতে থাকা দেশের চাকরি ক্ষেত্র দ্বিগুণ চাপের মুখে দাঁড়িয়ে। ইন্যদিকে, করোনাকালের অচলাবস্থাকে কাজে লাগিয়ে সরকারের দিকে আঙুল তোলা গবেষকদের কন্ঠরোধে অভূতপুর্ব উদাহরণ তৈরি করে চলেছে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক।

ggasr

 

পাঠক মনে রাখবেন, সাফুরা জারগার, দেবাঙ্গনা কাটিলা, নাতাশা নারয়াল বা সারজিল ইমাম এরা সকলেই এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রীতে নথিভুক্ত গবেষক। যারা অর্জিত শিক্ষা দেশ ও দশের কাজে নিয়োগ করেছেন। মনে রাখবেন মোদী-শাহ রাজের বদান্যতায় এদের সকলের ঠাঁই হয়েছে কারাগারের অন্ধকারে। সমাজ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা সমাজের হিতে ব্যবহার করার অপরাধে এরা দেশদ্রোহীতায় অভিযুক্ত। বাবা সাহেব আম্বেদকর বলেছিলেন “শিক্ষাই মানুষকে অকুতোভয় করে তোলে, তাকে ঐক্যের পাঠ দেয়, শিক্ষালাভে মানুষ নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় আর শিক্ষাই মানুষকে অধিকারের জন্য লড়তে অনুপ্রাণিত করে।” পৃথিবীর সাম্যবাদের প্রদর্শক কার্ল মার্ক্স বিকল্প সমাজের রুপরেখা তৈরি করতে গিয়ে বলেছেন, “শিক্ষা অমূল্য। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রনের আইনানুগ প্রয়োগ দ্বারা শিক্ষা মানুষের উপভোগ্য হয়।”

book

 

মার্ক্স বা আম্বেদকরের শিক্ষার মডেল জনসাধারণের পক্ষের। এর বিপরীতে অবস্থান পুঁজিবাদী ফ্যাসিস্ট ভারতের শাসক শ্রেণীর। সার্বভৌম ভারতে মনুবাদী শিক্ষা-ব্যবস্থার পুনর্বহাল চায় ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার। শোষক শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্রের আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পরিণতি আজকের ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা। মহামারীর সময় শিক্ষার জন্য নিযুক্ত মন্ত্রকগুলির চুড়ান্ত ব্যর্থতায় ভারতের ছাত্রসমাজ ফুঁসছে। ফাইনাল ইয়ারের অনলাইন পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে চলছে ছাত্রদের বিক্ষোভ প্রদর্শন। গবেষণার সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীদের নিজেদের দাবি নিয়ে সংহত হওয়ার সময় এসেছে। নিজ অধিকার, মর্যাদা, প্রাপ্যের দাবি বুঝে নেওয়ার সময় আজ। দেশের কিয়দংশের স্বার্থে মনুবাদের অন্ধকারে ঢাকা পুঁজিবাদী শিক্ষা নয়, দেশের জনসাধারণের হিতে শিক্ষার সুষম বন্টন সুনিশ্চিত হোক। আগামীর ভারতে সবার জন্য শিক্ষা সবার হাতে কাজের দাবিতে ভারতের যুবসমাজের মুখে ধ্বনিত হোক “এডুকেট রজিটেট অর্গানাইজ”।

- সম্প্রীতি মুখার্জী   

খণ্ড-27
সংখ্যা-26