৫ আগস্ট বনাম ১৫ আগস্ট: সংবিধান বাঁচাও ভারত বাঁচাও
ceaar

প্রায় ২৮ বছর আগে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া বাবরি মসজিদের জমিতে শীর্ষ আদালতের অনুমোদনে ৫ আগস্ট ২০২০ রাম মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন বা ভূমি-পূজনের যে অনুষ্ঠান সংঘটিত হল তা বর্তমান ভয়াবহ মহামারী তথা ২৫ মার্চ থেকে চলা দীর্ঘ লকডাউনের মধ্যে আরএসএস-বিজেপির সর্বোচ্চ নির্ধারক রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ঘোষণা। জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রদানকারী সংবিধানের ৩৭০নং অনুচ্ছেদকে বিলুপ্তকরণের সাথে রাজ্যসত্তা বিলুপ্ত করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভাজনের (অ)-সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকির দিনটিকেই অযোধ্যার অনুষ্ঠানের দিন হিসেবে বেছে নেওয়া, এর ঘোর রাজনৈতিক প্রতীককে আরো জোরালো করে তুলেছে।

বিজেপি দাবি করে যে, ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ও রাম মন্দির নির্মাণ তাদের ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারে ছিল এবং মোদি সরকার সেই প্রতিশ্রুতি পালন করছে মাত্র। এটি সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনী জয়ের একটি নির্লজ্জ ব্যাখ্যা। বিজেপি তার নির্বাচনী ইস্তেহারের আশ্রয় নিতে পারে কিন্তু তারা সংবিধানের ভিত্তিতে শপথ গ্রহণ করেছে। কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে আলোচনা ব্যতিরেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করা একটি সম্পূর্ণ সংবিধান-বিরোধী কাজ। অনুরূপে মন্দিরের ভিত্তি স্থাপনে মোদির অংশগ্রহণ সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মবস্তুকে খারিজ করা যা রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে দূরে থাকতে বলে।

সঙ্ঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠানের হিন্দুরাষ্ট্র প্রকল্পের এতাবৎ কালের সুস্পষ্টতম ও সরবতম ঘোষণা হল মোদির অযোধ্যা বক্তৃতা। তিনি রামকে ভারতের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের সর্বোৎকৃষ্ট প্রতীক হিসেবে এবং অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভিত্তি স্থাপনকে বহু শতাব্দীর প্রতীক্ষার পরিসমাপ্তি হিসেবে তুলে ধরেন। ৫ আগস্টকে ১৫ আগস্টের সঙ্গে একই বন্ধনীতে রেখে অযোধ্যার রাম মন্দিরকে কেবল রামের ভক্তদের ধার্মিক প্রকল্প হিসেবে দেখানোর বদলে একটি জাতীয় প্রকল্প হিসেবে দেখাতে চান। হিন্দু সত্ত্বার সঙ্গে ভারতীয় জাতি সত্ত্বার একিকরণ সামগ্রিক হিন্দু জাতিয়তাবাদ বা হিন্দুত্ব তত্ত্বের মূল ভিত্তি এবং মোদি হিন্দু রাষ্ট্র শব্দটি ব্যবহার না করে হিন্দুত্ব পরিকাঠামোকে বিস্তারের জন্য অযোধ্যাকে নির্দিষ্টভাবে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করলেন।

৫ আগস্টকে কোনোভাবেই ১৫ আগস্টের সঙ্গে এক বন্ধনীতে রাখা যায় না। ১৫ আগস্টের গতিপথ ও তাৎপর্যের সঙ্গে এটি সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে রয়েছে। ১৫ আগস্টের পিছনে ছিল স্বাধীনতার জন্য ভারতের জাতিয় সংগ্রাম, এবং সেই লড়াইয়ের কর্মসূচীতে রামমন্দির কখনো কোনো বিষয় ছিল না। অযোধ্যা-ফৈজাবাদ এবং আওধের সমস্ত অঞ্চল ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। হিন্দু-মুসলমান ঐক্য এবং ব্রির্টিশ উপনিবেশবাদের খপ্পর থেকে মুক্তির আবেগ সমগ্র অঞ্চলের জনতার চেতনায় প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। এমনকি স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ দশকেও, যখন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিভৎসা মাথা তুলেছে, রাম মন্দিরের কোনো গুরুত্ব ছিল না।

কেবলমাত্র ২২ ডিসেম্বর ১৯৪৯-এর রাতে মসজিদের অভ্যন্তরে ধোঁকাবাজি করে মূর্তি স্থাপন করে মসজিদটিকে বিতর্কিত কাঠামোয় পরিণত করা হয়, গান্ধিজিকে হত্যার কারণে নিষিদ্ধ হওয়া আরএসএস-এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তখন সবেমাত্র উঠেছে। আরএসএস মুচলেকা দিয়ে জানায় যে সংবিধান ও তেরঙ্গার প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে এবং নিছক সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে কাজ করবে। এই মুচলেকার ভিত্তিতে তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয় ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে। গান্ধিজিকে হত্যার জন্য গডসের ফাঁসি হয়েছে নভেম্বরে। সেটি এমন এক সন্ধিক্ষণ যখন আরএসএস ও হিন্দুত্বের অন্যান্য শক্তিগুলি অত্যন্ত নিন্দিত ও কোণঠাসা। এটিও লক্ষ্যণীয় যে, ফৈজাবাদের তৎকালিন জেলা শাসক কেকে নায়ার, যিনি স্পষ্ট নির্দেশ সত্বেও মূর্তি অপসারণ করতে অস্বীকার করেন ও পরবর্তিতে কর্তব্যে গাফিলতির জন্য অপসারিত হন, জনসঙ্ঘের প্রার্থী হিশেবে বাহারাইচ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে বিজেপি যখন আবার নিম্নাভিমুখি গতিপথে তখন বিষয়টিকে আবার পুনর্জীবিত করে তোলা হল।

রাম মন্দির নির্মাণ অবশ্য এখন শীর্ষ আদালত দ্বারা অনুমোদিত। যদিও এটি একটি কৌতুকের বিষয় যে ৯ নভেম্বর, ২০১৯-এ শীর্ষ আদালতের যে রায় বিতর্কিত জমির মালিকানা রাম মন্দির ট্রাস্টকে সমর্পণ করেছে সেই রায় ১৯৪৯-এর মূর্তি স্থাপনকে মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার দরুন মসজিদের অপবিত্রকরণ বলে অভহিত করেছে এবং ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২-এর বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে আইন-শাসনের আতঙ্কজনক অবমাননা বলে অভিহিত করেছে। অতীতে ১৯৯৪ সালে শীর্ষ আদালত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাকে জাতীয় লজ্জা বলে অভিহিত করেছিল। এটি ভাববার বিষয় যে, ২২-২৩ ডিসেম্বর ১৯৪৯ ও ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২-এর অপরাধ ব্যতিরেকে শীর্ষ আদালত কখনো জমির আইনি সত্ব মন্দির ট্রাস্টকে অর্পণ করত কিনা?

মোদি সরকারের আক্রমণাত্মক বেসরকারীকরণ কর্মসূচী ও ভারতীয় কৃষির উপর কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ জারি করার অর্ডিনান্সের বিরুদ্ধে শ্রমিক ও কৃষকদের ৯ আগস্ট ২০২০তে ‘ভারত বাঁচাও’ পতাকা হাতে রাস্তায় নামা অবশ্যই আশা জাগাচ্ছে। ভারতের আগস্ট মাস ৯ আগস্ট ১৯৪২-এর ভারত ছাড় আন্দোলন ও ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এর রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আরএসএস-বিজেপি পরিবারের অন্দরের চক্রের মানুষজন ব্যতিরেকে ৫ আগস্টকে সকলেই সংবিধানের বুনিয়াদী মর্মবস্তুকে লঙ্ঘন করার মোদি সরকারের নিন্দনীয় কাজ হিসেবে দেখবে। আগস্ট ৯ ও আগস্ট ১৫ ভারতের জনগণকে চিরকাল ভারতকে রক্ষা করতে ও ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি ও কাঠামোকে রক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১১-১৭ আগস্ট ২০২০)  

খণ্ড-27
সংখ্যা-28