খবরা-খবর
মনরেগায় নথিভুক্তি ও কাজ - মেহনতিদের অধিকার আন্দোলনের কিছু প্রচেষ্টা
dree

প্যানডেমিক পর্বে গ্রামাঞ্চলে কাজের জন্য চলছে তীব্র হাহাকার। প্রবাসী শ্রমিকরা গ্রামে ফিরেছেন। মনরেগার উপর নজরদারী চালানো সমাজকর্মীদের তুলে ধরা তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে এই অর্থ বর্ষের প্রথম চার মাস, এপ্রিল থেকে জুলাই-এর মধ্যেই ১০০ দিনের প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের ৪৮ শতাংশ অর্থ খরচ হয়ে গেছে! দেখা যাচ্ছে, ৪.১৭ লক্ষ পরিবার ইতিমধ্যেই তাঁদের বরাদ্দ ১০০ দিনের কাজ করে ফেলেছেন! বছরের বাকি দিন এদের তবে চলবে কিভাবে?

কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের ওয়েবসাইটের উপর ‘মনরেগা ট্র্যাকার’ নামে নজরদারি অভিযান চালাচ্ছে সমাজকর্মীদের সংগঠন ‘পিপলস অ্যাকশন ফর এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি’। এঁদের দেওয়া তথ্য অনুসারে মনরেগায় এপ্রিল থেকে কাজ বৃদ্ধি যেমন বাস্তব, তেমনি দেখা যাচ্ছে যে, এবছরে ৭ জুলাই পর্যন্ত ২২% আবেদনকারী কাজ পাননি।

জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুসারে ২০১২ থেকে ২০১৮ এই সময়ের মধ্যে গ্রামীণ পুরুষদের মধ্যে কর্মহীনতা বেড়েছে ৩ গুণ, মহিলাদের মধ্যে ২ গুণ। এর উপর প্যানডেমিকের অভিঘাত। দলে দলে প্রবাসী শ্রমিকদের গ্রামে ফিরে আসা। কাজের চাহিদা এতোটাই যে মনরেগায় ১ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ (গত অর্থবর্ষের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মনরেগায় মোটামুটি যা খরচ হয়েছিল) সে চাহিদা সামাল দিতে বেশ কম। উড়িষ্যা সরকার ইতিমধ্যেই সে রাজ্যের বেশ কয়েকটি ব্লকে ১০০ দিনের পরিবর্তে ২০০ দিনের কাজ চালু করেছে। দেশজুড়েও উঠেছে মনরেগায় পরিবার ভিত্তিকের বদলে ব্যক্তি ভিত্তিক ২০০ দিনের কাজের দাবি।

কাজের জন্য হাহাকার শুধুমাত্র প্রবাসীদের গ্রামে ফেরায় নয়, ট্রেন না চলা, প্যানডেমিকের কারণে মেহনতিদের গ্রামেই আটকে যাওয়াও এর বড় কারণ। ঋণমুক্তির দাবিতে আন্দোলন চলাকালীন ঋণ না শোধ করতে পারা নিয়ে কখনো শোনা যাচ্ছে, ‘স্বামী নিউ টাউনে পাথরের/পালিসের কাজ করতেন দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরিতে। সেই ভরসায় এককালীন বড় লোন নিয়ে সপ্তাহে সপ্তাহে শোধ করা যেত। এখন কাজ বন্ধ, ট্রেনও বন্ধ। যেটুকু হচ্ছে ১০০ দিনের কাজে, তাতে পেট চলছে’। কেউ বলছেন, বড়বাজারে কাজ করতাম। ট্রেন বন্ধ, যেটুকু কাজ ১০০ দিনের। সেটাই বা কতটুকু! শুধু যারা লোকাল ট্রেন ধরে কাজে যেতেন তাঁরাই নন, গ্রামের আশেপাশেও যারা রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রির কাজ করতেন তাঁদেরও কাজ প্রায় নেই। বেহাল অর্থনীতি আর সংক্রমণের ভয়ে ব্যাপক কাজ কমেছে।

অর্থনীতির নানান টানাপোড়েনে খেতমজুর পরিবারে এসেছিল পেশার ধরনে বৈচিত্র্য/ডাইভারসিফিকেশন। খেতমজুরি ছেড়ে পরিবারের নতুন প্রজন্মে এসেছে নতুন নতুন পেশা -- রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি , ড্রাইভিং, ফেরি ব্যবসা, গহনার মিস্ত্রি -- প্যানডেমিকে সব পেশাই সংকটে।

এই প্রেক্ষাপটেই নতুন করে বুঝতে হবে ‘১০০ দিনের কাজ’-কে। যা কেবল শাসক দলগুলির ভোট বাক্স আর মিটিং মিছিল ভরানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, কর্মনিশ্চয়তার সেই আইনকে গ্রামীণ মেহনতিদের শ্রেণীস্বার্থে ঘুরে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনাকে বুঝতে হবে।

প্রবাসীরা যখন ঘরে ফিরছেন, তখন শুরু করা গিয়েছিল নতুন জবকার্ডের আন্দোলন। জবকার্ড পরিবার ভিত্তিক। ২০০৬ পরবর্তীতে বছর ১২/১৪ আগে যখন জবকার্ড হয়, তখন অবিবাহিত সন্তানের নাম ছিল বাবা/মা’র জবকার্ডে। এখন সন্তানের আলাদা সংসার, নাম কিন্তু বাবার জবকার্ডে। ১০০ দিনের পরিবার ভিত্তিক কাজ বাস্তবে ভাগাভাগি করে পাচ্ছে ২/৩টি পরিবার।

প্রবাসীরা কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরলে, সরকার পরিস্থিতির চাপে এঁদের জবকার্ড দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা দাবি তুলি, কর্মনিশ্চয়তা আইন অনুযায়ী, কোনো পরিবার জবকার্ড চাইলে, সেই পরিবারকে অবশ্যই আলাদা জবকার্ড দিতে হবে। আমাদের আন্দোলনের চাপে জেলার ১০০ দিনের কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্য সরকারী আধিকারিক মেনে নেন, আইনানুসারে নতুন পরিবার জবকার্ড চাইলে, সরকার দিতে বাধ্য।

beee

 

আমাদের উদ্যোগে নতুন করে চাওয়া জবকার্ড সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত থেকে প্রশাসন দিতে থাকে। প্রথমেই ধনেখালি ২নম্বর পঞ্চায়েতে ৫০-এর অধিক নতুন জবকার্ড তুলে দেয়। শাসকদল টিএমসির একাংশ চিরাচরিত অভ্যাসবশত নতুন জবকার্ড হাতে তুলে দেওয়ার বিনিময়ে টাকা নেওয়ার মতলব করে, পঞ্চায়েতে নতুন জবকার্ডগুলি কিছুদিন আটকে রাখে। ঋণমুক্তি ছাড়াও কাজ ও জবকার্ড, আমফান ক্ষতিপূরণ চেয়ে ১০ আগষ্ট ধনেখালি ব্লকে ব্যাপক জমায়েত সহ বিক্ষোভ দেখানো হয়। এই গণবিক্ষোভের পর শাসক দলের একাংশের অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। প্রসঙ্গত, এই পঞ্চায়েতে আমরা ভালো জমায়েত সহ জবকার্ড দাবি করে ফর্ম পূরণ করে ডেপুটেশনও দিয়েছিলাম জুনের শেষে।

ইতিমধ্যে এই ইস্যুগুলিতে সংগঠিত হয় ১৭ আগষ্ট জেলাশাসক ডেপুটেশন, কোভিড পরিস্থিতিতেও শতশত মানুষের সমাবেশে। এরপরও বেলমুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত জবকার্ড দিতে গড়িমসি করলে ২৪ আগষ্ট জয়হরিপুরে সংগঠিত হয় অবস্থান কর্মসূচী। ব্লক প্রশাসন দ্রুতই হস্তক্ষেপ করে। পরবর্তীতে ধনেখালি ১ নম্বর পঞ্চায়েতেও আমাদের আবেদন করা জবকার্ড দিতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। এখন বেলমুড়ি পঞ্চায়েত দিচ্ছে জবকার্ডগুলি। এখানে আমাদের দাবি ছিল শতাধিক। এখনো নতুন করে জবকার্ডের দাবি জানানো চলছে।

ধনেখালি ২নম্বরে নতুন জবকার্ড ও পুরানো জবকার্ড, দুই মিলিয়ে কাজের দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে।

গত ১৬ আগস্ট সংগঠিত হল আয়ারলা সংগঠক শ্যামাপদ শীটের গ্রামে ৪ক ফর্ম পূরণের ক্যাম্প; নির্দিষ্ট ফর্মে এবং সাদা কাগজেও। এক একটি কাগজে জবকার্ড নম্বর সহ কাজ চেয়ে ১০ জন করে স্বাক্ষরিত/টিপসই সহ আবেদন, প্রধানের উদ্দেশ্যে।

এরপর পরপর দুদিন শ্যামা শীট, জয়দেব বাগ, ছায়া মান-এর নেতৃত্বে সকলে পঞ্চায়েত অফিসে গেলেন এনআরইজিএ-তে কাজের লিখিত দাবি ৪(ক) জমা দিতে। প্রধান নেই, এই অজুহাতে কেউ জমা নিলেন না। পরদিন ওঁরা গেলেন বিডিও অফিসে। বিডিও আয়ারলার চাপে ফোন করলেন প্রধানকে। পরদিন ৪(ক) জমা নিলেন প্রধান। সোমবার, ২৪ আগস্ট ধনেখালি ১ নম্বর পঞ্চায়েতেও কাজ চেয়ে ৪(ক) পূরণ করে জমা দিলেন রুমা আহেরি, প্রতিমা আহেরিরা। সাথে ছিলেন আরো অনেক কর্মপ্রার্থী মহিলা।

এ লড়াই বাঁচার লড়াই, লড়তে হবে একসাথে।

- সজল অধিকারী  

খণ্ড-27
সংখ্যা-30