সারা দেশে ১৩ আগস্ট ঋণমুক্তি দিবস হিসেবে বহুস্তরে কর্মসুচী গৃহীত হয়। বিশেষত পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে তা খানিকটা ব্যাপক চেহারা নেয়। এখানে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলা ও ব্লকের রিপোর্ট প্রকাশ করা হল।
পূর্ব বর্ধমান
১৩ আগস্ট দেশ জুড়ে ঋণমুক্তি দিবস পালনের অংশ হিসেবে পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়ে ১৫ দিন আগে থেকে ঋণ মুক্তি কমিটির নেতৃত্বে গ্রামে গ্রামে বৈঠক, মিছিল ও প্রচার শুরু হয়। জেলার ৪টি ব্লকে ৬০টির মতো গ্রামে বৈঠক হয়। মোদী সরকার দেশ জুড়ে আনলক-টু ঘোষণা করলেও গ্রামীণ গরিব জনগণের জীবন-জীবিকায় লকডাউন কাটছে না। মানুষের কাজ নেই, খাদ্যের অভাব বেড়েই চলছে। পরিযায়ী শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে কাজের অভাবে চরম অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। গ্রামীণ মজুর, হকার, তাঁত শ্রমিক ও গ্রামীণ মেহনতি মহিলাদের কাজ নেই। ১০০ দিনের কাজ পর্যাপ্ত দেওয়া হচ্ছে না। চলছে দলবাজি, দুর্নীতি। তার উপর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া গরিব মানুষের জীবনধারণ অসহনীয় হয়ে উঠছে। তার মধ্যেই মহাজনী সংস্থাগুলোর এজেন্টরা ঋণগ্রস্ত মহিলাদের উপর ঋণ আদায়ের জন্য গ্রামে গ্রামে চাপ সৃষ্টি করে চলছে। তাই ঋণ-ফাঁদে জর্জরিত গ্রামীণ গরিব জনগণ বিশেষত মহিলারা দলে দলে ঋণ মুক্তি কমিটিতে সামিল হতে শুরু করেছে।
জামালপুর ব্লকে ১৩ আগস্ট বিক্ষোভ, ডেপুটেশন সংগটিত করা হয়। ৩৭টি গ্রামের দুই হাজারের বেশি মানুষ বিশেষ করে মহিলারা নিজস্ব উদ্যোগে বিডিও অফিসে জমায়েত হয়। ব্যাপক পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারী মহিলাদের জঙ্গী প্রতিরোধের সামনে পুলিশ পিছু হঠতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ সময় বিক্ষোভ চলার পর বিডিও তিন জন প্রতিনিধির ম্যাধমে ডেপুটেশন গ্রহণ করতে রাজি হয়। কুনাল বক্সীর নেতৃত্বে ঋণ-মুক্তি কমিটির ব্লক সভাপতি অর্চনা মল ও সম্পাদক নিতাই ক্ষেত্রপাল ডেপুটেশনে প্রতিনিধিত্ব করেন। দাবিগুলি ছিল – (ক) প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থ বর্ষের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সমস্ত ইএমআই আদায় স্থগিত রাখতে হবে। (খ) লকডাউন বিপর্যস্ত মানুষের উপর বন্ধন, উজ্জীবনের মতো সংস্থাগুলির চড়া সুদ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিস্তি আদায়ের নামে জুলুমবাজি বন্ধ করতে জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (গ) রাজ্য সরকারকে সমস্ত ধরনের কৃষি ঋণ মুকুব করতে হবে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের স্বনির্ভরতা সুনিশ্চিত করুন। (ঘ) দরিদ্রদের সমস্ত ধরনের ঋণমকুবে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে উদ্যোগ গ্রহণ করুন। (ঙ) মনরেগা প্রকল্পে ২০০ দিনের কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে।
এই দাবিগুলো নিয়ে বিডিও আলোচনা করে সাত দিন সময় নেয়। দাবিগুলো উপরে পাঠাবে। সাত দিন পরে কি করতে পারবে জানাবে। এই ডেপুটেশন এলাকায় ভালো প্রভাব ফেলেছে। উপস্থিত জনগণ ভালো উৎসাহিত হয়েছে। এই ডেপুটেশনে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক কমরেড সলীল দত্ত সহ ছয় জন জেলা কমিটির সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
বর্ধমান সদর ১নং ব্লকের বিডিও-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ডেপুটেশনে দুই শতর কাছাকাছি ঋণগ্রস্ত মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির জেলা কমিটির সদস্য শ্রীকান্ত রানা ও সমীর হাজরা, চাপা হাজরা সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ডেপুটেশনের পরেও বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ যোগাযোগ করছে। জমায়েতে বেশিরভাগ গ্রামীণ মহিলারা উপস্থিত ছিলেন।
কালনা ২নং ব্লকে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেতৃত্বে ঋণ মুক্তির দাবিতে বিডিও অফিসে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। দুই শতাধিক গরিব তথা ঋণ-ফাঁদে জর্জরিত মানুষ বিক্ষোভে সামিল হয়। আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মহিলারা ভালো মাত্রায় উপস্থিত ছিলেন। ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা কমরেড সুমি মজুমদার (ঘোষ) ও অনান্য মহিলা নেতৃবৃন্দ। উপস্থিত ছিলেন আয়ারলা ও সিপিআই(এমএল)-এর নেতা কর্মীরা।
হুগলি
১৩ আগস্ট ঋণ মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠল গোটা হুগলি জেলা। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, জেলা জুড়ে পথে নামলেন হাজার হাজার মানুষ। কোথাও পথ অবরোধ, জাতীয় পতাকা হাতে তুলে ধরে কোথাও ঋণপত্রের প্রতিলিপি পোড়ানো, কোথাও মিছিল, কোথাও বা বিডিও ডেপুটেশন, স্টেট ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ডেপুটেশন ইত্যাদি নানান কর্মসূচী সংগঠিত হল ঋণ-মুক্তির দাবিতে।
দিনের প্রথম কর্মসূচীটির সূচনা ধনেখালির ফিডার রোডে। ব্লকের প্রত্যন্ত অসংখ্য গ্রাম থেকে বেলা ১১টার মধ্যে এখানে উপস্থিত হলেন শয়ে, শয়ে মানুষ, যাদের অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র মহিলা। স্বাধীনতার ঠিক আগে জাতীয় পতাকা হাতে, করোনা সতর্কতা মেনেই তে-মাথার সবদিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীরা তুলে ধরলেন ঋণ মুক্তির দাবি – “শিল্পপতিদের বারবার ঋণমকুব হলে, আমাদের গরিবদের ঋণ সরকার এই প্যানডেমিকের সময় মকুব করবে না কেন?”
আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরণ ঘটালো বহ্নি-উতসবে, তেমাথার মোড় আটকে শত, শত ঋণগ্রস্ত মহিলা নিজের হাতে পোড়ালেন ঋণপত্রের প্রতিলিপি! রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে বাসযাত্রী থেকে সাধারণ মানুষ, আওয়াজ উঠল, মুখ্যমন্ত্রী এখনো চুপ কেন? মন্দির গড়ায় সময় না দিয়ে, প্রধানমন্ত্রী মোদী বরং ভাবুন মাইক্রো ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলির জুলুমবাজি কিভাবে বন্ধ করা যায়, সেসব নিয়ে! আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন সম্রাট মাহেলী, প্রতিমা মুর্মুদের পাশাপাশি আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সজল দে, সোমা রায়, শৈলেন মাজি প্রমুখ।
ইতিমধ্যে চুঁচুড়া খাদিনা মোড়ের স্টেট ব্যাংক শাখার সামনে মিছিল শেষে শুরু হয় ধর্ণা ও ডেপুটেশন কর্মসূচী। নেতৃত্বে ছিলেন আইপোয়া নেত্রী চৈতালী সেন, সাবিনা খাতুন, ঋণ মুক্তি কমিটির শেলী রায়, এআইপিএফের ভিয়েত ব্যানার্জী, সুদর্শন বসুরা।
বেলা ২টা নাগাদ পোলবা দাদপুরের সেঁইয়া থেকে শুরু হল মিছিল। মিছিল হারীট গঞ্জে পৌঁছালে সেনেট থেকেও যোগ দিলেন আন্দোলনকারীরা। জাতীয় পতাকা হাতে পথ অবরোধে নামলেন শয়ে, শয়ে মহিলা; মাইক্রো ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলির জুলুমবাজির বন্ধ করার দাবিতে। এখানেও পোড়ানো হলো ঋণপত্রের প্রতিলিপি। রাস্তার দুদিকে দাঁড়িয়ে আগুনের উত্তাপ গায়ে নিলেন অসংখ্য মানুষ। নেতৃত্ব দিলেন গোপাল রায়, পাগান মুর্মু, পদ্মা কর্মকার, রীনা পাশোয়ান সহ অন্যেরা। আয়ারলা অন্তর্ভুক্ত ‘ঋণ মুক্তি কমিটি’র বলাগড় বিডিও ডেপুটেশন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিলেন সেখ আনারুল, শোভা ব্যানার্জী। এখানেও হাজির ছিলেন অসংখ্য ঋণগ্রস্ত মানুষ, অধিকাংশই মহিলা।
এদিন হুগলির অন্যতম এক ঋণমুক্তি আন্দোলন দেখলেন পান্ডুয়াবাসী। বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ তিনদিক থেকে তিনটি মিছিল নিয়ে এসে পাণ্ডুয়া জিটি রোডের সদা ব্যস্ত কালনা মোড়ে ঋণমুক্তির দাবিতে পথের উপর বসে পরলেন শত, শত আন্দোলনকারী। ঋণ মুক্তি কমিটির এই আন্দোলনের সামনে রইলেন বিনয় দাস, নিরঞ্জন বাগ, চন্দনা মণ্ডল, মুকুল কুমার, ময়না কিস্কুর মতো নেতৃবৃন্দ।
আন্দোলন সংগঠিত হল তারকেশ্বরের মোচপুর মোড়, হরিপালের আঁটপুর, জাঙ্গিপাড়ার দ্বারহাটাতেও। গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষের মিছিল এসে মোড়ে, মোড়ে ঋণপত্রের প্রতিলিপি পুড়িয়ে নষ্ট করলো সর্বত্র। সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ উঠল, ‘ব্যাংক এজেন্টদের জুলুমবাজি বন্ধ করো’। নেতৃত্বে ছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন, রুমা আহেরি, সজল দে প্রমুখ। এইদিন সন্ধ্যায় কোন্নগর ধারসা পেট্রোল পাম্প বাস স্ট্যাণ্ড এলাকায় নবগঠিত ‘ঋণ-মুক্তি কমিটি’ পথসভার মাধ্যমে প্রতিবাদ তুলে ধরলো।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাটে বারাসাত টাকি রোডের উপর দণ্ডিরহাট সোলাদানার মোড়ে রাস্তার উপর জড়ো হয়ে প্রতিবাদ দেখালেন অসংখ্য মহিলা, ঋণ মুক্তি কমিটির নেতা বাবু বিশ্বাসের নেতৃত্বে। ওইদিনই আয়ারলার ব্যানারে অজয় বসাকের উদ্যোগে প্রতিবাদ সংগঠিত হল অশোকনগর শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামেও। শিবদাসপুরে আদিবাসী মানুষের উপস্থিতিতে চলে গ্রামীণ আলোচনা সভা। উদ্যোগে ছিলেন আয়ারলার স্নেহাশিষ চক্রবর্তীরা।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার নিশ্চিন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মালিকপাড়াতে ঋণমুক্তির দাবিতে হল আলোচনাসভা, আয়ারলা নেত্রী দেবযানী গোস্বামীর উদ্যোগে। ঋণ-মুক্তির দাবিতে পোস্টারিং হল উস্হি বাজারে।
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর চকবাজার ইন্দিরা মার্কেট মোড়ে আইপোয়া ও এআইসিসিটিইউ নেতৃত্বের উদ্যোগে চলে প্রতিবাদ কর্মসূচী। বক্তব্য রাখেন আইপোয়া নেত্রী তিতাস গুপ্ত, সিপিআই(এমএল) নেতা ফারহান হোসেইন খান ও আইসার বিল্টু ক্ষেত্রপাল। কর্মসূচীটি পথচলতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও অনেক মহিলা এই কর্মসূচীতে যোগ দেন।
দার্জিলিং জেলার শক্তিগড়ে ঋণ-মুক্তি প্রস্তুতি কমিটির ব্যানারে প্রতিবাদ সংগঠিত করলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা নেতা পুলক গাঙ্গুলি, মোজাম্মেল হক, আইপোয়া নেত্রী রুবি সেনগুপ্ত, শ্বাশ্বতী সেনগুপ্ত প্রমুখ। ফাঁসিদেওয়ার রাঙ্গাপানি কালারাম পাইকারি বাজারে পথসভায় ঋণ-মুক্তির দাবি তুলে ধরলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি সদস্য পবিত্র সিংহ, যুবনেতা কৃষ্ণ সিংহ সহ অন্যরা।
ছাত্র সংগঠন আইসা ঋণ মুক্তি দিবসে এডুকেশন লোন মকুবের দাবিতে সোচ্চার হয়। এই দাবিতে ১৩ অগষ্ট সরশুনার পথসভায় বক্তব্য তুলে ধরেন ছাত্রনেতা অভিজিৎ, আর ওয়াইএ রাজ্যনেতা রণজয় সেনগুপ্তরা। এই দিন আইসা, আইপোয়া, আরওয়াইএ’র যৌথ উদ্যোগে যাদবপুর এইটবি বাস স্ট্যাণ্ডে দীর্ঘ সময় ধরে কর্মসূচী চলে। দরিদ্র নারীদের ঋণ-মুক্তির দাবি তোলার পাশাপাশি প্যানডেমিকের এই সময়ে এক বছরের জন্য এডুকেশন লোন মকুবের দাবী ওঠে।
ঋণ-মুক্তি কমিটির উদ্যোগে হাওড়া জেলায় আন্দোলন শুরুর ইতিহাস একেবারেই সাম্প্রতিককালের। এখানে অল্প দিনেই বিভিন্ন ব্লকে আন্দোলন ছড়িয়েছে। ১৩ অগষ্ট এই জেলার বাগনান ১ নম্বর ব্লকের বাঙ্গালপুর অঞ্চলে এবং হাটুরিয়া অঞ্চলে পথসভায় বক্তব্য রাখেন ঋণ-মুক্তি কমিটির নবীন সামন্ত, দিলীপ দে। আড়ুপাড়ায় নেতৃত্বে ছিলেন প্রণব মণ্ডল। কামারডাঙ্গায় কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দান করেন দেবব্রত ভক্ত। এছাড়াও ঋণ-মুক্তি দিবস পালিত হয় পিপুল্যান পূর্ব-পশ্চিমে। আমতা রইদাস এলাকায় কর্মসূচীর নেতৃত্বে ছিলেন আইপোয়া নেত্রী কল্যাণী গোস্বামী, অঞ্জনা মণ্ডলরা। আমতা ১ নম্বর ব্লকে ঋণমুক্তি কমিটি বিডিওকে ডেপুটেশন দিয়ে প্রতিবাদ প্রকাশ করে।