রাজনাথ সিং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী থাকার সময় ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মীদের জন্য চালু করেন তদন্তে নৈপুণ্য দেখানোর পুরস্কার। এই পুরস্কার প্রবর্তনের উদ্দেশ্য রূপে বলা হয় “অপরাধের তদন্তে পেশাদারিত্বের উচ্চ মানকে উৎসাহিত করা।” এবারের, অর্থাৎ ২০২০ সালের জন্য এই পুরস্কারের প্রাপক রূপে গত ১২ আগস্ট ঘোষণা করা হয় ১২১ জন পুলিশ কর্মীর নাম। এঁরা হলেন বিভিন্ন রাজ্যের এবং সিবিআই, এনআইএ-র মত অপরাধের তদন্তে নিয়োজিত সংস্থার কর্মী। এই ১২১ জনের মধ্যে এমন কয়েক জনের নাম রয়েছে যাঁদের তদন্তের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এবং অভিযোগ, তদন্তে উৎকর্ষের স্বাক্ষর রাখার চেয়ে তদন্তকে বিপথগামী করতেই তাঁরা সচেষ্ট থেকেছেন।
এঁদের একজন হলেন দিল্লী পুলিশের ডেপুটি কমিশনার রাজেশ দেও যিনি কয়েক মাস আগে ঘটা দিল্লীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তদন্তে গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) প্রধান। উল্লেখ্য, দিল্লীর দাঙ্গায় কম করে ৫৩ জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন যাঁদের ব্যাপক সংখ্যাধিকই হলেন মুসলিম। দিল্লী দাঙ্গার তদন্ত নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। যাঁরা প্রকৃতই দিল্লীর দাঙ্গাকে উস্কিয়ে তুললেন, উত্তেজনাকর ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ভরা ভাষণ দিয়ে দাঙ্গার আগুন জ্বালালেন, সিট-এর তদন্তে তাদের আড়াল করে বেছে-বেছে মুসলিমদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-র মত দানবীয় আইন প্রয়োগ করে জেলে পোরা হচ্ছে। এই চক্রান্তকে সম্প্রসারিত করে আরো অনেক নিরপরাধ মানুষকে দাঙ্গায় জড়িত বলে ফাঁসানোর অভিসন্ধি সচল রয়েছে।
অনেকেই বলেছেন যে, দিল্লী দাঙ্গা নিয়ে সংখ্যালঘু কমিশনের রিপোর্টে যেখানে দাঙ্গার মূল প্ররোচনাকারী হিসাবে অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ, কপিল মিশ্রর মতো বিজেপি নেতাদের নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সেখানে সিট-এর তদন্ত দাঙ্গার সংঘটনে এদের কোনো ভূমিকাই দেখতে পায়নি। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ঢুকে পুলিশবাহিনী গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ছাত্র-ছাত্রীদের যে নির্মম প্রহার করে তার তদন্তের ভারও দেওয়া হয় রাজেশ দেওকে। লাঠিধারি পুলিশরা ছাত্রদের বেধড়ক পেটাচ্ছে, ছাত্রীরাও তাদের নির্মমতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না, এই ছবি সংবাদ মাধ্যমে ভাইরাল হলেও রাজেশ দেওর তদন্তে একজন পুলিশ কর্মীও দোষী সাব্যস্ত হয়নি।
রাজেশ দেও আর এক কীর্তির স্বাক্ষর রাখেন ফেব্রুয়ারী মাসের দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনের সময়। শাহিন বাগে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। একদিন জনৈক ব্যক্তি সেখানে শূন্যে গুলি চালান। দেও ভিত্তিহীনভাবে বলে দেন যে ওই ব্যক্তি আপ দলের সঙ্গে যুক্ত। দেওর এই মন্তব্যের জন্য নির্বাচন কমিশন তাঁকে দিল্লী নির্বাচনের কাজ থেকে সরিয়ে দেয়। নির্বাচন কমিশন বলে--দেওর এই মন্তব্য “পরিচ্ছন্ন ও অবাধ” নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করবে। দেও নির্বাচনে বিজেপির হয়ে কাজ করছেন বলে অভিযোগ তখন উঠেছিল।
এই পুরস্কারের আর এক প্রাপক হলেন বিক্রম মুকুন্দ খালাতে। ইনি তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট যাঁর ওপর রয়েছে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারীর ভীমা-কোরেগাঁওয়ের হিংসাশ্রয়ী ঘটনার তদন্তের ভার। প্রসঙ্গত, ভীমা কোরেগাঁও ঘটনার তদন্ত পুনে পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হয়। সে সময় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফ্রন্ট লাইন ডিফেণ্ডারস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল – এই হস্তান্তরের উদ্দেশ্য হল ঘটনার স্বাধীন তদন্তকে ব্যাহত করা, ঘটনার রাজনৈতিক আখ্যানকে নিয়ন্ত্রিত করা। আর তা হতে গেলে কোনো বশংবাদ পুলিশ অফিসারই অভিপ্রেত ভূমিকায় অবদান রাখতে পারেন। ভীমা-কোরেগাঁও ঘটনায় হিংসার মূল সংঘটক রূপে, দলিতদের ওপর হামলার প্রধান চক্রীরূপে সামনে এসেছিল হিন্দুত্ববাদী সম্ভাজি ভিদে ও মিলিন্দ একবোটের নাম। বিক্রম মুকুন্দ খালাতের তদন্তে কিন্তু এই দুজন হিন্দুত্ববাদীর হিংসার ঘটনায় জড়িত থাকার কোনো উল্লেখ নেই, ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়েরও হয়নি। বিপরীতে, বেছে-বেছে অভিযুক্ত করে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে জেলে পোরা হয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মীকে, যে ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আর এনআইএ গ্ৰেপ্তার হওয়া মানবাধিকার কর্মীদের জামিনের লাগাতার বিরোধিতা করে চলেছে। ভীমা-কোরেগাঁও মামলা বিরোধী কন্ঠস্বরকে দমন করা এবং সরকারের সমালোচক ব্যক্তিত্বদের আক্রমণের নিশানা বানানোর বিজেপির দুরভিসন্ধিরূপেই অভিহিত হয়ে থাকে।
তদন্তে উৎকর্ষের নিদর্শন রাখার জন্য পুরস্কারের আর এক প্রাপক হলেন মহারাষ্ট্রের পুলিশ অফিসার শিবাজি পাওয়ার। ইনি ২০১৭-র ৩১ ডিসেম্বরের এলগার পরিষদের সভা নিয়ে (বিজেপি ও পুলিশের মতে এই সভাই নাকি ভীমা-কোরেগাঁও-এর হিংসাত্মক ঘটনার জন্য দায়ী) তদন্ত করেন। ভীমা-কোরেগাঁওয়ের ঘটনার তদন্ত সে সময় পুনে পুলিশই করেছিল, আর তখন মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায় ছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। শিবাজি পাওয়ার যে চার্জশিট দেন তাতে অভিযোগ করা হয় – সমাজ আন্দোলনের বামঝোঁকা কর্মীরা মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হিংসা উস্কিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। এই তদন্ত চলার সময়ই “শহুরে নকশাল” অভিধা চালু হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর মন্ত্রকই এই পুরস্কার প্রাপকদের চিহ্নিত করেছে। তাদের নাম ঘোষণার পর অমিত শাহ পুলিশ কর্মীদের অভিনন্দন জানিয়ে একটি টুইট করে বলেন — “ন্যায় বিচার প্রদানে এক পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। … এটা আমাদের পুলিশ কর্মীদের অসাধারণ সেবা ও অঙ্গীকারের স্বীকৃতি। ভারত তাদের জন্য গর্বিত!”
যে ১২১ জন পুরস্কার প্রাপককে বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে বোধকরি এমন কেউ-কেউ রয়েছেন যাঁরা কর্মক্ষেত্রে সত্যিই কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু যে তিন জনের কথা ওপরে উল্লেখ করা হল তাঁরা এক ভিন্ন গোত্রের। নিজেদের কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়ার চেয়ে (যেটার মধ্যে দিয়েই দেশের সেবা সবচেয়ে ভালোভাবে করা যায়) বিজেপির দুরভিসন্ধিকে চরিতার্থ করতেই তাঁরা সচেষ্ট থেকেছেন বলে সুস্পষ্ট হয়েছে। সঠিক বিচারে এঁদের কাজ দেশের ও জনগণের স্বার্থের সহায়ক হওয়ার বিপরীতে চরম অনিষ্টেরই পরিচায়ক। আজ দেশজুড়ে স্বৈরাচার কায়েমের যে আয়োজন পুরোদমে চলছে, এঁদের কাজ সেই প্রক্রিয়ায় ইন্ধনই জোগাচ্ছে। এই পুরস্কার প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য যে বিজেপি অনুগত পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা তা একেবারেই স্বচ্ছ। এই ধরনের পুলিশ কর্মীদের পুরস্কৃত করে অন্যান্য পুলিশ অফিসার ও কর্মীদের কাছে এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে যে – প্রকৃত ঘটনা যাই হোক, বিজেপি যেমন চায় তদন্তের ফলাফল তেমন হলে তাদের বিজেপি-সেবা স্বীকৃতি পাবে এবং পুরস্কার থেকেও তারা বঞ্চিত হবে না!
-- জয়দীপ মিত্র