বিপন্ন শ্রমজীবী মানুষ, নির্বিকার সরকার
gee

রাজ্য প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে এ রাজ্যের কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে গোষ্ঠী সংক্রমণ। শুধু এ রাজ্যেই নয়, কেরল ও তেলেঙ্গানার বেশ কিছু জায়গায়ও গোষ্ঠী সংক্রমণের রিপোর্ট স্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ঠ রাজ্যের প্রশাসন। প্রতিদিন দেশে, এ রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, আর পাল্লা দিয়ে উন্মোচিত হচ্ছে গণস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর নিদারুণ দেউলিয়াপনা। অসহায় প্রশাসন লকডাউন ও আনলকের যুগপৎ কৌশল নিয়ে এই সঙ্কটকে মোকাবিলা করছে, আর পুরো বিষয়টাকে আইন শৃঙ্খলার আতস কাঁচে দেখতে গিয়ে পুলিশের উপর ন্যস্ত করছে প্রভূত ক্ষমতা। লাঠিধারী উর্দিবাহিনী সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে বিভিন্ন জায়গায় নামিয়ে আনছে দমন, মাত্রাছাড়া অত্যাচার। সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রীতিনীতিকে শিকেয় তুলে সামনে আনা হয়েছে ঔপনিবেশিক জমানার ‘মহামারী রোগ আইন ১৮৯৭’, ও ‘বিপর্যয় মোকাবিলা আইন ২০০৫’-এর এক বিচিত্র মিশেল, যার মাধ্যমে প্রশাসন নিজের হাতে কুক্ষিগত করছে অবাধ ক্ষমতা। অতিমারির অজুহাতে সংকুচিত করা হয়েছে গণপরিসর। যে কোন জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে কড়া হাতে মোকাবিলা করা হচ্ছে। পশ্চিমবাংলাও সেই পথে হাঁটছে। মোদীর বেসরকারীকরণ ও জনবিরোধী শ্রমনীতি ও শিল্পনীতির বিরুদ্ধে বা কবি ভারভারা রাও সহ খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদী বিক্ষোভও মমতার প্রশাসন বরদাস্ত করছে না।

lat

 

এই আনলক পর্বে সবচেয়ে বিপন্নতার মুখে পড়েছে শ্রমজীবী তরুণ প্রজন্ম, যাদের নানা ঝুঁকি নিয়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দিতেই হচ্ছে। পরিবহন শ্রমিকরা আক্রান্ত হচ্ছেন, মারাও যাচ্ছেন। আশা কর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালক, বেসরকারী সংস্থার স্বাস্থ্যকর্মী, সাফাই কর্মী, পৌরসভার আপৎকালীন বিভাগের কর্মী সহ গিগ বা অ্যাপস-নির্ভর কর্মীবাহিনী, যারা বর্তমানে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ, তাঁরা আজ রীতিমতো বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। আর্থিক কর্মকান্ড শুরু করার সময়ে সরকার ও নিয়োগকর্তার তরফ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার যে প্রোটোকল অনুসরণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, আজ তা রাতারাতি উধাও। এব্যাপারে রাজ্য সরকারের বিন্দুমাত্র নজরদারি, তদারকি নেই। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যার বড় একটা অংশই করোনার কো-মর্বিডিটির শিকার। ভারতে ১৫-২৯ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা প্রায় ৩৯ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ত্রিশ শতাংশ। এটা গোটা বিশ্বের নিরিখে সর্বাধিক। কিন্তু এই কর্মক্ষম বিশাল তরুণবাহিনী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নন। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে এঁদের মধ্যে অনেকেই ত্রিশের কোঠা পেরোতে না পেরোতেই অকাল বার্ধক্যের কবলে পড়ছেন, উচ্চ রক্তচাপ-ডায়াবেটিস-হার্টের নানা অসুখে ব্যতিব্যস্ত। বিদেশেও দেখা গেছে কোভিডের কারণে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় সেই দেশে বসবাসকারী দক্ষিণ এশিয়দের মৃত্যুহার প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। অথচ, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তাঁদের গড় বয়স কম। কিন্তু রক্তে শর্করার পরিমাণ অত্যধিক। করোনার মতো অতিমারির ক্ষেত্রে এই অসুখগুলোর জন্য মৃত্যুহার অন্তত ৫০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে, বিশেষজ্ঞরা তা আগেই সতর্ক করেছেন। এখন, আমাদের দেশে মধ্যবয়সীদের অধিক মৃত্যুহার সেই আশঙ্কাকেই প্রমাণিত করলো। গোটা বিশ্বে অল্প বয়সিদের মানব সম্পদের মধ্যে (যাকে বলা হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট) ভারত পয়লা নম্বরে থাকলেও বাস্তবে সেই মানব সম্পদই এক গভীর বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে।

sts

 

আইএলও তার নীতি ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে নিরাপদ ও রোগ-প্রতিরোধী কর্মক্ষেত্র, যেখানে কর্মীরা আশঙ্কামুক্ত হয়ে নির্ভয়ে কাজ করতে পারবেন। সর্বোপরি, সমস্ত পক্ষকে নিয়ে ঐকান্তিকভাবে পারস্পরিক আদানপ্রদান, মতবিনিময় করে সমস্যা নিরসনে যে পারস্পারিকতার কথা বলেছে, তা আমাদের রাজ্যে, গোটা দেশে নিদারুণভাবে উপেক্ষিত। গোটা সমাজকে সাথে নিয়ে এই যুদ্ধে না নামলে তা কখনোই জেতা যাবে না। আমাদের শাসকেরা কি আদৌ কখনও তা উপলব্ধি করবে!

খণ্ড-27
সংখ্যা-27