অবশেষে শোনা গেল প্রকৃত সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের এক বিচারের বাণী। প্রত্যাশার পারদ বোধহয় ছিল না। কারণ চারপাশে ঢল এখন বিচারের নামে প্রহসন ও পীড়নের। এই পরিস্থিতিতে বম্বে হাইকোর্টের এক রায় ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত দেখালো। রায় প্রসঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, তবলিঘি জামাতের মারকেজ জমায়েতকে কোভিড ছড়ানোর জন্য দায়ি করা অন্যায়ই হয়েছিল। তার পেছনে কাজ করেছিল ক্ষমতার রাজনীতিপ্রসূত এক অসূয়া, এক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বিদ্বেষ প্রণোদিত পরিকল্পনা। বিপর্যয়কর অতিমারী অবস্থা দেখা দিতে থাকে। প্রথাগত জমায়েতটিও ছিল সরকারের জানা বিষয়, পূর্ব নির্ধারিত। তাতে বিদেশ থেকেও কিছু মুসলিম এসেছিলেন। সরকার বিদেশীদের আসা বন্ধ করেনি, জমায়েতেরও অনুমোদন দেয়। তবু ঊনত্রিশ জনের বিরুদ্ধে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। আগস্ট মাসে যখন রায় বেরোচ্ছে ততদিনে ভারত কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ত্রিশ লক্ষ। আক্রান্তের মধ্যে রয়েছে শ্রেণী, জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। অন্যদিকে বিগত মার্চ মাসে তবলিঘি জমায়েতে মোট লোকসংখ্যা ছিল দুই সহস্রাধিক, তার বেশি নয়। অতি সামান্য কিছু সংখ্যক বিদেশী ছাড়া তারা সব এসেছিলেন দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে। এক বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত এত সীমিত সংখ্যক লোকজনের পক্ষে সর্বব্যাপী এত ব্যাপক লোকের করোনা আক্রান্তের কারণ হয়ে ওঠা বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার ছিল না, আদালতে তার প্রমাণও মেলেনি। গুজব ছড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং এক শ্রেণীর মিডিয়া মিলে। কোভিডের আগমন ঘটেছিল বিদেশ থেকে আসা বিমান যাত্রীদের মাধ্যমে। সে সময়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত অনেক লোকজনও বিদেশ থেকে আসছিলেন, এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করেছেন, পরীক্ষা না করিয়ে গন্তব্যে চলে গেছেন, পরে তাদের বহুজনেরই কোভিড পজিটিভ চিহ্নিত হচ্ছিল, কিন্তু সরকার কখনই তার জন্য সম্প্রদায়ের কথা তুলে তুলোধোনা করেনি, হল্লা করেনি। ডিভিশন বেঞ্চ শাসকের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের দৃষ্টিকোণ উন্মোচিত করতে সিএএ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গের অবতারণা করেছে। এই আইনগত সংশোধনীর মুসলিম বিরোধী সারবিষয়ের বিরুদ্ধে মুসলিম জনগণ উত্তাল হন। নাগরিকত্ব প্রদানে ধর্মীয় বৈষম্য প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনে পথে নামেন। এর প্রতিশোধ নিতেই ঐ পুলিশী-প্রশাসনিক সন্ত্রাস সৃষ্টির পদক্ষেপ করা হয়েছিল। এটা বুঝিয়ে দেওয়ার কুৎসিত প্রয়াস চালানো হয়েছিল যে, মুসলিম জনগণের ওপর যে কোনও সময়ে যে কোনো অজুহাতে এরকম দমন নামিয়ে আনা হতেই পারে। ঘটনা হল, ধৃত বিদেশীদের বিরুদ্ধে ভিসার সময়সীমা লঙ্ঘনের ভূয়ো অভিযোগ সহ ভারতীয় ফৌজদারী আইন, অতিমারী সংক্রমণ আইন ও বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের মতো দমনমূলক আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। ডিভিশন বেঞ্চ আরও মন্তব্য করেছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে যে অপরাধ করেছে সরকার, তার কোনও পরিবর্তনের মানসিকতা এখনও লক্ষ্যণীয় নয়, তবে তার চূড়ান্ত সময় কিন্তু পার হয়ে যাচ্ছে। এই হুঁশিয়ারী যাদের বিশেষ উদ্দেশ্য করে দেওয়া, সেই মহারাষ্ট্র সরকার ও তার পুলিশের এহেন ‘কাজ’ দেখানোর কোনও অজুহাত ধোপে টেঁকে না, কারণ উপলক্ষের উৎসস্থল ছিল মুম্বাইয়ে নয়, দিল্লীতে। তবু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযানে নামে মহারাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ। তার পেছনে বিশেষ কারণ হল সাম্প্রদায়িক গাত্রদাহ। মহারাষ্ট্র সরকারের কুকীর্তির শেষ নেই। বরাবর সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের স্বার্থবিরোধী; মানবাধিকার বিরোধী। ‘ভীমা কোরেগাঁও’ মিথ্যা মামলা সাজিয়েছে, আর সেই অজুহাতে দেশের বিভিন্ন অংশে কর্মরত বেশ কিছু সমাজবিজ্ঞান কর্মী ও মানবাধিকার আন্দোলনের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের বন্দী করে রেখেছে।
বম্বে হাইকোর্টের রায় দেশের ধর্মনিরপেক্ষ জনগণের দেওয়াল লিখন ও বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনের কথার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। মহারাষ্ট্রের শিবসেনার শরিকানার সরকার পন্থা নেয় কেন্দ্রের মোদী সরকারেরই। আর, গোটা দেশের অসংখ্য ঘটনা সাক্ষী, আরএসএস পরিচালিত বিজেপি জমানা করোনার অতিমারী পরিস্থিতিতেও কীভাবে ফ্যাসিস্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে আসছে। কীভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণকে আর্থ-সামাজিক জীবন থেকে কোণঠাসা জীবন্মৃত করে রাখার অপরাধ করে আসছে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। প্রতিবাদে প্রতিরোধে গড়ে উঠছে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার এক নতুন দেশচেতনা জনচেতনা। একে সংগঠিত ও সর্বব্যাপী করার চ্যালেঞ্জ থাকছে। এই চলার পথে বম্বে হাইকোর্টের রায় অবশ্যই এক সহায়তা পাওয়া।