করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে ভারতের অর্থনীতির কোনোকিছুই আর আগের মতো নেই। গ্রাস করছে উত্তরোত্তর মন্দা। কর্মসংস্থান উধাও হয়েছে ব্যাপক হারে। যে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকরা রাতারাতি কাজ হারা হয়েছিলেন তাদের কত শতাংশ আবার কাজ ফিরে পেয়েছেন, অন্য পেশায় ছিটকে গেছেন, শূন্য হাতে রয়ে গেছেন, তার কোনও তথ্য সংগ্রহের কাজে কেন্দ্রের মোদী সরকার হাত লাগিয়েছে কি? যদিও এদের বিকল্প কর্মসংস্থান করার নামে এক অতি সীমিত মাত্রার ‘গরিব কল্যাণ যোজনা প্রকল্প’ নামিয়েছে, তবু সমস্ত রাজ্য সরকারগুলোকে একাজে নামাতে বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে কি? না। মোদী সরকার সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে উপরন্তু আরও অসৎ আচরণ করে চলছে। অতিমারী আর লক ডাউনের সুযোগ নিয়ে সরকারি সম্পদ বেচার রাস্তা নিয়েছে। বিশেষ করে কয়লা খনি, বিমান বন্দর, রেল ও প্রতিরক্ষার মতো সরকার নিয়ন্ত্রিত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর বেসরকারিকরণ ঘটিয়েছে। লোকসানের অবসান ঘটিয়ে লাভজনক পুনরুজ্জীবনের নামে আর সরকারি কোষাগারকে ঘাটতি মুক্ত করে তোলার অছিলায় উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলোর বাজারী হস্তান্তরের পদক্ষেপ করেছে। যা কর্মসংকোচনের মাত্রাকে আরও অনিবার্য করে তুলবে। বাড়বে আরও বেকারি।
কেবলমাত্র প্রথম দুটি পরপর লক ডাউনের পরিণামে মেহনতি অংশগুলোর কাজ খুইয়ে মজুরি ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। ২৫ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম লক ডাউন পর্বে কাজ চলে যাওয়া সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৬০ লক্ষ, তারপর ১৪ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত দ্বিতীয় লক ডাউন পর্বে কাজ হারা হয়েছিলেন ৭ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ। এই ছিল যেখানে লক ডাউনের গোড়ার দিকের বেকারির চিত্র, লক ডাউন পূর্ববর্তী বেকারির গোদের ওপর লক ডাউন শুরুর সময়কার বিষফোঁড়ার রেখাচিত্র এবং যার ৯০ শতাংশই অপ্রচলিত ক্ষেত্রের, তাহলে তার পরের চারমাসের ধাক্কায় কাজ ছাঁটাইয়ের পরিণাম কী বিভীষিকাময় দাঁড়িয়েছে ভেবে ওঠা যায়! রাজ্যভিত্তিক এবং গ্রাম ও শহর ভিত্তিক তারতম্য রয়েছে বটে, কিন্তু বেকারি বাড়ছে সর্বত্র। মোদী সরকার এ প্রসঙ্গে নিয়েছে নীরবতার কৌশল।
সিএমআইই-র সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ১৬ আগস্ট পর্যন্ত বেকারি পৌঁছেছে ৯ শতাংশে। লক ডাউন শুরু হওয়ার আগে বেকারি ছিল ৮.৪১ শতাংশ। তারপর প্রাক পাঁচ মাসে বেকারি পৌঁছেছে ৯.১ শতাংশে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই বৃদ্ধির পরিমাণ ১.৬০ শতাংশ। ৯ আগস্ট পর্যন্ত বেকারি ছিল ৮.৬৭ শতাংশ। তার মাত্র সাত দিনের মধ্যে তা উঠে গেল ৯.১ শতাংশে! বৃদ্ধির ভাগ সাতদিনে ০.৩৪ শতাংশ! লক ডাউন শুরুর দ্বিতীয় পর্বের মধ্যেই সিএমআইই অশনি সংকেত দিয়েছিল। পয়লা দফায় শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ চলে যাবে ১৪ কোটি মানুষের। এখন কেবল পর্যটন শিল্পে লক্ষ্যণীয়, কাজ চলে গেছে ৫.৫ কোটি মানুষের। এর সাথে বিমান পরিষেবা, রেল ইত্যাদি ক্ষেত্রে বড় সংখ্যায় কাজ চলে যাওয়ার পাকচক্র রয়েছে। এরপর মন্দা যত স্থায়ী হবে, সরকারি বিনিয়োগ যত কমতে থাকবে, বিমুখ থাকবে, বেসরকারিকরণ যত বাড়তে থাকবে, ততই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ আরও ছাঁটাই হবে, সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের আরও সংকোচন ঘটবে। সব মিলে কাজের বাজারে সৃষ্টি হবে হাহাকার অবস্থা।
পশ্চিমবাংলার বেকারির সর্বশেষ হিসাব সিএমআইই যা দিয়েছে তা গত জুন মাসের। তখন রাজ্যের বেকারির হার ছিল ৬.৫ শতাংশ। যা উল্লেখ করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন এখানে বেকারি জাতীয় গড়ের চেয়ে কম। একথা বলে মুখ্যমন্ত্রী আত্মপ্রচার করতে পারেন, কিন্তু তাতে বেকারি বৃদ্ধির প্রবণতা কমার নয়।
মোদী সরকার কাজের বাজার তৈরি হওয়ার দিকনির্দেশ করছে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য ঋণ প্রকল্প সুলভ করার কথা শুনিয়ে। কিন্তু সাধারণভাবে কোথাও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ঋণ নেওয়ার বিশেষ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হচ্ছে না। এই অনাগ্রহের মূল কারণ রয়েছে বাজারে সাধারণ ক্রেতাসমাজের চাহিদার অভাব লক্ষ্য করার মধ্যে। কারণ, কেনার ক্ষমতা প্রচুর কমে গেছে, কাজ নেই তাই। এই দুরাবস্থা ঘোরানোর একমাত্র উপায় হল পর্যাপ্ত সরকারী বিনিয়োগের জন্য বড় মাত্রায় উদ্যোগ গ্রহণ। কিন্তু মোদী সরকার সে কথা কানে তুলছে না, দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে অবতারণা করছে নানা চমকে মোড়া চালাকির। যেমন, নয়া শিক্ষানীতি উপলক্ষে বলতে শুরু করেছে, শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য কর্মপ্রার্থী তৈরি করা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা শেষে নিজেদেরই সক্ষম হয়ে উঠতে হবে কর্মক্ষেত্র তৈরির!