পাঁচ মাস হয়ে গেল লকডাউন-আনলকের অবিরাম প্রক্রিয়া চলছে। লকডাউন বলবৎ রাখতে কত অর্থনৈতিক মূল্য চোকাতে হচ্ছে তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হল। অর্থনীতির গতি এমনিতেই মন্থর হয়ে আসছিল, এখন লকডাউনের ফলে সরাসরি সংকোচন শুরু হয়েছে যা প্রান্তিক মানুষদের কাছে বেঁচে থাকার সংকট হিসেবে নেমে আসছে।
এর সঙ্গে, কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বেড়ে চলা স্বাস্থ্য সংকট, ভয়, উদ্বেগ এবং সামাজিক অস্পৃশ্যতার বিষয় যুক্ত হয়ে, আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে এক গভীর সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু সেই বিপর্যয়ের অন্তরালে চুপিসারে ঘনিয়ে আসছে আরও এক বিপজ্জনক সংকট – ভারতীয় গণতন্ত্রের সংকট।
অর্থনীতির মতোই গণতন্ত্রও বিগত কয়েকবছর ধরে নিরন্তর আক্রমণের মুখে। গণতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তিকে কার্যনির্বাহী বিভাগ ক্রমাগত প্রহসনে পর্যবসিত করে চলেছে এবং বিধানিক ও বিচার বিভাগীয় অঙ্গ তাকে নিয়ন্ত্রণের কোনও সদর্থক ইচ্ছা বা সক্ষমতা দেখাচ্ছে না। রাষ্ট্রের পীড়নমূলক হাতিয়ারগুলি প্রতিবাদকে এমনভাবে অত্যাচারিত করছে যা দেখলে আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভুরাও গর্ববোধ করতেন।
গণতন্ত্র এখন লকডাউন মোডে চলে গেছে। কাশ্মীরে দীর্ঘদিন ধরেই এই মোড স্থায়ী ছিল, এবং শেষ এক বছরে তা ঘোষিতভাবেই আছে, এখন গোটা দেশ জুড়েই ছড়িয়ে গেছে এই লকডাউন। এই লকডাউন মোডে সংসদে আলাপ আলোচনা বা পর্যালোচনা ছাড়াই বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি মন্ত্রীসভা, বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে যেভাবে ঘোষিত হচ্ছে তা সংসদকে এক প্রতীকসর্বস্ব বাহুল্যে পর্যবসিত করার হুমকির মুখে এনে ফেলেছে ।
প্রতিবাদ ও অভিযোগ জানানোর স্বাভাবিক রাস্তাগুলিও এই লকডাউন মোডে বন্ধ। সাধারণ জনগণকে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার অনুশীলন থেকে আটকে রেখে রাষ্ট্র এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করছে মানুষকে গৃহবন্দী বা কারাবন্দী করে, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে, বিরোধিতার 'অপরাধের' শাস্তি প্রদানের জন্য।
সরকার ইতিমধ্যেই এক আগ্রাসী বেসরকারীকরণ অভিযানের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে যা “আত্মনির্ভর ভারত”-এর ছদ্মবেশে কর্পোরেটদের সামনে খুলে দেবে গোটা অর্থনীতির দরজা, একাধিক রাজ্য সরকার শ্রমিকের জরুরি অধিকারগুলিকে সংকুচিত করছে, পরিবেশ মন্ত্রক পরিবেশ সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতি পর্যালোচনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মতামত গ্রহণকেই নাকচ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, কৃষি উৎপাদন ও তা বাজারজাতকরণের সমগ্র প্রক্রিয়ার ওপর কর্পোরেটদের নিরঙ্কুশ কব্জা কায়েম করতে একটার পর একটা অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, এবং একটি নতুন শিক্ষা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে যা শিক্ষায় প্রবেশ ও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করার বদলে শিক্ষা জগত থেকে ছাত্রছাত্রীদের বেরিয়ে যাওয়া ও বহিস্কার করার রাস্তা খুলে দেবে।
কোভিড-১৯ প্রতিহত করবার প্রোটোকল অনুযায়ী সকল প্রকার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জমায়েত নিষিদ্ধ। অথচ অযোধ্যায় ভূমি পূজনে গিয়ে যোগ দিল সরকার। একে সরকারি অনুষ্ঠানে পরিণত করা হল এবং এই প্রথমবার একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ঊর্দ্ধে তুলে ধরার শপথ নিয়েছেন তিনি গেলেন একটি মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে।
গুরুতর শারীরিক সমস্যাগ্রস্ত যেসব বয়স্ক নাগরিক জেল বন্দী রয়েছেন (যেমন ভারাভারা রাও, জি এন সাইবাবা, সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজ – অনেকের মধ্যে চারটি নাম) তাঁদের মুক্তি দেওয়ার বদলে আরো তিনজন শিক্ষাবিদ ও লেখককে (আনন্দ তেলতুম্বড়ে , গৌতম নভলাখা, হানি বাবু) গ্রেপ্তার করা হয়েছে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় এবং আরো অনেকের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, যদিও ঘটনার প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীরা শাস্তি পাওয়ার বদলে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
একইভাবে দিল্লিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হিংসার সমগ্র তদন্তকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে পর্যবসিত করা হয়েছে। যেসব বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে হিংসা উসকেছিল তারা তদন্তের আওতার বাইরে, আর গ্রেপ্তারি ও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে ছাত্র আন্দোলনের কর্মী, শিক্ষাবিদ ও সুপরিচিত রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের।
এই সময়কালে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেগুলিতে সাধারণ মানুষকে চরম অন্যায়ের শিকার হওয়া থেকে বাঁচাতে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করতে পারত। ভারতের পরিযায়ি শ্রমিকদের যে নির্মমতার শিকার হতে হল, লকডাউনের মধ্যে যেভাবে পুলিশের নৃশংস আঘাতের মুখে পড়ল অসহায় মানুষ, ইউপি পুলিশের ঝুটা সংঘর্ষ-হত্যার মনগড়া কাহিনী — এসব প্রশ্নে আমরা সুপ্রীম কোর্টকে মুখ খুলতে দেখিনি, কিন্তু জনস্বার্থ রক্ষাকারী বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের দুটো ট্যুইটে সেই সুপ্রিম কোর্টই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল এবং তাঁকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা হল। সমালোচনা এবং অবমাননার মধ্যেকার পার্থক্য যদি সুপ্রীম কোর্ট বুঝতে না চায় তাহলে বিরোধিতার অধিকার বিপন্ন হয়ে পড়বে। আর বিরোধিতার অধিকার বিপন্ন হওয়া মানেই গণতন্ত্র তার অর্থ হারাবে।
যখন সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে, রাজনৈতিক জমায়েতের উপর কোভিড সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা জারী রয়েছে, মানুষ কোনোভাবে মহামারী, বন্যা এবং লক ডাউনের ত্রিমুখী আঘাতের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, তখন ছাত্রদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পরীক্ষার মুখে আর বিহারের মতো রাজ্যে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিধানসভা নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন সম্ভবত মনে করেন একটি মহামারীও হয়তো নির্বাচন পেছানোর জন্য যথেষ্ট বিপর্যয় নয়, সুতরাং মহামারীর এই ভীষণ পরিস্থিতির মধ্যেও ডিজিট্যাল পোলিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে বিহারকে।
সংসদীয় ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে বেড়ে চলা স্বৈরাচারী শাসন, শাসক দলের নির্দেশে বল্গাহীন পুলিশী সন্ত্রাস, প্রকৃত অন্যায় ও সাংবিধানিক বিধিলঙ্ঘনের ঘটনাগুলি থেকে চোখ সরিয়ে রাখা বিচার ব্যবস্থা, এবং জনগণের বেঁচে থাকা বা অংশগ্রহনের কোন তোয়াক্কা না করে চাপিয়ে দেওয়া পরীক্ষা বা নির্বাচন — এইসবই ভারতীয় গণতন্ত্রের লকডাউন মোডের নিশ্চিত লক্ষণ।
সরকার যে সানন্দে এই লকডাউন অনন্তকাল প্রসারিত করতে চাইবে তা স্বাভাবিক। প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়া আমাদের বলছে জনগণও নাকি এতে বেজায় খুশী। একটি প্রখ্যাত মিডিয়া হাউস এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী আগের থেকেও অনেক বেশি জনসমর্থন (৭৮%) ভোগ করছেন বলে ওপিনিয়ন পোল তুলে ধরেছে।
মিডিয়া প্রচারের এই ঢক্কানিনাদের বাইরে প্রতিবাদ ও গণতন্ত্র কিন্তু যথেষ্ট মাত্রায় সজীব রয়েছে আজও। জনগণ তাকে আগলে রেখেছেন। রাষ্ট্রের বলে দেওয়া ‘বাড়িতে থাকুন’ এবং পুঁজির বলে দেওয়া ‘বাড়িতে থেকে কাজ করুন’-এর সঙ্গে ভারতবর্ষের মানুষের নতুন সৃজনশীল সংযোজন ‘বাড়িতে থেকে প্রতিবাদ করুন’।
কয়লা খনিগুলি বেসরকারী মালিকের হাতে তুলে দেওয়ার সরকারী ঘোষণার বিরুদ্ধে কয়লা খনির শ্রমিকরা তিন দিন ব্যাপী ধর্মঘটে নেমেছে। কৃষিতে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর অর্ডিন্যান্সগুলির বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে শক্তিশালী কৃষক প্রতিবাদ। ‘আশা’ কর্মীরা, যারা পিপিই কিট এবং নূন্যতম সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার ছাড়াই ভারতবর্ষে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন, অন্যান্য প্রকল্প কর্মীদের সঙ্গে মিলে দুদিনের স্ট্রাইক সংগঠিত করেছেন।
মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলির সুদে জর্জরিত মহিলারা সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আন্দোলন করছেন ঋণের ফাঁদ থেকে মুক্তির দাবিতে। ৯ আগস্ট ও ১৫ আগস্ট শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রছাত্রীরা হাতে হাত ধরে শপথ নিয়েছেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ঐতিহ্য এবং গণতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামোকে বাঁচিয়ে রাখার, দেশকে বাঁচিয়ে রাখার।
মাস্ক ও স্যানিটাইজার হয়তো সর্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর পরিচয়চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বিরোধিতাকে স্যানিটাইজ করে গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করার জন্য মাস্ক পরানো অনির্দিষ্ট লকডাউন জনগণ কখনোই মেনে নেবেন না। গণতন্ত্রকে আনলক করতেই হবে।
-- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
(ন্যাশনাল হেরাল্ড ওয়েব পোর্টালে ২২ আগস্ট ২০২০ প্রকাশিত, বাংলা অনুবাদ: অত্রি)