বাকস্বাধীনতা হরণ ও গণতন্ত্র হরণের নিরিখে বিজেপি শাসনাধীন ভারত ক্রমশ ধিক্কৃত রাষ্ট্রে পর্যবসিত হচ্ছে
aaa

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল নাইনটিন’ একটি প্রেস বিবৃতিতে ভারতের ৭৪তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের সঙ্কট এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্রমাগত অবনতি সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায় যে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ভারত ২০১৯ সালের  অবস্থান থেকে ২ ধাপ পিছিয়ে ২০২০ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২তম স্থানে নেমে গেছে। আরও অন্যান্য কারণের সাথে জম্মু ও কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা রদ করার পর সেখানে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, অধিকারকর্মীদের উপর দমন-পীড়ন এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার কারণে ভারতের বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ক্রমাবনতি হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট সম্প্রতি কাশ্মীরকে গণমাধ্যমের জন্য ‘বিশ্বের সবচেয়ে দমনকারী জায়গা’ বলে অভিহিত করেছে।

বিবৃতিতে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন: ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো একটি গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি। নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন, ২০১৯ (সিএএ) ভারতের সংবিধানের মূলভিত্তি ও চেতনার পরিপন্থী। ভারতীয় সংবিধানের ৫ থেকে ১১ অনুচ্ছেদে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি ও সংস্কৃতির ভিন্নতা নির্বিশেষে সাধারণ নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। অধিকন্তু, সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “রাষ্ট্র সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার অস্বীকার করবে না। এতে জোর দেওয়া হয়েছে যে ১৪ অনুচ্ছেদ কেবল নাগরিকদের জন্যই নয়, ‘ভারতের ভূখণ্ডের সমস্ত ব্যক্তির জন্য’ প্রযোজ্য”।

ফারুখ ফয়সল আরও বলেন, “ভারতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়েই চলেছে। প্রতিবাদ সমাবেশ আন্দোলনের খবর প্রকাশ অথবা প্রচার করার জন্য ক্ষমতাসীন বিজেপি সমর্থক এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা সাংবাদিকদের উপর হামলা করছে। ভিন্নমত পোষণকারীদের দেশবিরোধী আখ্যা দিয়ে দমন করা হচ্ছে। আইনের শাসনের অভাব, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, বাক-স্বাধীনতার চর্চাকারীদের উপর আঘাত, ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে”।

সাংবাদিকদের হত্যা, তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং হয়রানির প্রতিবিধান না করা বা দোষীদের বিচারের আওতায় না আনার উপর নির্ভর করে তৈরি সূচক অনুযায়ী ভারত বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে ১৩তম স্থানে চলে এসেছে। নারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় ভারত হল তৃতীয় সর্বোচ্চ দেশ। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা, কর্মপরিকল্পনায় অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে সাংবাদিকসহ যারাই কথা বলছেন তারাই হামলা-মামলা এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সিএএ এবং নাগরিক নিবন্ধন পঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের প্রবণতা দেখা গেছে। বিশেষত জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হামলা, গুলি, যৌন হয়রানির  ঘটনা ঘটেছে। এই বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে মুসলিম পাড়া-মহল্লায় হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত এবং শত শত আহত হয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে। এই ধরনের ঘটনায় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতায় গর্বিত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।  

জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া (জেএমআই) বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সফুরা জারগারকে সিএএ এবং এনআরসি বিরোধী আন্দোলন করার কারণে সন্ত্রাস-বিরোধী আইন এবং বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ আইন ২০১৯-এর (ইউএপিএ) অধীনে মামলা দিয়ে গর্ভাবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং বারবার তার জামিন নাকচ হয়ে যায়। মানবাধিকার সংস্থা, সুশীল সমাজ এবং অধিকারকর্মীদের কয়েক মাসের আন্দোলনের পর অবশেষে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত যেখানে ভারতে প্রতিবাদ এবং মতপ্রকাশের অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সেখানে একজন সন্তান সম্ভবা মাকে করোনার মধ্যে গ্রেপ্তার এবং আটক করা হয়েছে।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কঠোর এবং বৈষম্যমূলক নিষেধাজ্ঞাগুলি আরোপ অব্যাহত রেখেছে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ অনুচ্ছেদে প্রদেশটিকে আধা-স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিলো। আইন করে এই অধিকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ  সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে। এরপর অঞ্চলটিতে ব্যাপক সামরিকীকরণ, ল্যান্ডলাইন, ব্রডব্যান্ড, মোবাইল ফোন, রোড ব্লক এবং পরিবহন পরিষেবা স্থগিতের ফলে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ পুরো পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জম্মু ও কাশ্মীরে সাংবাদিকদের হয়রানি এবং হুমকি অব্যাহত রয়েছে এবং নতুন মিডিয়া নীতিমালা ২০২০-এর মাধ্যমে সেখানে সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা হয়েছে।

বিবৃতিটিতে ‘আর্টিকেল নাইনটিন’ ভারত সরকারকে ধর্মনিরপেক্ষতা, আইনের শাসন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যে কোনো লঙ্ঘনের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-29