২৬ জুলাই ২০২০ ছিল ধূর্জটি প্রসাদ বক্সীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের দিনগুলি থেকে শুরু করে ধাক্কা-পরবর্তীতে পার্টির পুনর্গঠন ও বহুমুখী কার্যকলাপের বিকাশে তাঁর সৃজনশীল অনুশীলন তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। আর, পার্টি ও তার সমস্ত গণসংগঠনগুলির কয়েক প্রজন্মের অসংখ্য কর্মীর মনের মানুষ হয়ে কতটা গভীরে নীরবে তিনি ব্যাপ্ত হয়ে ছিলেন তা তাঁর প্রয়াণের পরই আমরা উত্তরোত্তর উপলব্ধি করতে পেরেছি। এই দ্বিতীয় বার্ষিকিতে বাংলা, আসাম, ওড়িশা তো বটেই, উত্তর ও দক্ষিণ ভারত জুড়েও, বিভিন্ন স্তরে তাঁর স্মরণে কমরেডদের স্বতস্ফুর্ত কর্মসূচী সংগঠিত হয়েছে। সে সবের বিস্তারিত রিপোর্ট দেওয়ার বদলে, “কমরেড প্রণবদাকে স্মরণে রেখে” পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের ছোট লেখাটি আমরা নীচে তুলে দিচ্ছি। - সম্পাদক মণ্ডলী
এবারের ২৬ জুলাই কমরেড প্রণবদার (ধূর্জটি প্রসাদ বক্সী) দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। অক্লান্ত এই বিপ্লবীর নকশালবাড়ি আন্দোলন অনুপ্রাণিত যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে দুর্গাপুরের রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রাবস্থা থেকেই। মারণব্যাধি ক্যান্সার দু-বছর আগে এই যাত্রার সমাপ্তি ঘটায়। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে পাঞ্জাবের মানসায় আমাদের দশম পার্টি কংগ্ৰেস অনুষ্ঠিত হয়। নিজের সহজাত সাংগঠনিক বোধ ও প্রশিক্ষণের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে কমরেড প্রণবদাই হলেন পাঞ্জাবের বাইরের প্রথম কেন্দ্রীয় নেতা যিনি মানসার ক্যাম্পে গিয়ে সেখানে থেকে ওই বিশাল কর্মকাণ্ডের আয়োজনে পাঞ্জাবের কমরেডদের সাহায্যে হাত লাগিয়েছিলেন। তবে আমরা দেখেছিলাম তাঁর শরীরে অবসাদের চিহ্ন দেখা দিতে শুরু করেছে এবং ক্যান্সারের সঙ্গে অল্প কিছুদিন লড়াই করার পর তাঁর দীর্ঘ ও ক্লান্তিহীন যাত্রার অবশেষে সমাপ্তি ঘটে সে বছরের ২৬ জুলাই।
তিনি ছিলেন এক অসামান্য সংগঠক, বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং নানান পৃষ্ঠভূমি থেকে আসা কমরেডদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় তাঁর ছিল অনায়াস পারদর্শিতা। বিক্ষুব্ধ আন্দোলনে আসাম উত্তাল হয়ে ওঠার পর্বে প্রণবদা কয়েক বছর আসামে ছিলেন, অসমিয়া ভাষায় সাবলীল দক্ষতা অর্জন করেন এবং কার্বি আংলং-এর পার্বত্য জেলা সহ আসামের বিভিন্ন অংশে পার্টির সম্প্রসারণে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। পরবর্তী বছরগুলোতে উড়িষ্যা এবং ঝাড়খণ্ডেও তাঁকে আমরা একই ধরনের ভূমিকা পালন করতে দেখি। পাঁচ দশক ব্যাপী কমিউনিস্ট জীবনে লেগেপড়ে থাকা এবং মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর দুটি বিশিষ্ট গুণ, আর এই পাঁচ দশকের মধ্যে, সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের দমনমূলক শাসনাধীন পশ্চিম বাংলার জেলেও তাঁকে কয়েক বছর কাটাতে হয়েছিল।
লেগেপড়ে থাকা এবং মানিয়ে নেওয়ার এই ক্ষমতা তিনি কিসের থেকে পেয়েছিলেন? কমরেড প্রণবদা এবং তাঁর প্রজন্মের অন্যান্যদের কাছে এগুলো ছিল আদর্শ কমিউনিস্ট গুণাবলী, যেগুলোকে তাঁরা একেবারে শুরুর দিকেই এম-এল আন্দোলনের বুনিয়াদি বৈশিষ্ট্য হিসাবে, নকশালবাড়ি ঐতিহ্যের কেন্দ্রীয় মূল্যবোধ রূপে গ্ৰহণ করেছিলেন, এবং বুনিয়াদি কমিউনিস্ট শিক্ষার অঙ্গ হিসাবে এই গুণাবলীগুলোকে নিয়েই বেড়ে উঠেছিলেন। বুদ্ধিজীবীসুলভ ঔদ্ধত্য এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী আচরণকে সম্পূর্ণরূপে ঝেড়ে ফেলা, জনগণের সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং দৃঢ়চিত্ত অধ্যবসায়ের অনুশীলনের মধ্যেই রয়েছে বিজয়ের চাবিকাঠি – এই নীতিমালাকে অঙ্গীভূত করেই তাঁরা বাঁচতে শিখেছিলেন।
দুর্গাপুর আরই কলেজের ছাত্র আন্দোলন এবং দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ পারস্পরিক প্রভাবই ছিল সেই মন্থন প্রক্রিয়া, যার মধ্যে দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছাত্র এবং ইস্পাত কারখানার শ্রমিকদের থেকে অনেক কমিউনিস্ট বিপ্লবীরই জন্ম হয়। বৈশিষ্ট্যমূলক এই লেগেপড়ে থাকা ও শৃঙ্খলা, নির্ভীকতা ও উদ্যমকে সম্বল করেই তাঁরা ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে বড় ধরনের ধাক্কার পর সিপিআই(এমএল) পার্টি ও আন্দোলনকে নতুন করে গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। এরসঙ্গে নিপীড়তদের অভ্যুত্থানের প্রাণপ্রাচুর্য ও ক্ষমতাকে যুক্ত করে ভোজপুর ও বিহার, যা ধাক্কা সামলিয়ে ভারতীয় সমাজের গভীরে শিকড় ছড়িয়ে দিতে সিপিআই(এমএল)-কে সাহায্য করে।
আসুন, প্রণবদার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে এই কমিউনিস্ট স্রষ্টা এবং সিপিআই(এমএল)-এর বিকাশে তাঁদের বিপুল অবদানকে আমরা কুর্ণিশ জানাই। দুর্গাপুরের ‘ইস্পাত গলানোর কারখানা’ থেকে উঠে আসা চার কমরেডের প্রতি আমি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি – ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে দুজন, কমরেড বিনোদ মিশ্র ও প্রণবদা, এবং অগ্ৰণী শ্রমিকদের থেকে দুজন, কমরেড অনলদা (সুদর্শন বোস) ও শান্তনু বক্সি, যাঁরা আজ আর নেই। নির্দিষ্ট এই পৃষ্ঠভূমি থেকে উঠে আসা আরও অনেকেই আমাদের কাছেপিঠে থেকে সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করছেন, এবং তাঁদের নামের উল্লেখ না করেই তাঁদের আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি।
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য