ইলিনার কথা আমি প্রথম শুনি ভিলাই গুলিকান্ডের পরে ছত্তিসগড়ে গিয়ে। সময়টা ছিল ১৯৯২ সাল, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ। ভিলাইতে ছত্তিসগড় মুক্তি মোর্চা-র ডাকে শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ রেল-অবরোধের ওপর তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের – ছত্তিসগড় তখনও আলাদা রাজ্য হিসাবে গঠিত হয়নি – বিজেপি সরকার – মুখ্যমন্ত্রী সুন্দরলাল পাটোয়া -- গুলি চালিয়ে শিশু-মহিলা সহ ১৩ জনকে হত্যা করেছিল। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর এই বর্বর, রক্তক্ষয়ী হামলার পরে অনেকের মতো আমরাও ছুটে যাই ভিলাইতে। সেখানে তখন কার্ফিউ, থমথমে পরিস্থিতি, পুলিশ যাকে পারছে গ্রেপ্তার করছে। ভিলাই শহর, আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়। কোনোরকমে লুকিয়ে বাস ধরে শাল-পলাশ-মহুয়ায় সেজে থাকা দু’পাশের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আড়াই ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার জঙ্গল-টিলার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম দল্লি-রাজহরা।
দল্লি-রাজহরা। দুটি পাহাড়, দুটি লোহা খাদান। এখানেই বাস্তব রূপ পেয়েছিল শংকর গুহ নিয়োগীর ‘সংঘর্ষ-নির্মাণ’ তত্ত্ব -- যা সম্পাদনের পুরোভাগে ছিল ছত্তিসগড় মাইনস শ্রমিক সঙ্ঘ (বৃহত্তর পরিসরে যা রূপান্তরিত হয় ছত্তিসগড় মুক্তি মোর্চায়)। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খাদান-মজদুরদের নিজেদের শ্রমে গড়ে তোলা শহীদ হাসপাতাল। আর নিয়োগীজীর কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হয়ে এই শহীদ হাসপাতালেরই প্রতিষ্ঠা লগ্নে, ৮০-র দশকের শুরুতে দল্লি-রাজহরায় পৌঁছে যান এক তরুণ শিশু-চিকিৎসক – বিনায়ক সেন। সঙ্গী জীবনসঙ্গিনী ইলিনা। দু’চোখে তাদের একরাশ স্বপ্ন। বুকভরা সংকল্প তাদের একমাত্র ভরসা।
জেএনইউ-র পিএচডি ইলিনা অ্যাকাডেমিক প্রত্যাশা বিসর্জন দিয়ে ছত্তিসগড়ে এসে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েন নিয়োগীর শ্রমিক আন্দোলনের কর্মসূচীর সাথে, বিশেষ করে আত্মনিয়োগ করেন নারীমুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে। তার হাত ধরেই শক্ত জমিন পায় নিয়োগীর সাধের ছত্তিসগড় মহিলা মুক্তি মোর্চা। এই কাজের মাধ্যমেই ইলিনা পরিচিত হন শ্রমিক-জীবনের সঙ্গে, আত্মীয়তা গড়ে ওঠে শ্রমিক পরিবারের মেয়েদের সাথে। সমাজে এবং পরিবারে নারীর অবস্থান কোথায়, পুরুষতন্ত্রের কঠোর শাসন-শৃঙ্খলে নারীজীবন কিভাবে বিপর্যস্ত, এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি হয় তার। কিভাবে মেয়েদের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা দূর করা যায়, কিভাবে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো যায়, এসব নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা করেন তিনি। ছত্তিসগড়ের এই অসাধারণ অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে তাকে এদেশের নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দিশারীর স্বীকৃতি এনে দেয়। তার লেখা এ স্পেস উইদিন দ্যা স্ট্রাগল (১৯৯০) তো একটা ফেমিনিস্ট ক্ল্যাসিক হিসাবে মান্যতা পেয়েছে। নারী আন্দোলনের অনেকেই বলেছেন বইটি তাদের অনুপ্রেরণা।
বিভিন্ন সমাবেশে স্বকণ্ঠে ইলিনার যে গান সভায় উপস্থিত সমস্ত মুক্তিকামী নারীবাদীদের প্রেরণা যোগাতো, উজ্জীবিত করে তুলত তা হল, তু ইস আঁচল কে এক পারচাম বনা লেতি তো আচ্ছা থা। / তু সহনা ছোড় কর কহনা শুরু করতি তো আচ্ছা থা।
ছত্তিসগড়ে এসে নিয়োগী ও নিজের উৎসাহে ইলিনা বহুমুখী কার্যকলাপে জড়িত হন। শৈশব ও স্কুলজীবন কেটেছিল শিলংয়ে, খাসি জনগোষ্ঠীকে, তাদের রীতিনীতি, আদবকায়দাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু দূর থেকে, ইংরেজি-শিক্ষিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের রোদচশমার আড়াল থেকে। ছত্তিসগড়ে কিন্তু ইলিনা আরও কাছাকাছি, আরও ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলেন আদিবাসী, মূলত গোন্দ, জনগোষ্ঠীর মানুষজনের সঙ্গে। এতটাই একাত্ম হয়েছিলেন তিনি তাদের সাথে যে অনায়াসেই আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন গোন্দি ভাষা, তাদের সাথে সাবলীলভাবে কথাবার্তা চালাতেন ওই ভাষাতেই। নৃতত্ববিদের নিষ্ঠা নিয়ে আহরণও করেছিলেন গোন্দ ইতিহাস, সঙ্গীত, চিত্রকলা, সংস্কৃতির উপাদান ও জীবনধারার জানা-অজানা নানা তথ্য। এইভাবেই উদ্ধার হয়েছিল ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের বিদ্রোহী নায়ক বীরনারায়ণ সিংয়ের বীরগাঁথা। ব্রিটিশ শাসকরা যাকে ফাঁসি চড়িয়েছিল, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রচলিত ব্রাহ্মনবাদী ইতিহাসের পাতায় যার জায়গা হয়নি। নিয়োগীর উদ্যোগে তাই চালু হয় বীরনারায়ণ শহিদ দিবস উদযাপন। ইতিহাস পুনরুদ্ধারের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছিল নতুন ভোরের ইতিহাস।
বিকল্প কৃষিতে নিয়োগীর আগ্রহ-উদ্দীপনা ছিল সীমাহীন। প্রখ্যাত রাইস সাইনটিস্ট বা ধান-বিজ্ঞানী আর এচ রিচারিয়া রায়পুরের কাছে একটি রাইস রিসার্চ সেন্টার গড়ে তুলেছিলেন। স্বাভাবিক নিয়মেই নিয়োগীর সাথে এই কৃষি-বিজ্ঞানীর গভীর সখ্যতা স্থাপিত হয়েছিল। এ ব্যপারে ইলিনার আগ্রহও ছিল চোখে পড়ার মতো। জৈব-চাষ, বীজ-বৈচিত্র সংরক্ষণ ইত্যাদি প্রসারের কাজে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছিলেন উনি। রিচারিয়া ছিলেন একাধারে তার বন্ধু, শিক্ষক, উপাদেষ্টা। ১৯৮৭ সালে নিয়োগীর সাথে মতপার্থক্যের কারণে দল্লি-রাজহরা ছেড়ে চলে যাবার পরেও ছত্তিসগড়ের গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রবল পরিশ্রম করে এই কাজ চালিয়ে গিয়েছেন ইলিনা। এর মাধ্যমেই ছত্তিসগড়ের কৃষিজীবী মানুষের সাথে গড়ে উঠেছিল নাড়ির যোগ।
ছত্তিসগড়ের আদিবাসী-অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন, সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাক্ষরতার প্রসার, পানীয় জল যোগানের ব্যবস্থা করা, খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য বিনায়ক ও ইলিনা তৈরি করেন তাদের নিজস্ব সংস্থা রূপান্তর। স্থানীয় স্তরে গণউদ্যোগ গড়ে তোলাই ছিল তাদের লক্ষ্য। এই কাজেও ইলিনাদের চড়কির মতো ঘুরতে হয়েছে গ্রাম থেকে সুদূর গ্রামে। পরমানন্দে দায়ভার গ্রহণ করেছেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ সম্পন্ন করেছেন এই দুটি নিবেদিত প্রাণ।
আসলে ছত্তিসগড়কে ভালবেসে ফেলেছিলেন বিনায়ক ও ইলিনা। এখানকার লাল রুক্ষ মাটি, দেবতার মতো খাড়া টিলা পাহাড়ের চূড়ো, মহানদী-ইন্দ্রাবতী-প্রাণহীতার অবারিত বয়ে চলা, ঘন-সবুজ মায়াময় অরণ্য, নীল স্ফটিক-স্বচ্ছ আকাশ, এখানকার প্রাণবন্ত মানুষজন, সহজ জীবনযাত্রা মাতিয়ে তুলেছিল দুজনকেই। ইনসাইড ছত্তিসগড় : এ পলিটিক্যাল মেমোয়ার (২০১৪), ইলিনার শেষ লেখা এই বইটির ভূমিকায় উনি লিখেছেন, “আমাদের কাছে ছত্তিসগড় স্রেফ কাজের জায়গা নয়, বৃহত্তর অর্থে এটাই আমাদের ঘরবাড়ি। এখানকার মাটি-জমি, এখানকার মানুষজন সবই আমাদের নিজেদের।” বলা যায়, ছত্তিসগড়ই তৈরি করেছিল ইলিনা বিনায়ককে।
ছত্তিসগড়ের ইলিনা আজ আর নেই। তিনি আছেন, থাকবেন ওই ছত্তিসগড়েই।
-- সুমিত