সিপিআই(এমএল)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি ৬ আগস্ট একদিনের স্বল্পসময়ের বৈঠকে মিলিত হয়। সারা বিশ্বে যাঁরা কোভিড-১৯ ব্যাধিতে মারা গিয়েছেন, বেইরুটের ভয়াবহ বিস্ফোরণে যাঁরা নিহত হয়েছেন এবং ভারতে নিকৃষ্ট রূপে পরিকল্পিত ও নির্মমভাবে বলবৎ করা লকডাউনের জন্য এবং আমপান ঘূর্ণিঝড়ের জন্য পশ্চিম বাংলা ও উড়িষ্যায় এবং বন্যার কারণে আসাম ও বিহারে যে শতশত মানুষ মারা গেছেন – বৈঠকে এই সমস্ত মানুষের প্রতি শোক জ্ঞাপন করা হয়।
কলকাতায় ২০২০ সালের ১৪-১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পর যে সমস্ত কমরেডকে আমরা হারিয়েছি, বৈঠকে তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কমরেড সত্যনারায়ন সিং (সিপিআই, বিহার শাখার সম্পাদক), শ্যামল চক্রবর্তী (পশ্চিম বাংলায় সিটু ও সিপিআই(এম)-এর প্রবীণ নেতা), চন্দন সরকার, শান্তনু বক্সী, তরুণ প্রকাশ কুণ্ডু, প্রদীপ ব্যানার্জী (পশ্চিম বাংলা), বুদ্ধ মারিদানদাহিয়া (মহিশূর, কর্ণাটক), জীভা (শিবাগঙ্গি, তামিলনাড়ু), জয়সিং হাঁসে এবং পাটোর ফাংচো (কার্বি আংলং, আসাম), বিদ্যানন্দ শাহি, রাজকুমার, সুহাইল আখতার, গুড্ডু পাশোয়ান, কৃষ্ণ বিহারি সিং, তেতারি দেবী, সুখদেব রাম, ফকরে আলম (বিহার), কংগ্ৰেস যাদব, দিলীপ সিং (ঝাড়খণ্ড), চিত্তরঞ্জন সিং (উত্তরপ্রদেশ), গনান্থ পাত্র, মানা রাও (রায়গড়া, উড়িষ্যা), নরেন্দ্র কুমার, কেশব রাম (দিল্লী), এবং খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও সমাজ আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপক হরি বাসুদেবন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (কলকাতা), ভি প্রসাদা রাও, ভি সম্বাশিভা রাও, পাণ্ডুরাঙ্গা রেড্ডি (অন্ধ্র প্রদেশ), থিয়েটার কর্মী ঊষা গাঙ্গুলি ও ইব্রাহিম আলকাজি, সমাজ আন্দোলনের কর্মী রায়া দেবনাথ (কলকাতা) এবং বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কমল লোহানি।
ভারতে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটায় কেন্দ্রীয় কমিটি গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং পরিস্থিতির মোকাবিলায় চূড়ান্ত রূপে ব্যর্থ হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এবং অধিকাংশ রাজ্য সরকারকে ধিক্কার জানায়। নমুনা পরীক্ষা, সংক্রমিতর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বার করা এবং চিকিৎসা – এই ত্রিমুখী কৌশলকে চালাতে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে প্রস্তুত ও নিপুণ করে তোলা তো হয়ইনি, বিপরীতে অধিকাংশ মানুষকেই নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করে নেওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে আর বেসরকারী নমুনা পরীক্ষাগার, ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো পরিষেবার জন্য তাদের কাছ থেকে অত্যন্ত চড়া দাম আদায় করেছে।
বিভিন্ন রাজ্যে কমরেডরা পরিযায়ী শ্রমিক এবং লকডাউনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত জনগণের মধ্যে ত্রাণ বিলি করা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটি কমরেডদের অভিনন্দন জানিয়েছে। বিভিন্ন পার্টি কমিটি এবং সদস্য ও সমর্থকরা লকডাউনের কারণে ক্ষতিগ্ৰস্ত সমাজের বিভিন্ন অংশের জনগণের পাশে দাঁড়ানোয় এবং লকডাউন পর্বে নানান নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচী সংগঠিত করায়, কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁদেরও অভিনন্দন জানিয়েছে।
লকডাউন চলা এবং লকডাউনের কারণে স্বাভাবিক জীবনধারায় ছেদ ঘটার সুযোগ নিয়ে মোদী সরকার যে জনগণের ওপর তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত এজেন্ডাকে চাপিয়ে দিচ্ছে, কেন্দ্রীয় কমিটি সরকারের সেই দুরভিসন্ধিমূলক অভিপ্রায়কে লক্ষ্য করেছে। ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজের নামে সরকার তার আক্রমণাত্মক বেসরকারীকরণ/কর্পোরেটকরণ এবং বিদেশী পুঁজির কাছে কিছু ক্ষেত্র খুলে দেওয়ার অভিযানে গতি বাড়িয়েছে (কয়লা, রেল, প্রতিরক্ষা এবং ব্যাঙ্কের মতো ক্ষেত্রকে খুলে দেওয়ার বিশেষ নিশানা বানানো হচ্ছে), কৃষির উদারিকরণ ঘটানো এবং কৃষি বাণিজ্যকে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে কৃষি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে, শ্রমিকদের অধিকারকে দুর্বল করে তুলে বৃহৎ পুঁজির নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করতে শ্রম আইনগুলোকে মুলতুবি করা এবং নতুন করে রচনা করা হচ্ছে, পরিবেশ সুরক্ষার বন্দোবস্তগুলোকে লঘু করে তোলা এবং পরিত্যাগ করা হচ্ছে। এছাড়া, সরকার অতিসম্প্রতি নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০ প্রকাশ করেছে যা শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপক হারে বহিষ্কার, শিক্ষার বাণিজ্যকরণ, শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রীভবন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে গৈরিকিকরণ ও জাত প্রথাকে আরও শক্তিশালী করে তোলার নীল নক্সা মাত্র।
কর্মনীতির ক্ষেত্রে মোদী সরকারের এই আগ্ৰাসী অভিযানের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ চলছে এবং প্রতিরোধের বিকাশ ঘটছে কেন্দ্রীয় কমিটি তাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং সর্বশক্তি দিয়ে এই প্রতিরোধকে তীব্রতর করে তোলার আহ্বান সমস্ত কমিটি ও কমরেডের কাছে রেখেছে।
আমাদের সম্পদসমূহের ওপর এই অর্থনৈতিক আক্রমণের পাশাপাশি মোদী সরকার জন আন্দোলনের বিভিন্ন ধারার বিশিষ্ট কর্মী ও সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে, বিশেষভাবে সিএএ-বিরোধী অভ্যুত্থান, প্রগতিবাদী ছাত্র আন্দোলন এবং মানবাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে দমনমূলক অভিযান ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে তীব্রতর করে তুলেছে। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় আরও একজনকে গ্ৰেপ্তার করায় গ্ৰেপ্তার হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে বারো, আর দিল্লীর সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনাকে পরিণত করা হয়েছে শাহীন বাগ প্রতিবাদ এবং “ভারত বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও” আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রের হাতিয়ারে। বেশ কিছু আন্দোলনের কর্মীকে ইতিমধ্যেই গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে (যাদের অন্যতম হলেন পিঁজরা তোড় আন্দোলনের কর্মী নাতাশা নারওয়াল এবং দেবাঙ্গনা কলিতা, ‘ঘৃণার বিরুদ্ধে ঐক্য’ আন্দোলনের কর্মী খলিদ সৈফি)। এবং আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং চার্জশিটে নাম জড়ানো হচ্ছে (যাদের মধ্যে রয়েছেন এআইএসএ-র দিল্লী সভাপতি কাওয়ালপ্রীত কাউর, সিপিআই(এমএল) নেত্রী কবিতা কৃষ্ণান, জেএনইউ-র প্রাক্তন নেতা উমর খলিদ, স্বরাজ অভিযান নেতা যোগেন্দ্র যাদব, শান্তি ও ন্যায়বিচারের প্রবক্তা হর্ষ মান্দার, দিল্লীর সুপণ্ডিত ব্যক্তি অপূর্বানন্দ এবং সমাজ আন্দোলনের আরও কিছু কর্মী)। সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ডাইনি খোঁজ চলছে বিজেপি শাসিত বেশ কিছু রাজ্যে, যার দুটো বড় কেন্দ্র রূপে দেখা দিয়েছে আসাম ও উত্তরপ্রদেশ (গোরখপুরের সুপরিচিত শিশু বিশেষজ্ঞ ডঃ কাফিল খান মথুরার জেলে পচছেন, অখিল গগৈ ও তাঁর সহ আন্দোলনকারীরা আসামের জেলে বন্দী হয়ে রয়েছেন আর সিপিআই(এমএল) নেতা কমরেড বিবেক দাসের ফোনটা পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে রেখেছে)। কেন্দ্রীয় কমিটি ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় সমস্ত অভিযুক্তদের এবং সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের অবিলম্বে ও নিঃশর্তে মুক্তির দাবি জানিয়েছে।
যে জম্মু ও কাশ্মীরে গণ বন্দিত্ব ও দমন এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখাটা এক বছর ধরে চলছে, সেখানকার পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যালোচনা করে; সেখানে সুপরিকল্পিতভাবে আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে কাশ্মীরের জনগণের অধিকার হরণ করা হচ্ছে এবং বাইরে থেকে আসা মানুষদের আরও বেশি অধিকার এবং সম্পদ ও কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হচ্ছে যার লক্ষ্য পূর্বতন এই রাজ্যে জনসংখ্যার ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটানো। এবং মতাদর্শগত তাৎপর্যে পরিপূর্ণ এক পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে সরকার আগে যেখানে বাবরি মসজিদ ছিল সেখানে রাম মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের জন্য অপারেশন কাশ্মীরের প্রথম বছর পূর্তিকেই বেছে নিল। এই পদক্ষেপ স্পষ্টতই ছিল সংবিধান এবং তার ন্যায়, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সৌভ্রাতৃত্বের ভাবধারা ও প্রতিশ্রুতির ওপর এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আক্রমণ। এবং এরই সাথে ৫ আগস্ট ও ১৫ আগস্টকে একাকার করে তুলে অযোধ্যা থেকে মোদীর ভাষণ ভারতকে ফ্যাসিবাদী হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার আরএসএস-বিজেপির চক্রান্তকে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দ্ব্যর্থহীন করে তুলল।
৫ আগস্ট ও ১৫ আগস্টকে পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত করার এই দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রকে কেন্দ্রীয় কমিটি দৃঢ়ভাবে খণ্ডন করে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গোটা পর্যায়ে বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্ক বা সংঘাত কখনই সামনে আসেনি। অযোধ্যা ও তার সন্নিহিত অঞ্চল ১৮৫৭-র বিদ্রোহের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এবং গোটা অঞ্চলেই ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ১৮৫৭-র ভাবধারা অনুরণিত হত। এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে সম্প্রদায় ভিত্তিক বিভাজন যখন তীব্র হয়ে উঠল, তখনও অযোধ্যা কোনো বিবাদের বিষয় হয়ে দেখা দেয়নি। ১৯৪৯ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বরের রাতে মসজিদের ভিতর চুপিসারে রামলালার মূর্তি ঢোকানোর পরই এই বিতর্ক পুনরায় মাথাচাড়া দেয় (গান্ধী হত্যার অভিযোগে গডসেকে ফাঁসি দেওয়া এবং সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকে মেনে চলা, রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে কাজ করার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে আরএসএস-এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কিছু পরই মসজিদে মূর্তি ঢোকানোর ঘটনা ঘটে)। এমনকি গত বছর ৯ নভেম্বর অযোধ্যায় জমির মালিকানা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়েও চুপিসারে মূর্তি ঢোকানোর ঘটনাকে মসজিদের অপবিত্রকরণ রূপেই অভিহিত করা হয়েছে।
১৫ আগস্টের পথে গৃহীত হয় সংবিধান, এবং সংবিধান আমাদের এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি ও কাঠামো দেয়। এর বিপরীতে ৫ আগস্টের উৎস রয়েছে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের মসজিদ ধ্বংসের মধ্যে, যে ধ্বংস ছিল সংবিধানের ওপরই এক প্রবল আঘাত। আমাদের তাই জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্খার সবচেয়ে শক্তিশালী আত্মঘোষণা রূপে ৯ আগস্টের ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে এবং স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক পরিণতি রূপে ১৫ আগস্টকে আগস্টের প্রকৃত উত্তরাধিকার রূপে তুলে ধরতে হবে। আজ যখন সংবিধান, গণতন্ত্র এবং ভারতের জাতীয় স্বার্থের ওপর মোদী সরকারের আক্রমণ অব্যাহতভাবে চলছে, তার বিপরীতে “সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, ভারত বাঁচাও”-এর আহ্বানকেই আজ আগস্টের প্রকৃত উত্তরাধিকার করে তুলতে হবে। আমাদের সামনের দিনের কর্মসূচীগুলোতে বুনিয়াদি ইস্যুগুলোকে ধরে জনগণের শক্তিশালী সমাবেশ ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের এই আলোচনাধারার প্রত্যাখানে এক যোগ্য জবাব দিতে হবে। জনসমাবেশের এই কর্মসূচীগুলো হল – ৯ আগস্ট কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহ এবং এআইকেএসসিসি-র প্রতিবাদ, আইসার প্রতিষ্ঠা দিবস, ১৩ আগস্ট ঋণ মুক্তি দিবস রূপে উদযাপন (যাতে জোর থাকবে এমএফআই-এর কাছে ঋণগ্ৰস্ত নারী এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ঋণগ্ৰস্ত ও ইএমআই শোধ করা মানুষের সমাবেশের ওপর) এবং ১৫ আগস্টকে সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, ভারত বাঁচাও দিবস রূপে উদযাপন।
কেন্দ্রীয় কমিটি বিহারের পরিস্থিতিও পর্যালোচনা করে, কোভিড পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হওয়া সত্ত্বেও যে রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে নির্বাচন কমিশন এবং এনডিএ বদ্ধ পরিকর। আমরা এবং বিহারের অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচন কমিশনকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছি যে, নির্বাচনের অনুষ্ঠান যেন ব্যাপক হারে কোভিড সংক্রমণের ব্যাপার না হয়ে ওঠে। জনগণের স্বাস্থ্য এবং ভোটদান প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্ৰহণের ব্যাপারে কোনো ধরনের আপস করা চলবে না – এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টির সাথে-সাথে আমাদের নির্বাচনী প্রস্তুতিকে কিন্তু বাড়িয়ে তুলতে হবে। আরজেডি এবং অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গে আসন সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তৃণমূল স্তরে আমাদের প্রস্তুতিকে কোনোভাবেই দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না। বেছে নেওয়া নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলোতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে হবে এবং তাতে লাগাতার গুরুত্ব দিয়ে চলতে হবে বুথ স্তরে। কেন্দ্রীয় কমিটি পশ্চিমবাংলা, আসাম ও তামিলনাড়ুর পরিস্থিতিও বিবেচনা করে, যে রাজ্যগুলোতে আগামী বছরের প্রথম দিকে নির্বাচন হওয়ার কথা। পশ্চিমবাংলায় সিপিআই(এম) ও কংগ্ৰেস ২০১৬ সালের সমঝোতার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর জন্য প্রস্তুত বলেই মনে হচ্ছে, এবং তা সম্ভবত আগের তুলনায় আরও খোলাখুলি ও আনুষ্ঠানিকভাবে, আর তাই যথার্থ বাম ঐক্যের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আসামে বিভিন্ন বিজেপি-বিরোধী উদ্যোগ চলছে এবং নির্বাচনের আগে সমস্ত বিরোধী দলকে অন্তর্ভুক্ত করে ঐক্য রূপ পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একাধিক জোট গড়ে উঠতে পারে, এমন পরিস্থিতির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, আমাদের সম্ভাবনাময় আসনগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং নিজেদের স্বাধীন প্রস্তুতির ওপর জোর দিতে হবে। যখন বিজেপি-বিরোধী মনোভাব বেড়ে চলেছে বলে দেখা যাচ্ছে এবং বেশ কিছু ইস্যুকে ধরে জনগণ বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তখন নিজেদের সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগই নির্ধারক গুরুত্ব বহন করবে, এবং তা পার্টি এবং বড়-বড় গণ সংগঠন উভয় পরিপ্রেক্ষিতেই। একই কথা প্রযোজ্য কার্বি আংলং-এর ক্ষেত্রেও। তামিলনাড়ুতে গণ সক্রিয়তা এবং সংগঠনের সার্বিক গতিময়তার এক পর্যায় চলছে। এই প্রক্রিয়াটায় আমাদের আরও গতি সঞ্চার করতে এবং তাকে প্রণালীবদ্ধ করে তুলতে হবে, আমাদের নির্বাচনী পরিকল্পনার সঙ্গে তাকে সংযুক্ত করতে হবে এবং এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করতে হবে।
লকডাউন চলা সত্ত্বেও আমাদের বিভিন্ন স্তরের পার্টি কমিটিগুলো এবং অধিকাংশ মুখপত্র ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করে চলেছে এবং যেখানে সম্ভব সেখানে শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়েও বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তামিলনাড়ুর কমরেডরা একটা পার্টি ক্লাস সংগঠিত করেছেন এবং বেশকিছু ভাষাতেই ফেসবুক মাধ্যমে কর্মসূচীর সরাসরি সম্প্রচারও ঘটছে। এই ব্যাপারে রাজ্য কমিটিগুলোর সক্রিয়তা যথেষ্ট মন্থর এবং তাদের দ্রুতই এই ব্যাপারে পারদর্শী হয়ে উঠতে হবে। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক দপ্তরের নির্দেশিকা অনুসারে আগস্ট মাসের মধ্যেই সদস্যপদ নবীকরণের কাজ শেষ করতে হবে এবং চূড়ান্ত তালিকা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দিতে হবে। যে সমস্ত পার্টি কমিটির সময়কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত করার সময় হয়ে গিয়েছিল এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে তা করা যায়নি, সেগুলোর কার্যকালের মেয়াদ সম্প্রসারিত করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরই সম্মেলনগুলো অনুষ্ঠিত করতে হবে। পার্টি ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যাওয়া এবং প্রতিবাদ কর্মসূচীগুলোতে সাড়া দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের মাস্ক পরা, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা এবং নিয়মিতভাবে সাবান ও স্যানিটাইজার ব্যবহারের মতো কোভিড-১৯ প্রতিহত করার অত্যাবশ্যকীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগুলোকে মেনে চলতে হবে। ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের রেখাচিত্র ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে, তরুণ-তরুণীরাও সংক্রমিত হচ্ছেন এবং আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে শুধু নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবলেই হবে না, অন্যদের নিরাপত্তায়ও গুরুত্ব দিতে হবে। সমষ্টিগত নিরাপত্তাই এখন সময়ের দাবি এবং এই রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা না থাকায় এবং স্বাস্থ্য পরিষেবাও একরকম অমিল হওয়ায়, নিবারণই নিরাময়ের সবচেয়ে ভালো পন্থা হয়ে দেখা দিয়েছে।