একটা মহকুমা (বনগাঁ) হাসপাতাল থেকে আরেকটা হাসপাতালে যাওয়া আর হল না! এ্যাম্বুলেন্স পেয়েও তাতে ওঠানো গেল না! এক বৃদ্ধ কাতরাচ্ছেন হাসপাতাল চত্বরে। তাঁর স্ত্রী কত কাতর আবেদন করলেন, একটু এগিয়ে এসে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু হাসপাতাল কর্মীরা কেউই এগিয়ে এলেন না। অন্য প্রত্যক্ষদর্শীরা স্বাস্থ্য বিধির কারণে সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারলেন না। বৃদ্ধের জীবনসঙ্গিনী চেষ্টা করলেন অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে। তীব্র শ্বাসকষ্টে জর্জরিত স্বামীকে এ্যাম্বুলেন্সে টেনে তুলতে। ড্রাইভারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, গাড়ি স্টার্ট দিলেও রোগীকে গাড়িতে তুলতে হাত লাগাননি; তাঁর কথা হল তিনি তখন ব্যস্ত ছিলেন হাসপাতালের স্টাফ খুঁজতে। ততক্ষণে রোগী প্রাণাম্তকর অবস্থায় গাড়ির গা পর্যন্ত গিয়েও গাড়িতে উঠতে পারলেন না, গা এলিয়ে গেল, নিথর হয়ে গেল। গোটা দৃশ্যপট কী মারাত্মক মর্মান্তিক! রোগীকে বাঁচানোর প্রয়োজনে যে হাসপাতাল স্টাফদের পাওয়া যায়নি, তাদের অগত্যা আসতেই হয়েছে রোগীর প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার পর। শবদেহ যে সরাতেই হবে। তবু সবক্ষেত্রে তা নিয়ম মেনে হচ্ছে তাও নয়। করোনার চিকিৎসা থেকে শুরু করে মৃতদেহ সরানো, সৎকার – সবকিছুতেই স্বাস্থ্য প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকার গেরো ও গাফিলতি ক্ষমার অযোগ্য।
কলকাতার বেহালা এলাকায় বাড়িতে করোনায় মৃত এক ব্যক্তির দেহ বাড়িতেই রয়ে গেল পনেরো ঘন্টা! ওয়ার্ডের টিএমসি পৌর প্রতিনিধি মুহর্মুহু ফোন যাওয়া সত্বেও মৃত নাগরিকের বাড়িতে এলেন না, এলাকার বিধায়ক, যিনি রাজ্য মন্ত্রীসভায় ওজনে দুনম্বর, তিনিও যা আশ্বাস শুনিয়ে গেলেন তার ফল মিলতে সময় লেগে গেল পনেরো ঘন্টা। নাগরিক সমাজ এসব আর কত সহ্য করবে! দোষীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসন হয়ত কিছু কিছু ঘটনায় তদন্তের কথা দিচ্ছে। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, তদন্ত ঠিকঠাক হবে কি? তার নাগরিক সাক্ষী-সাবুদ-নাগরিক তদারকি ব্যবস্থা স্বীকার করা হবে কি? যে হারে দোষ চিহ্নিত হচ্ছে সেভাবে বিচার করতে গেলে পরিচালন ব্যবস্থা উজার হয়ে যাবে, কার্যকরী ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার বিষয়টা বহুলাংশেই থেকে যাবে অকার্যকরী অবস্থায়।
এই অব্যবস্থার কঠিন বাস্তবতা স্বীকার করে, তার দ্রুত পরিবর্তনের জন্য রাজ্য সরকারকে যেমন প্রতিনিয়ত প্রশাসনিক পর্যালোচনা করে খোলনলচে পাল্টাতে হবে; তেমনি আরও বড় মাত্রায় পদক্ষেপ করবে না কেন? উদ্যোগ ও সক্রিয়তার সরকার বহির্ভূত উপাদানগুলোকে কেন সমাবেশিত করা হবে না? এই সমাজেই দু-চাকা চার-চাকা যান চালকদের অনেকে দিনরাত এক করে জীবনকে বাজি রেখে চালু করেছে ‘করোনা স্পেশ্যাল’। রয়েছে কত জনস্বাস্থ্য সংগঠন, ওয়েলফেয়ার সংগঠন, ব্লাডব্যাঙ্ক সংস্থা, রক্তদান শিবির করা ক্লাব সংগঠন। রয়েছে অফুরন্ত শক্তির যুবছাত্র সমাজ। এদের মধ্যে করোনা মোকাবিলার নানা কাজে দক্ষ-অদক্ষ, অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ ভাগ-যোগ করে, পিপিই পরিধানে পরিবৃত করে, সমস্ত স্বাস্থ্য বিধিতে মুড়ে, ঝুঁকি অনুযায়ী স্বাস্থ্য বিমার আওতায় এনে সেবায় লাগানো যায়। উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান দেওয়া যায়, সমাবেশিত করার ব্যবস্থা নেওয়া যায়। দম্ভ আর ঔদ্ধত্যের মিনার থেকে নেমে এসে, তথ্যের কারচুপি বা মিথ্যাচার থেকে সরে এসে, বিভ্রাট ও অচলাবস্থার শিকার হওয়া থেকে নাগরিক সমাজকে বাঁচাতে রাজ্য সরকারকে এখনই সরকার বহির্ভূত সমস্ত শক্তিকে কাজে লাগাতে ঝাঁপাতে হবে। নাহলে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না, ইতিহাসও ক্ষমা করবে না।