করোনা মোকাবিলায় চূড়ান্ত ব্যর্থ মোদী সরকারের চৌতরফা হামলার বিরুদ্ধে চাই ব্যাপক গণজাগরণ
gan

২০২০ সালের প্রায় আট মাস অতিক্রান্ত হতে চলল। বছরের প্রায় গোড়ার দিকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন (WHO) আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল যে চীনে যে নতুন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তা এক আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য সংকট। এগারোই মার্চ কোভিড-২০১৯কে অতিমারী বা Pandemic হিসেবে চিহ্নিত করা হল। তারপর থেকে গোটা পৃথিবী জুড়ে সারা বছর ধরে শুধুই এই অতিমারীর চর্চা।

অতিমারী হিসেবে কোভিড-২০১৯ কতটা মারাত্মক তা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। একশ বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লু-র তুলনায় অবশ্যই কোভিডের মারণক্ষমতা অনেক কম। কিন্তু এই তুলনাটাই কেমন অবাস্তব এবং অনৈতিহাসিক মনে হয় না? গত একশ বছরে পৃথিবীতে অনেক সংকট, যুদ্ধ ও বিপর্যয় সত্ত্বেও চিকিৎসা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতে অবশ্যই বিরাট উন্নতি হয়েছে, দেশে দেশে মানুষের গড় আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে বিচার না করে কোভিড অতিমারীকে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এই সময়ের এক মহাবিপর্যয় হিসেবে দেখাই বোধকরি যুক্তিসঙ্গত।

আগস্ট মাসের প্রথম দুসপ্তাহের শেষে আজ অবধি পৃথিবী জুড়ে প্রায় দু’কোটি দশ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন সাড়ে সাত লক্ষের কিছু বেশি মানুষ। দুশোর বেশি দেশ এই তালিকায় রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হল অর্ধেকের বেশি রোগীর সংখ্যা মাত্র তিনটি দেশ থেকে – আমেরিকা, ব্রাজিল ও ভারত। মৃত্যুর দিক থেকে দেখলে প্রায় সোয়া তিন লক্ষ রোগীর মৃত্যু ঘটেছে এই তিন দেশে। এর সাথে মেক্সিকো আর যুক্তরাজ্যকে যুক্ত করলে পাঁচটি দেশে কোভিড রোগে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াবে আরও এক লক্ষ বেশি অর্থাৎ সোয়া চার লক্ষ। ভারতের অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে অবশ্যই এই সরকারী পরিসংখ্যানকে বাস্তব অবস্থার এক সীমিত অনুমান হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়। তবু একুশ শতকের চিকিৎসা বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিরিখে সরকারী পরিসংখ্যানে উঠে আসা এই আনুমানিক ছবিটিও অতিমারীর বিভীষিকাকে ভালোই তুলে ধরে।

এই অতিমারীর যাত্রাবৃত্তান্তও বেশ অদ্ভুত। চীন থেকে মূলত আকাশপথে এর বিশ্বসফর শুরু। ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ানের মতো যে সব দেশ শুরু থেকেই এই যাত্রাপথকে অনুধাবন করে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে তারা অনেক দ্রুত এবং অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করে এর ধাক্কা সামলে উঠেছে। এশিয়ার এই দেশগুলোর ক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ শিক্ষাও যথেষ্ট কাজে এসেছে। তুলনামূলকভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার যে সব দেশ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে দেরী করেছে তাদের আজও অনেক বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। চীনের পর ইউরোপ কাঁপিয়ে আজ কিন্তু করোনা সবচেয়ে বেশি দাপট দেখাচ্ছে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মেক্সিকো ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে।

সবচেয়ে বেশি সময় পাওয়া সত্ত্বেও সবচেয়ে কম শিক্ষা ও প্রস্তুতি নেওয়া দেশ হিসেবে আজ এই পর্যায়ে এক নম্বর ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে ভারতকেই চিহ্নিত করা যায়। আমেরিকা, ব্রাজিল ও ভারতের মতো দেশে করোনার এই তীব্র তাণ্ডবের মধ্যে কোনো সাধারণ যোগসূত্র চোখে পড়ে কি? মৃত্যু হারের দিক থেকে ভারত অবশ্যই আমেরিকা ও ব্রাজিলের থেকে সুবিধেজনক অবস্থায় রয়েছে। তার কিছু চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ভাইরোলজি সঙ্গত কারণ অবশ্যই রয়েছে, সে চর্চায় আমরা এখানে যাব না। যে সাধারণ যোগসূত্র খুব সহজেই চোখে পড়ে তা হল এই তিনটি দেশেই উগ্র দক্ষিণপন্থার রাজত্ব চলছে। আর্থিকনীতি ও স্বাস্থ্যনীতির দিক থেকে ইউরোপের অনেক দেশ সম্পর্কেই আজ একথা বলা যায়। স্বাস্থ্য নিয়ে যে দেশে যত মুনাফার কারবার চলে সে দেশ করোনার আক্রমণে তত বেশি বিপর্যস্ত। বিপরীতে কিউবা বা ভিয়েতনাম বা এমনকি বাজারবাদের যুগেও চীনের মতো দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এ ধরনের অতিমারী মোকাবিলায় স্পষ্টতই অনেক বেশি দক্ষ।

তবে আমেরিকা, ব্রাজিল ও ভারতের ক্ষেত্রে শুধু উগ্র দক্ষিণপন্থী নীতি দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ বোঝা যাবে না। এই তিন দেশেই এই মুহূর্তে যে নেতারা শাসনক্ষমতায় রয়েছে তাদেরও একটা বিশেষ চরিত্র রয়েছে। এই চরিত্রকে বুঝতে আমরা হিটলার ও তুঘলকের একটা যৌগকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার দম্ভ, বিজ্ঞান বিরোধী মানসিকতা ও খামখেয়ালিপনার এক মারাত্মক সমাহার। ভারতে ১৮ মার্চের আগে পর্যন্ত সরকার ক্রমাগত বলে গেছে করোনা নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। সরকারীভাবে নরেন্দ্র মোদীর ১৮ মার্চের ভাষণ থেকে প্রথম করোনা মহামারী ‘সরকারী স্বীকৃতি’ পায়। বাইশে মার্চ জনতা কারফিউ-এর নামে সারাদিন লকডাউনের মহড়ার পর বিকেল পাঁচটায় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে গোটা দেশজুড়ে তালি-থালি কাঁসর-ঘণ্টা সহযোগে ‘গো করোনা গো’ মিছিল সংগঠিত হয়। আর তারপর হঠাৎ চার ঘণ্টার নোটিশে ২৪ মার্চ রাত থেকে শুরু হয়ে যায় লকডাউন, আর নিরন্ন, কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের ঘরে ফেরার মহামিছিল।

আজ দেশজুড়ে করোনার বিলম্বিত তাণ্ডবের পেছনে এই উদ্ভট লকডাউনের বিরাট অবদান। আর তারই সাথে তাল দিয়ে আমাদের ভাঙ্গাচোরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও করোনা সম্প্রসারণে বিরাট ভূমিকা পালন করে চলেছে। একদিকে সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সরকারী উপেক্ষায় জর্জরিত, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সর্বনাশের সময়কেই বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মুনাফা লুটের পৌষমাস হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে ভারতে করোনা মহামারীর থেকেও বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলতে থাকা লকডাউন। দিনআনা-দিনখাওয়া ব্যাপক জনগণ তো স্পষ্টতই গভীর সংকটে। ছাঁটাই ও বেতন সংকোচনের কবলে পড়েছেন এমন শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যাও বিরাট। সব মিলিয়ে সমাজের বিরাট বড় অংশের মানুষের আয়ের ব্যাপক অবনমন ঘটেছে এই পাঁচ মাসে। করোনা মহামারীতে মৃত্যুর পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে তাই বেড়ে চলেছে লকডাউনজনিত মৃত্যুর মিছিল – অনাহারে অর্ধাহারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মানুষ থেকে শুরু করে লকডাউনের ফলে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাওয়া মানুষ আর সামাজিক-আর্থিক সংকটে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হওয়া মানুষ, লকডাউনের ফলে বিরাট এক বিভীষিকা নেমে এসেছে বহু মানুষের জীবনে।

করোনা অতিমারী ও লকডাউনজনিত সংকটের সাথেই যুক্ত হয়ে পড়েছে তৃতীয় একটি বিষয়। লকডাউনের ফলে স্বাভাবিক সংসদীয় প্রণালী ও জনগণের প্রতিবাদ-আন্দোলন, এমনকি স্বাভাবিক জনজীবনে যে গতিরোধ নেমে এসেছে তার সুযোগ নিয়ে মোদী সরকার একের পর এক বড় বড় নীতিগত পরিবর্তন করে চলেছে। তথাকথিত আর্থিক প্যাকেজ ও ‘আত্মনির্ভর ভারত’ স্লোগানের আড়ালে একদিকে সরকার তার যাবতীয় দায়দায়িত্ব জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে আর অন্যদিকে কয়লা, রেল, প্রতিরক্ষা, ব্যাঙ্ক শিল্পের মতো রণনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে চলছে বেসরকারীকরণের আগ্রাসী অভিযান। এই বিপর্যয়েই বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার বিভিন্ন শ্রম আইন বাতিল, নিষ্ক্রিয় বা শিথিল করে দিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করার নির্দেশ জারী করেছে, তিন তিনটি কৃষিসংক্রান্ত অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে কৃষি-উৎপাদন ও কৃষিপণ্যের কেনাবেচার প্রশ্নে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণকে সম্প্রসারিত করেছে আর নতুন শিক্ষানীতি জারী করে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়কে আমন্ত্রণ জানানোর সাথে সাথে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্যিকীকরণের পথ খুলে দিয়েছে।

বেসরকারীকরণ ও বাজারিকরণের দিশায় এই আক্রমণাত্মক অভিযানের পাশাপাশি চলছে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত হামলা, সংবিধানিক মূল্য ও আইনভিত্তিক শাসন কাঠামোর ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় বন্দীদের কোভিড পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জামিনে মুক্তি দেওয়ার পরিবর্তে উল্টে আরও তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই কায়দায় দিল্লী দাঙ্গার মামলাকেও সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে। যাদের প্রকাশ্য উস্কানি ও নেতৃত্বে এই দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, প্রবেশ বর্মা ও রাগিনী তেওয়ারির মতো সেই সব দাঙ্গাকারী বিজেপি নেতৃত্বকে খোলাখুলিভাবে ছাড় দিয়ে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক এবং বামপন্থী ও প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের অগ্রবাহিনীকে দাঙ্গার অভিযুক্ত হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে ইতিমধ্যে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আর অন্য অনেকের বিরুদ্ধে চলছে অভিযোগ গঠন ও পুলিশী জেরার প্রক্রিয়া।

কৃষক ও ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি নাগরিকতা সংশোধন বিরোধী আন্দোলন সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় গণজাগরণ হিসেবে উঠে এসেছে। কোভিড পরিস্থিতি ও লকডাউনের ফলে আন্দোলন পুরনো গতিতে ও ধরনে এই পর্যায়ে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, আর এই সুযোগে সরকার এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ও জাতীয় নিরাপত্তা আইনের মতো দানবীয় আইনকে কাজে লাগিয়ে এই গণজাগরণকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে। এই দমন অভিযান গোটা দেশ জুড়েই চলছে, তবে দিল্লী ও মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ ও অসম এই অভিযানের বিশেষ ল্যাবরেটরি হয়ে উঠেছে।

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার সাথে সাথেই মোদী সরকার সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেয়। ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলকে রাজ্যে পরিণত করার বিপরীতে (যেমন গোয়া) এক পূর্ণ রাজ্যকে দুটি কেন্দ্র শাসিত এলাকায় বিভক্ত করে দেওয়া হয়। জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ, সেখানকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কারুর সাথে কোনোরকম আলাপ-আলোচনা না করেই একতরফাভাবে কেন্দ্র সরকার এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় আর কাশ্মীরের মানুষ যাতে প্রতিবাদ না করতে পারে সেজন্য রাজ্যজুড়ে নামিয়ে আনা হয় এক অভূতপূর্ব লকডাউন। যে টেলিফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা আজ জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহের মতোই নিত্যপ্রয়োজনীয় তা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সহ প্রায় সমগ্র বিরোধীপক্ষকে জেলে বা নিজ ঘরে আটক করে রাখা হয়।

গত একবছরে কাশ্মীরের এই বন্দীদশার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। লকডাউন পর্যায়ে বরং একের পর এক নিয়ম পরিবর্তন করে বহিরাগত নাগরিকদের কাশ্মীরের বাসিন্দা (domicile) প্রমাণপত্র দেওয়া হচ্ছে যাতে কাশ্মীরের জনসংখ্যার কাঠামো ও ভারসাম্য বদলে দেওয়া যায়। এবছর ৫ আগস্ট কাশ্মীরের সম্ভাব্য প্রতিবাদের কথা ভেবে সরকার প্রথমে ৪ ও ৫ দুদিনের জন্য কারফিউ জারী করেছিল, পরে ৪ তারিখ সন্ধ্যায় সেই কারফিউ প্রত্যাহার করা হয় যাতে সম্ভবত ৫ আগস্ট বার্ষিকী পালনে প্রশাসন ও মুষ্টিমেয় বিজেপি সমর্থকদের কোনো অসুবিধে না হয়।

teq

 

৫ আগস্ট বার্ষিকী বিজেপি এবার পালন করল অযোধ্যায়। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় এবং বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এখনও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা রয়েছে – অর্থাৎ রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকবে না এবং রাষ্ট্র ও প্রশাসন ধার্মিক অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে আলাদা রাখবে। সেই সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে সরকারী ক্ষমতায় আসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, রাজ্যপাল অনাদিবেন প্যাটেল এবার আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে একযোগে রাম মন্দিরের ভূমিপূজন করলেন। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ছেঁড়া কাগজের প্রহসনে পরিণত করার এর চেয়ে নির্লজ্জ উদাহরণ কমই দেখা গেছে।

১৯৯২ সালের ৬ জিসেম্বর বাবরি মসজিদ বিধ্বংস করে সংঘ পরিবার সংবিধানের উপর যে আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল তখন রাষ্ট্র তাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ১৯৯৪ সালে সুপ্রীম কোর্ট তাকে ‘জাতির লজ্জা’ হিসেবে ধিক্কার জানিয়েছিল। এমনকি গত ৯ নভেম্বর ২০১৯ সুপ্রীম কোর্টের যে রায়ের ভিত্তিতে অযোধ্যার বাবরি মসজিদের জমিকে মন্দির নির্মাণের জন্য আইনি অনুমতি দেওয়া হয়েছে তাতেও ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ বিধ্বংসের ঘটনাকে অপরাধ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেই অপরাধের মামলাটি এখনও শুনানি স্তরে আছে। শুধু ১৯৯২ নয়, সুপ্রীম কোর্ট ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে বাবরি মসজিদে রামলালার মূর্তি রেখে দেওয়ার ঘটনাটিকেও মসজিদকে অপবিত্র করে মুসলিম সমাজের ধার্মিক অধিকারে হস্তক্ষেপ ও প্রার্থনার অধিকার হরণের এক দৃষ্টান্ত হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। যারা আজ কোর্টের  রায়ের ভিত্তিতে মন্দির নির্মাণকেই সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন তাদের ভাবা উচিত ১৯৪৯ ও ১৯৯২ সালের এই দুটি অপরাধ যদি না ঘটত তাহলে কি অযোধ্যা জমি বিবাদে সুপ্রীম কোর্ট এভাবেই মন্দিরের পক্ষে জমির মালিকানার রায় দিত?

মন্দির নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সাংকেতিক তাৎপর্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল তার পর প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রদত্ত ভাষণ, যাতে রামকে ভারতের ঐক্যের মূল সূত্র হিসেবে এবং রামমন্দির নির্মাণকে কয়েক শতাব্দীর অপেক্ষা ও আকাঙ্খার বাস্তবায়ন হিসেবে তুলে ধরা হয়। এভাবে ৫ আগস্টকে ১৫ আগস্টের সঙ্গে একই আসনে বসিয়ে দেওয়াটা এক মারাত্মক মিথ্যা ও বিপজ্জনক ইঙ্গিত। রামভক্তদের অনেকের জন্য অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ এক আন্দোলনের ও আকাঙ্খার বিষয় অবশ্যই ছিল কিন্তু তাকে গোটা দেশের কয়েক শতাব্দীর অপূর্ণ স্বপ্ন হিসেবে ঘোষণা করাটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা ভাষণ।

ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সংগ্রামটা ছিল সমগ্র দেশ ও জাতির, আর সেই সংগ্রামে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির গড়ার কোনো প্রশ্নই কখনও ওঠেনি। ১৯৪৯ সালে আরএসএস-এর এক কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা হিসেবে বাবরি মসজিদকে বিতর্কিত করে তোলা হয়েছিল, আর আশির দশকে আর একবার কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রাম জন্মভূমি আন্দোলনের নামে গোটা দেশজুড়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে মসজিদকে শেষপর্যন্ত ষড়যন্ত্রমূলক কায়দায় ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনাক্রমকে গোটা দেশের কয়েকশো বছরের স্বপ্নপূরণ হিসেবে তুলে ধরাটা ভারতের ইতিহাসকে চূড়ান্তভাবে বিকৃত ও অপমানিত করা, এবং এই মিথ্যা আর ধর্মের নামে সংকীর্ণতা ও দম্ভের ভিত্তিতে ভারতের জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় পরিচিতিকে পরিভাষিত করার এক জঘন্য চক্রান্ত। রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের আড়ালে এ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে হিন্দু আধিপত্যবাদের ভিত্তিতে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে উপড়ে ফেলার ষড়যন্ত্র।

অর্থনীতি থেকে জাতীয়করণকে নির্বাসিত করে তার সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণ করার পাশাপাশি ধর্মের মতো একান্ত ব্যক্তিগত আস্থার বিষয়কে সরকারীকরণ করে তোলার এই বিরাট ওলটপালট এই করোনাকালে লকডাউনের সুযোগ নিয়ে ঘটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লকডাউনের বাধা সত্ত্বেও মানুষ কিন্তু প্রতিবাদে নেমেছে। কয়লা শিল্পে তিন দিনের অভূতপূর্ব ধর্মঘট আমরা দেখলাম। পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে কৃষক রাস্তায় নেমেছে কৃষির কর্পোরেটীকরণের অর্ডিন্যান্স বাতিলের দাবিতে। গোটা দেশজুড়ে মাইক্রোফিনান্সের নতুন মহাজনী প্রথার বিরুদ্ধে ঋণমুক্তির দাবিতে সোচ্চার শ্রমজীবী নারীসমাজ এবং ঋণগ্রস্ত কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত জনগণ।

কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই ফ্যাসিবাদী ওলটপালটের বিরুদ্ধে আজ দরকার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, এক দুর্বার গণপ্রতিরোধ। অধিকাংশ বিরোধী দলই এই প্রশ্নে এখনও চরম উদাসীন বা রীতিমতো দেউলিয়া। কাশ্মীরের প্রশ্নে কিছুটা বিরোধিতা করলেও অযোধ্যা প্রশ্নে আমরা কংগ্রেসকে বিজেপির কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে দেখলাম। রামমন্দির নির্মাণের শ্রেয়লাভের মিথ্যা নিষ্ফল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজেপিকে পরাস্ত করতে চায় কংগ্রেস। বামপন্থীদের কাছে তাই আজ বড় চ্যালেঞ্জ, বড় দায়িত্ব। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের পতাকা নিয়ে আজ বামপন্থীদের এগিয়ে আসতে হবে সামনের সারিতে।

১৯৪৯ সালে সংবিধান গ্রহণের সময় সংবিধান সভায় শেষ ভাষণে আম্বেদকর বলেছিলেন, ভারতে যদি হিন্দুরাজ চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তা হবে এক বিরাট বড় বিপর্যয়। সেই সতর্কবাণী আজ বিরাটভাবে প্রাসঙ্গিক। হিন্দুরাজ মানে মনুস্মৃতির রাজ, সমাজকে আবার বর্ণাশ্রমের রাস্তায়, অন্ধবিশ্বাস ও সামাজিক সংকীর্ণতার কানাগলিতে ঠেলে দেওয়া। আজ সময় এসেছে বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে শ্রমিকের আন্দোলন, কর্পোরেটীকরণের বিরুদ্ধে কৃষকের মুক্তির আন্দোলন; শিক্ষার অধিকার ও মুক্তচিন্তার জন্য ছাত্র-শিক্ষক-বিজ্ঞানী-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ; পরিবেশ, মানবাধিকার ও নাগরিকতা বাঁচানোর লড়াই সব কিছুকে একসূত্রে গেঁথে এক বিরাট গণজাগরণ সৃষ্টি করার। সরকার করোনাকাল ও লকডাউনকে দীর্ঘায়িত করে গণতন্ত্র ও মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু জনগণ এর মধ্যেও প্রতিবাদের পথ খুঁজে নিচ্ছেন, প্রতিবাদের নতুন ভাষা তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই গণউদ্যোগ ও সংগ্রামী প্রাণচাঞ্চল্য, গতি ও স্পর্ধাকে পুঁজি করেই বামপন্থীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আসুন জোট বাঁধি, তৈরি হই। এ লড়াই গণতন্ত্রের বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য  
(শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ আগস্ট, ২০২০ ডিজিটাল সংখ্যায় প্রকাশিত।
অনুমতিক্রমে দেশব্রতীতে পুনরায় প্রকাশিত হল।)
  

খণ্ড-27
সংখ্যা-29