সরকারী কাজে ব্রাহ্মণ্যবাদ কিভাবে প্রভাব রেখে যেতে পারে তার সাম্প্রতিক প্রতিফলন সম্ভবত ধরা পড়ল সাঁওতালি মাধ্যমে এবছর উচ্চ-মাধ্যমিক উত্তীর্ণ আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি এরাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তরের মনোভাবে! এরা ছিলেন এই মাধ্যমের প্রথম ব্যাচ। অন্য মাধ্যমের উত্তীর্ণরা যখন রেজাল্ট হাতে কলেজে ভর্তির অনলাইন ফর্ম পূরণ করছেন, তখন আদিবাসী ছেলেমেয়েগুলো জানেনই না কোন কলেজে ভর্তি হবেন! শেষ পর্যন্ত বিশ্ব আদিবাসী দিবসের ২ দিন আগে উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী টুইট করে জানালেন, ভর্তির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে টুইটের বক্তব্য এটাও স্পষ্ট করছে যে শিক্ষামন্ত্রী নিজেও তখনও জানেন না, কোন কোন কলেজে ভর্তি সম্ভব!
এমনটা নয় যে প্রথম ব্যাচ বলে এই অব্যবস্থা।
মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিকেও এই ছাত্র/ছাত্রীরা উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক, সর্বক্ষণের শিক্ষক ইত্যাদি যথাযথ শিক্ষা পরিকাঠামো ছাড়াই পড়াশোনা করেছেন। বছরের পর বছর সরকার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি! এবার অব্যবস্থা পৌঁছল স্নাতক স্তরেও।
৯ আগস্ট, বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালিত হল আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের উদ্যোগে, হুগলি জেলার পোলবা ব্লকের বরুনানপাড়ায়; সঙ্গত নানান ক্ষোভের আবহে। করোনা আবহের মধ্যেও বলাগড়ের কামালপুর, বড়াল কিম্বা ধনেখালির যদুপুর, জয়হরিপুর, খোড়োডাঙ্গা; পাণ্ডুয়ার ধামাসিন, ইলামপুর, ভোটগ্রাম তোড়গ্রাম; পোলবার মহেশ্বরবাটী, গোয়ালজোড়, দনার পাড়া, ইত্যাদি নানা এলাকা থেকে উপস্থিত ছিলেন আদিবাসী মঞ্চের নেতৃবৃন্দ। উপস্থিত ছিলেন তপন মুর্মু, সিদ্ধেশ্বর মাণ্ডি, বুধিলাল সরেনদের মতো আদিবাসী সামাজিক নেতৃবৃন্দ, মাঝিবাবারা। সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হল মঞ্চের জেলা সহসভাপতি বিশ্বনাথ সরেনের উদাত্ত কন্ঠের দরদী সংগীতে, যার প্রতিটি শব্দে ছিল আদিবাসী গৌরবের জয়ধ্বনি। যদুপুরের সুখী সরেনের টিম পরিবেশন করলেন সাঁওতালি নৃত্য, যা তাঁদের দৈনন্দিন জীবন চর্চাও। জেলা সহ-সভাপতি ময়না কিস্কুর বক্তব্যে প্রতিফলিত হল পাণ্ডুয়ার মাটিতে জননেতা সিধু-কানহোর মূর্তির উপর হামলার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ, উদ্বেগ। মঞ্চের জেলা সম্পাদক পাগান মুর্মু, সহ-সম্পাদক শিবলাল বাস্কেরা তাদের ভাষণে তুলে ধরলেন আজকের সময়ে আদিবাসী সমাজের জীবন সংগ্রামের কথা। সবশেষে জেলা নেত্রী সুমিতা মুর্মু, সরস্বতী বাস্কেদের গান ও অংশগ্রহণকারী আদিবাসী মহিলাদের সমবেত নৃত্যের মধ্য দিয়ে শেষ হল অনুষ্ঠানটির প্রথম পর্ব।
দ্বিতীয় পর্বে ছিল বঞ্চনা, অবহেলার বিরুদ্ধে সমবেত শপথগ্রহণ ও গণমিছিল। গুড়াপে আদিবাসী ছাত্রীর উপর নিপীড়নকারীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে; পাণ্ডুয়ার মাটিতে লোকনায়ক সিধু-কানহোর মূর্তির উপর হামলাকারীরা হুঁশিয়ার; সাঁওতালি মাধ্যমে উত্তীর্ণ আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা কেন, রাজ্য সরকার জবাব দাও; আদিবাসী-বনবাসী উচ্ছেদ করে কয়লাখনি বেসরকারীকরনের সিদ্ধান্ত কেন, মোদী সরকার জবাব দাও ইত্যাদি শ্লোগানে মুখরিত ছিল মিছিল। মিছিলে পা মেলালেন সোমা রায়, সজল দে, গোপাল রায়, শৈলেন মাজির মতো আদিবাসীগণ আন্দোলনের পরিচিত নেতৃবৃন্দ।
আদিবাসী দিবসের পাশাপাশি ৯ আগস্ট ছিল ঐতিহাসিক “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের দিন। সারা ভারত কিষান সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির দেশব্যাপী আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল “বহুজাতিক হটাও, কিষান বাঁচাও”। জেলায় ঋণ মুক্তি কমিটির নেতৃত্বে চলছে মাইক্রো ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলির দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন। আদিবাসী দিবসের সমাবেশের ভাষণ, অনুষ্ঠানের অঙ্গসজ্জায়, মিছিলের শ্লোগানে ছিল এর সচেতন প্রতিফলন। জোট বাঁধো, তৈরি হও।
- সজল অধিকারী