৩১ আগস্ট এবং ১ সেপ্টেম্বর : শপথ শানিয়ে নেওয়ার দিন
31

ফ্যাসিবাদের চায় মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করতে। তাই তার অন্যতম হাতিয়ার বিস্মরণ। মানুষকে তার ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে পারলেই তার উদ্দেশ্য সফল। বিশেষত সেই ইতিহাস যদি হয় অবদমিতের অস্তিত্বের লড়াই; তাহলে সেই ইতিহাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেই ফ্যাসিবাদ টিকে থাকতে চায়। ক্ষমতা এবং বিস্মরণের এই গাঁটছড়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের হাতিয়ার হল স্মৃতি-আমাদের ইতিহাস। বর্তমানে যখন আরও একবার দিকে দিকে শোনা যাচ্ছে অভুক্ত মানুষের মৃত্যুর খবর, মাইলের পর লাইল হেঁটে রাস্তাতেই পড়ে থাকছে মায়ের লাশ আর তার আঁচল ধরে অভুক্তসিশুর আকুতি যখন গোটা দেশকে এই ঠুনকো “আচ্ছে দিন”এর দিকেই সবথেকে বড়ো প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মুল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া, তখন আরেকবার স্মৃতির পটে জমা ধুলো ঝেড়ে দেখে নেওয়া যাক আমাদের অতীত লড়াকু ইতিহাসের সোনালি পাতাকে। শাসক সংস্কৃতির বিস্মরণের বিরুদ্ধে আমাদের এই স্মৃতিই হবে আমাদের প্রতিরোধ।

১৯৫৯ সাল-বাংলায় খাদ্যহীন বুভুক্ষু জনতার মিছিল কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেদিনের শাসকের ভিতকে। বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় চাল, গমের মতো অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য। গ্রাম বাংলায় পরিস্থিতি দুর্ভিক্ষের আকার নেয়। শুরু হয় খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন। বামপন্থী দল এবং গনসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে “মূল্যবৃদ্ধি এবং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি” গঠন করে বাংলা জুড়ে শুরু হয় ব্যপক আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ওপর বর্বরোচিত দমন নামিয়ে আনে তৎকালীন বিধান রায়ের সরকার। ৩১ আগস্ট শহীদ মিনারে জমায়েত হন কয়েক লক্ষ মানুষ। তারপর সেখান থেকে মহাকরণ অভিমুখে যাওয়ার সময় শুধুমাত্র লাঠি দিয়ে পিটিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে পুলিশ। এই জোয়ারে আঠারোর বজ্রনির্ঘোষ সেদিন গর্জে উঠেছিল কলকাতার রাজপথে। ৩১ আগস্টের গণহত্যার বিরুদ্ধে পরেরদিন ১ সেপ্টেম্বর হাজারে হাজারে ছাত্র-যুবরা অবরুদ্ধ করে দেয় তামাম কলকাতা, ঘেরাও করে গণহত্যার কুশীলবদের বাড়ি। সেই মিছিলেও গুলি চলে। প্রাণ হারান আটজন ছাত্র, আহত হলেন সাতাত্তর জন। এই দুই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে ৩ সেপ্টেম্বর রাজ্যজুড়ে পালিত হয় সাধারণ ধর্মঘট। সেইদিনও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গুলি চালানো হয়, প্রাণ হারান ১২ জন, আহত হন ১৭২ জন। অপরদিকে জেল উপচে পড়ছে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনরতদের নির্বিচার গ্রেপ্তারির ফলে। এইসব গণহত্যার বিরুদ্ধে ৮ সেপ্টেম্বর রাজ্য জুড়ে ছাত্রদের ডাকে পালিত হয় শহীদ দিবস। পরবর্তীকালে ৩১ আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের শহীদ দিবস এবং ১ সেপ্টেম্বর ছাত্র শহীদ দিবস পালন করে আসছে বামপন্থীরা।

দিবসগুলো পালন করা আসলে আরেকবার শপথ সানাইকে শানিয়ে নেওয়ার জন্য। আজ যে ফ্যাসিস্ট বিভেদকামী শক্তি বাংলার বুকে তাণ্ডব চালাচ্ছে, বিভেদ বিষে ভরিয়ে দিতে চাইছে বাংলার আকাশ-বাতাস-জল-মাটি; তাদের দিকে দৃপ্ত কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য আরেকবার ফিরে যেতে হবে ১৯৬৬ সালের দ্বিতীয় পর্বের খাদ্য আন্দোলনের দিকে। ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী একদিকে বসিরহাট অন্যদিকে কৃষ্ণনগর দুই শহরে খাদ্যের অধিকারের দাবিতে মিছিলে গিয়ে শহীদ হন দুইজন স্কুলছাত্র। একজনের নাম নুরুল ইসলাম আরেকজনের নাম আনন্দ হাইত। যারা বিভেদ বিষে জর্জরিত করতে চাইছে নুরুল-আনন্দের মাটিকে, তাদের সামনে ব্যরিকেড হয়ে দাঁড়াবে ৩১ আগস্টের খাদ্য আন্দোলনের শহীদরা, ১ সেপ্টেম্বরের ছাত্র শহীদরা, আনন্দ হাইত-নুরুল ইসলামের সংগ্রামী স্পর্ধা সেই ব্যারিকেডের সামনের সারিতে থাকবে।

আমরা ভুলতে পারি না ৯১ সালের ৩১ আগস্ট মূল্যবৃদ্ধি বিরোধী মিছিলে গুলি চালিয়ে ‘নিরামিশ আন্দোলনকে আমিষ’ করে দেওয়া শাসকের ঔদ্ধত্যকেও।

দেশজুড়ে এই খাদ্য সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানির আকাশ ছোঁয়া দাম মানুষের পেটে লকডাউনকে জোরদার করছে। বিশ্ব খাদ্য সূচকে ভারত ইতিমধ্যেই ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। এই সংকটকে ঢেকে রাখার চেষ্টা চলছে সাম্প্রদায়িক তাস খেলে। এই ছক ভাঙতে হলে আরেকবার স্মৃতির হাতিয়ারকে শানিয়ে নিতে হবে আমাদের। ৩১ আগস্ট এবং ১ সেপ্টেম্বর শহীদ দিবসে ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইকে জোরদার করার শপথ নিতে হবে সম্মিলিতভাবেই।

-- নীলাশিস বসু   

খণ্ড-27
সংখ্যা-30