“আপনি ধনী কেননা আপনি সাদা মানুষ, আপনি সাদা মানুষ কেননা আপনি ধনী।” —ফ্রানৎস ফ্যানো
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস দুষ্প্রাপ্য কয়েকটি ছবি প্রকাশ করেছে। যা সেদেশে অতীতের একটি ভয়ঙ্কর ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ঘটনাটি ঘটে ৩১ মে-১ জুন ১৯২১ সালে, ওকলাহোমার তুলসায় কালো মানুষের বসতি গ্রিনউড ডিস্ট্রিক্টে। ডিক রোল্যান্ড নামের উনিশ বছরের এক কালো তরুণ একটি বিল্ডিং-এর লিফটে উঠছিলেন, হঠাৎ লিফট-অপারেটর সতেরো বছরের সাদা তরুণী স্যারাহ পেজের চিৎকার নাকি আশেপাশের লোকজনের কানে আসে। ছুটে এলে তারা দেখতে পান ডিক দৌড়ে পালাচ্ছেন আর স্যারাহ বিধ্বস্ত অবস্থায়। পুলিশ এসে ডিককে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু গুজব ছড়াতে থাকে, দলে দলে লাঠি-সোঁটা-বন্দুক হাতে সাদারা জড়ো হয়। তারপর আক্রমণ নেমে আসে গ্রিনউডের ওপর, নির্বিচারে গুলি চলে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কালোদের বাড়িঘর, লুট হয় সম্পত্তি। ৩০০-র বেশি কালো মানুষকে হত্যা করা হয়, হাজারের ওপর গৃহহীন হয়ে পড়ে। তান্ডব শেষ হলে, ডিক রোল্যান্ড নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং বেকসুর খালাস হয়ে যান।
তুলসার ওই বর্ণবিদ্বেষী গণহত্যার কথায় এসে পড়ে আমাদের দেশের ও জাতকেন্দ্রিক হত্যাকান্ডগুলির স্মৃতি। এইতো সেদিন ২০০৬ সালে ঘটেছিল খায়রলঞ্জির ঘটনা। মহারাষ্ট্রের ভান্ডারা জেলায় খায়রলঞ্জি এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এখানেই বসবাস করতেন দলিত কৃষক ভটমঙ্গে পরিবার-ভাইয়ালাল (বয়স৫৫), স্ত্রী সুরেখা(৪০), দুই ছেলেসু ধীর(২১) ও রোশন(১৯) এবং মেয়ে প্রিয়ঙ্কা(১৭)। এদের পাঁচ একর জমির পাশেই ছিল সেচের খাল কিন্তু নিচুজাত -মাহার- হওয়ায় খালের জল চাষের কাজে ব্যাবহার করা সহজ ছিলনা। এমনকি পানীয় জলও গ্রামের কুয়ো থেকে নিতে বাধা দেওয়া হত। নানা বিষয়ে গ্রামের অন্যান্য জাতের – কুনাবি, কালার ইত্যাদি – লোকেদের সাথে বিবাদ লেগে থাকত। এইরকমই কোনও এক বিবাদের জেরে একদল গ্রামবাসী ২৯সেপ্টেম্বর ভটমঙ্গে পরিবারের ওপর হামলা চালায়। মা ও মেয়েকে বিবস্ত্র করে গ্রামে ঘোরানো হয়, তারপর গণধর্ষণ করে খুন করা হয়। দুই ছেলেকে মেরে টুকরো টুকরো করে খালে ফেলে দেওয়া হয়। মিডিয়াতে ঘটনাটি প্রচার পায় দেশ জুড়ে দলিত মহিলারা প্রতিবাদী আন্দোলনে নামার পরে।
গত দেড়শো-দুশো বছর ধরে বর্ণ কিংবা জাতকে কেন্দ্র করে এধরনের জঘন্য হত্যাকান্ড অবিরত ঘটে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও প্রজাতান্ত্রিক ভারতে। এবং আরও অনেক দেশেই। কিন্তু তুলসা বা খায়রলঞ্জির মতো ঘটনার কয়েকটি বৈশিষ্ট উল্লেখযোগ্য : তুলসার আক্রান্ত কালো মানুষেরা ছিলেন ব্যবসায়ী, আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল – এতটাই সংগতিপন্ন যে তাদের বাসস্থান গ্রীনউডকে বলা হত ‘ব্ল্যাক ওয়াল স্ট্রীট’। অন্যদিকে, যারা তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলেন সেই সাদা মানুষদের সিংহভাগ ছিলেন কলে-কারখানায় কাজ করা শ্রমজীবি মানুষ, অর্থনৈতিক মানদন্ডে পিছিয়ে পড়া। খায়রলঞ্জির ভটমঙ্গে পরিবারও শুদ্র হলেও ছিলেন সম্পন্ন কৃষক, নিজেরই জমিতে চাষবাসে নিযুক্ত। আর, তাদের হত্যাকারীর দলে যারা ছিলেন তাদের জমিজমা ছিল সামান্য, কেউ কেউ অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা অর্জন করতেন। তাছাড়া, তারা ছিলেন ওবিসি, উচবর্ণের তো নয়ই, বরং জাত ব্যবস্থায় মর্যাদার ক্রমানুসারে নিচের দিকেই।
দেখা যাচ্ছে, বাস্তব জীবনে বর্ণ ও জাত – রেস ও কাস্ট – সর্বক্ষেত্রে পুরোপুরি অর্থনৈতিক বা শ্রেণিগত অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। শুধু অর্থনীতি বা শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তাই বর্ণবাদ বা জাতকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। রেসিজম অথবা কাস্ট মূলত আছে মনের গভীরে, অবচেতনায়। বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকারের মতে, “কাস্ট ইজ এ নোশন, এ স্টেট অফ মাইন্ড” – জাত একটা ধারণা, মনের অবস্থা। বহু যুগ ধরে কর্তৃত্ববাদী, বিভেদকামী সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ তাকে সযত্নে লালন করে এসেছে, শিশুকাল থেকেই পালিত হয়েছে মানুষে মানুষে আলাদা করার ভাবনাটা, একে অপরের মধ্যে স্তর বিন্যাসের ধারণাটা।
এই যে আমেরিকা-ইউরোপের কোথাও কোনও একটি রেস্তোরাঁয় বা সিনেমা হলে কালো মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ, স্কুলে এমনকি কলেজে তাদের আলাদা বসার নিদান অথবা আমাদের এই পোড়া দেশে নীচু জাতের কেউ গোঁফ রাখলে, ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে গেলে কপালে জোটে বেধড়ক পিটুনি – এ সবের পিছনে অর্থনৈতিক কারণ খুঁজতে যাওয়া বাতুলতার নামান্তর। বেস্টসেলার উপন্যাসে – টু কিল এম কিংবার্ড -- বা হলিউডের রূপোলি পর্দায় – গন উইথ দ্য উইন্ড – কালো মানুষকে অবজ্ঞার চোখে দেখা, পাতি বাংলা সিরিয়ালের নায়িকাদের কেমন যেন ফর্সা ফর্সা হওয়া, রবিবারের আনন্দবাজারে ‘পাত্র-পাত্রী’ বিজ্ঞাপনে গাত্রবর্ণ ও সবর্ণ পরিচিতির প্রতি সীমাহীন আকুতি, এমনকি প্রগতিশীল মিছিলে ‘কালা আইন বাতিল কর’ বা ‘কালো হাত গুড়িয়ে দাও’ স্লোগান ইত্যাদি ইত্যাদি -- বর্ণবাদ বা জাত যে আমাদের দীর্ঘকালীন অন্তরের ব্যাধি, সমাজ-মানসের পর্যুদস্ত হবার লক্ষণ তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
তবু না মেনে উপায় নেই যে বর্ণ-জাতের একটা জবরদস্ত শ্রেণি-অর্থনৈতিক বুনিয়াদও আছে। ইতিহাসের পাতা ওল্টানো যাক, চোখ ফেরানো যাক আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষী আর এদেশে জাতবিদ্বেষী দুটি কুখ্যাত গণহত্যাকান্ডের দিকে : ২০ এপ্রিল ১৯১৪ সাল, কলোরাডোর লুডলো কয়লা খনিতে ন্যাশনাল গার্ড ও আয়রন অ্যান্ড ফুয়েল কম্পানির পাহারাদাররা স্ট্রাইক ভাঙ্গতে খাদান শ্রমিকদের তাঁবু খাটিয়ে থাকার জায়গা টেন্ট কলোনিতে নির্বিচারে গুলি চালায়; নিহত হন শ’খানেক শ্রমিক ও তাদের পরিজনরা; গুহার ভিতরে আশ্রয় নেওয়া ১৩ জন শিশুকেও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। বলা বাহুল্য, শ্রমিকরা ছিলেন কালো আর খাদান-মালিকরা সাদা। (উডি গাথ্রির গানও আছে এই হত্যাকান্ড নিয়ে – লুডলো ম্যাসাকার)। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে ১৯৬৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর; তামিলনাডুর কিলভেনমানিতে ৪৪ জন দলিত ক্ষেতমজুরকে একটি কুড়েঘরে আটকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়; ক্ষেতমজুররা মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করছিলেন দীর্ঘদিন ধরে; উচ্চবর্ণের জমিদার ও ক্ষেত-মালিকরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হত্যাকান্ডটির আয়োজন করে।
ঘটনা দুটি থেকে পরিষ্কার, জাত–বর্ণের ব্যাপারটিকে শ্রেণিনিরপেক্ষ ও অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন বলার অর্থ ইতিহাসকে অস্বীকার করা এবং সামাজিক প্রক্রিয়ায় কার্য-কারণ সম্বন্ধকে গুলিয়ে ফেলা। তাই রেস-কাস্টের যে একটা শ্রেণিভিত্তি আছে তা জোরের সাথেই ব্যক্ত করা যেতে পারে। কাস্ট নিয়ে আম্বেদকারের লেখায় এমন ভাবনারই প্রতিফলন ঘটেছে। মনুবাদী বর্ণব্যবস্থা যে আসলে শ্রেণি ব্যবস্থাই তা যৌবনেই তিনি অনুধাবন করেন। ১৯১৬ সালে, ২১ বছর বয়সে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তার প্রথম রিসার্চ পেপার – কাস্ট ইন ইন্ডিয়া – পেশ করেন, তাতে লিখেছিলেন “কাস্ট ইজ এনক্লোজড ক্লাস।” জীবনভর তার যত কাজ, তা এই চিন্তাকে ধারণ করেই। তার কাছে কাস্ট সামাজিক উপরিকাঠামো যা দাঁড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর ওপর। চমৎকার একটি উদাহরণও দিয়েছেন তিনি : “ল্যান্ডলর্ডস আর এ ক্লাস, নোবিলিটি এ কাসট।”
আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পা রেখে রেস-ক্লাস বা কাস্ট-ক্লাস প্রশ্নের সঠিক মীমাংসা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। এ প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে, তাহলেই সন্ধান পাওয়া যাবে পুঁজিবাদকে, তার এযাবৎ সবচেয়ে সংকটময় মূহুর্তে, মোকাবিলার পথ।
ইতিহাস বলছে, বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদের সূচনা বর্ণবিদ্বেষকে বা রেসিজমকে পাথেয় করেই। সতেরো শতক থেকেই ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের একাংশ মধ্য ও উত্তর আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের পর দাস ব্যবসায় নামে। কালো মানুষদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গায়ের জোরে তাদের তুলে আনা হত এবং তারপর অ্যাটলান্টিক মহাসাগর পার করে বেচে দেওয়া হত আমেরিকায়। এভাবে কয়েক শতক ধরে দাস ব্যবসার মাধ্যমে ইউরোপ আমেরিকা দুই মহাদেশের পুঁজিপতিরাই বিপুল ধন সঞ্চয়ন করে। আবার দাস ব্যবসাই পুঁজিবাদকে বিশ্বব্যবস্থায় পরিণত করে। কার্ল মার্কস দেখিয়েছেন কিভাবে আমেরিকার ক্রীতদাসরা উৎপাদনের রসদ ও যন্ত্র হিসেবে বুর্জোয়া শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। আমেরিকার দক্ষিণে অ্যালাবামা, অ্যারিজোনা, লুইসিয়ানা, মিসিসিপি, নিউ মেক্সিকো, টেনেসি, টেক্সাস, ভার্জিনিয়া ইত্যাদি রাজ্যের বিস্তীর্ণ তুলো চাষের ক্ষেতগুলিতে আফ্রিকা থেকে আনা কালো ক্রীতদাসদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ফলেই ইংল্যান্ডের টেক্সটাইল মিলগুলি সচল হতে পেরেছিল এবং বিশ্ববাজারের দখল নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। মার্কসের কথায়, “মিসিসিপির ইতিহাস ছাড়া ম্যানচেস্টারের কোনও ইতিহাস নেই।”
আমেরিকার ক্রীতদাস প্রথার বহু শতক আগেই ভারতে যে জাতব্যবস্থা চালু হয়েছিল তা আমরা জানি। জোতিবা ফুলে ১৮৭৩ সালে তার গুলামগিরি প্রকাশ করেন, তাতে তিনি লিখেছেন, শুদ্র, অতি-শুদ্ররা দাসপ্রথা সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম, কেননা “তাদের দাসপ্রথার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। ... ব্রাহ্মণরা তাদের জয় করে দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধেছিল।” এই মতের সাথে আম্বেদকার পুরোপুরি সহমত না হলেও, দাস প্রথা আর জাতপ্রথা যে তুলনীয় তা তিনিও উল্লেখ করেছিলেন। দুটোই তো জন্মের আধারে সৃষ্ট।
১৯৪৭-এর পরে কৃষিতে ‘সবুজ বিপ্লব’, দ্রুত হারে শিল্পায়ন, নগরায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির চোখ ধাঁধানো অগ্রগতি কিন্তু জাতব্যবস্থার ওপর বুলডোজার চালাতে পারেনি। আজও ম্যানহোল সাফ করার মতো, মৃতদেহ দাহ করার মতো, গরুর চামড়া ছাড়ানোর মতো ‘হীন কাজ’ — মেনিয়াল জব — ওই শূদ্রদের হাতেই ন্যস্ত। আজও সগোত্রবিবাহ — এন্ডোগ্যামী — প্রচলিত, উৎসাহিত। আজও নানাভাবে অস্পৃশ্যতা বিদ্যমান। আর নয়া-উদারনীতির প্রকোপে দলিত ও আদিবাসীরা আজ বাস্তুচ্যুত, জীবিকাচ্যুত। তাদের ওপর অত্যাচার অবিচারের ধারা কেবল অব্যাহত নয়, তার মাত্রা ক্রমবর্ধমান।
বলা হচ্ছে, ‘সাহসী এক নতুন দুনিয়া’ -- এ ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড -- আগত। আসলে মুনাফার হার দ্রুত ও ক্রমাগত পড়তে থাকার ফলে পুঁজিবাদ ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন। এর থেকে উদ্ধার পেতে নয়া-দুনিয়ার নামে পুঁজিবাদ তার পরিক্ষিত সবচেয়ে পুরোনো ব্যবস্থাটাকেই ফিরিয়ে আনতে চায়। দুনিয়া জুড়ে সস্তা মজুরির দাসশ্রমিক তৈরি করে পুঁজির হিমালয় পাহাড় গড়ে তোলাই তার অভিপ্রায়। খেটেখাওয়া মানুষের ঐক্য ভেঙ্গে চুরমার করতে তার মূল হাতিয়ার বর্ণবাদ।
তাই মনে রাখতে হবে মার্কসের কথা : “সাদা চামড়ার শ্রমিক নিজের মুক্তি আনতে পারে না যতক্ষণ অন্য শ্রমিকদের কালো চামড়ার বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে”, আর এঞ্জেলা ডেভিসের কথা : “রেসিজম উন্মূলিত করা যাবে না ক্যাপিটালিজম উন্মুলিত না করলে।” এক হতে হবে দুই লড়াইকেই।
-- সুমিত