উত্তর-পূর্ব দিল্লীর সাম্প্রদায়িক হিংসা, যাকে বিজেপি দাঙ্গা নাম দিতে বদ্ধপরিকর, তা শুরু হয় এই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারী। বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র দিল্লী পুলিশের কাছে জাফরাবাদ-মৌজপুর-সীলামপুর সংলগ্ন রাস্তায় নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদসভা ভঙ্গ করার আবেদন জানায়, এবং তা না হলে তার দলের কর্মীদের সাহায্যে বলপূর্বক এই প্রতিবাদ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি জানায়। এই ঘটনার সামান্য পরে এই এলাকা জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সৃষ্টি হয় তা পরের দশ দিন ধরে চলতে থাকে। ৫৩ জন নিহত মানুষের মধ্যে ৩৬ জনই মুসলিম। মুসলিম-প্রধান এলাকাগুলিতে দোকান, বাড়ি কিছুকেই রেহাই দেওয়া হয় না। তৎসত্ত্বেও বিজেপির শীর্ষ-নেতৃত্ব এই ঘটনার দায় নেওয়া থেকে বিরত থাকে।
এই পুরো ঘটনার অসামঞ্জস্যের কথা মাথায় রেখে দিল্লীর সংখ্যালঘু কমিশন সুপ্রিম কোর্টের উকিল এম আর শামসাদের নেতৃত্বে মার্চ মাসে যে অনুসন্ধানকারী দল গঠন করে, তারা গত ১৭ জুলাই তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে। এই কমিটিতে শামসাদ ছাড়াও ছিলেন শিরোমণি গুরুদ্দ্বারা কমিটির সদস্য গুরমিন্দর সিং মাতারু, সমাজকর্মী তানবীর কাজী, মানবাধিকার কর্মী আবু বকর সাব্বাক এবং অদিতি দত্ত, জামিয়া মিলিয়ার অধ্যাপক হাসিনা হাশিয়া এবং মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ তহমিনা অরোরা।
রিপোর্টটিতে খুব পরিষ্কারভাবে এই ঘটনাকে “পূর্বপরিকল্পিত এবং উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত” বলা হয়েছে। এই কথাও সাফ সাফ লেখা হয়েছে কীভাবে বিজেপি প্রার্থী ও নেতারা ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে ফেব্রুয়ারী ২০২০ পর্যন্ত দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বারবার হিংসার উস্কানি দিয়েছে। এই সময়ের প্রচারের বহু বক্তৃতাই সাম্প্রদায়িক হিংসার বাইরে অন্য কোনো কথাই বলেনি।
এই রিপোর্টে বলা হয়েছে কীভাবে জামিয়া মিলিয়ায় আক্রমণের ঘটনা থেকে এই একমুখী হিংসার ঘটনার পরিকল্পনা শানানো শুরু হয়। অভিনব ঠাকুর, কপিল মিশ্রর মতো বিজেপির যুব নেতারা বহুবার জামিয়া মিলিয়ার ছাত্র-বিদ্রোহীদের প্রকাশ্যে দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়। দিল্লী এবং দেশের অন্যান্য ছোট বড় শহরে নাগরিকতা-আইন বিরোধী বিক্ষোভমঞ্চগুলিকে “মিনি পাকিস্তান” বলা থেকেও এরা পিছু হটেনি। এমনকি ডিসেম্বর মাসে উগ্র-হিন্দুবাদীদের জামিয়া-মিলিয়ার লাইব্রেরীতে, হস্টেলে ঢুকে তাণ্ডবের ঘটনায় বাস পোড়ানোর ঘটনা ছাত্রছাত্রীরাই করেছে, এরকম দাবি করে প্রচারসভায়। শাহিন-বাগের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক গণবিদ্বেষ তৈরির চেষ্টায় হিংসার উস্কানি দেওয়া থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব আইন বিরোধীদের পাকিস্তানি বা রাষ্ট্রদ্রোহী বলা পর্যন্ত সবরকম কথা বলেছে এই নেতারা। কপিল মিশ্র যে ভাষণে “বলপূর্বক” জাফরাবাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদসভায় ঢুকে তাকে ভেঙ্গে দেওয়ার উস্কানি দেয়, রিপোর্টটিতে পরিষ্কারভাবে সেই ভাষণকে দিল্লি গণহত্যার অন্যতম কারণ বলা হয়েছে।
দিল্লী-পুলিশের মিডিয়া মুখপাত্র অনিল মিত্তল জানিয়েছেন, “এই রিপোর্ট এখনো আমাদের হাতে পৌঁছায়নি। পেলেই মন্তব্য করতে পারবো। আমরা সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছি যাতে তারা তাদের অভিযোগ নিয়ে সামনে আসে। ইতিমধ্যে আমরা হেল্পলাইন-নাম্বার তৈরি করেছি শুধু এই ঘটনার কথা মাথায় রেখে। ৭৫২টি অভিযোগের ভিত্তিতে ২০০টি চার্জশীট নথিভুক্ত হয়েছে, যা এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বাধিক। সর্বোপরি আমরা নিশ্চিত করেছি এই তদন্ত যাতে নিরপেক্ষ ও বলিষ্ঠ হয়।”
দিল্লী পুলিশ নিজেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করলেও, এই রিপোর্ট ঠিক উলটো কথাই বলছে।
দিল্লী প্রশাসন এবং পুলিশকে অযোগ্য এবং পক্ষপাতদুষ্ট বলা হয়েছে রিপোর্টে। এতে বলা হয়েছে, ঘটনার চার মাস পরেও ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন দিতে পারেনি দিল্লী প্রশাসন। এই ঘটনায় ৫৩ জন নিহত এবং ৪০০ জন আহত হলেও বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হন, বা তাদের জীবিকার অভাবনীয় ক্ষতি হয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে হতাহত ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া বহু-বিলম্বিত এবং সামঞ্জস্যহীন। ঘটনার চার মাস পরেও বহু ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি, লুঠ, অগ্নিসংযোগের পুরো ঘটনা যথাযথভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি। মৌজপুর, ভজনপুরা, শিব-বিহার, করাওয়াল নগর এবং আরও বহু হিংসা-কবলিত জায়গায় যে সামান্য সংখ্যক ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ নিতে পেরেছে পুলিশ, তারও অন্তর্বর্তী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। যে কয়টি ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে তা নামমাত্র।
আক্রান্তদের সাথে কথোপকথনের ভিত্তিতে রিপোর্টে লেখা হয়েছে, বহুক্ষেত্রে এফআইআর নেওয়ায় দেরী করা হয়েছে, বা নেওয়ার পরেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্তদের পুলিশের তরফে চাপ দেওয়া হয়েছে অভিযুক্তদের সাথে সমঝোতা করার জন্য। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রান্তদেরই গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
শাহীন-বাগ এবং অন্যান্য ‘নাগরিকতা সংশোধনী আইন’-বিরোধী প্রতিবাদ মূলত মুসলিম মহিলারাই চালনা করছিলেন, এবং সেই কারণে তাদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব প্রতিফলিত হওয়ায় বহুক্ষেত্রে তারা থানায় যেতে ভয় পাচ্ছেন। এই ভীতিকে বাস্তবে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে দিল্লী পুলিশের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি।
এই ‘দাঙ্গায়’ কোনো হিন্দু মন্দিরের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু মাদ্রাসা বা কবরস্থান ছাড়া শুধুমাত্র মসজিদই জ্বালানো হয়েছে ২২টি। সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য তৈরি হওয়া ক্যাম্পগুলি থেকেই হিংসা-বিধ্বস্ত মানুষগুলিকে উৎখাত করা হয়েছে দু-দুবার। বর্তমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কোনো পরিকল্পনা ছাড়া স্থানান্তরিত করা হয়েছে তাদের।
এই সব তথ্যের ভিত্তিতে একটি দু-পাতার চিঠিতে ১১ জুন জবাব চেয়ে পাঠিয়েছে কমিশন। কিন্তু দিল্লী পুলিশ এখনো তার কোনও উত্তর দিয়ে উঠতে পারেনি।
রিপোর্টে এও বলা হয়েছে, পরিকল্পনামাফিক ঘনবসতিযুক্ত এলাকায় হামলাকারীরা দল বেঁধে লুকিয়ে থেকেছে, সাধারণ দাঙ্গায় যা হয় না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের পরিচয়পত্র দেখে হামলা করার ঘটনা হয়েছে বহু ক্ষেত্রে।
কেন্দ্র সরকার নিয়ন্ত্রিত দিল্লি পুলিশ দাবি করেছে যে, এই হিংসার ঘটনা প্রথম শুরু করেছে নাগরিকতা-আইন বিরোধী আন্দোলনকারীরা। চন্দ্রশেখর আজাদের ভীম আর্মীর ডাকে আয়োজিত জাফরাবাদের মেট্রো স্টেশনের সামনের বিক্ষোভসভা থেকেই এই ঘটনার শুরু বলে দাবি করেছে পুলিশ। কিন্তু কমিশনের এই রিপোর্ট খুব জোরের সাথে দেখিয়েছে যে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের উস্কানিমূলক বক্তৃতা আর বলপূর্বক বিক্ষোভকারীদের হঠানোর হুমকির পরেই এই একমুখী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার সূত্রপাত হয়।
ক্ষতিপূরণের রকমেও আকাশপাতাল তফাত লক্ষ্য করেছে কমিটি। পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারী চাকুরিজীবীদের বাকিদের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে, যা সরকারী নিয়ম নয়।
- কৌশিকী ভট্টাচার্য