করোনা আবহে সাধারণ মানুষের দুর্বিসহ অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নির্লজ্জভাবে ভারতীয় রেলকেও কর্পোরেট স্বার্থে ব্যবহার করে জনজীবনকে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কর্পোরেট কোম্পানির স্বার্থই এই বিজেপি সরকারের একমাত্র চালিকাশক্তি। শুরু হয়েছিল আগেই, প্রতিবাদও ছিল ব্যাপক অংশের রেলকর্মী-সহ সাধারণ মানুষের মধ্যে। সরকার কর্তৃক একপ্রকার অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করার মধ্যে দিয়ে, পরিবহন তথা জীবিকা নির্বাহে এক বৃহত্তর অংশের শ্রমজীবী মানুষের রেল-নির্ভরতাকে ধর্তব্যের মধ্যে না রেখে গুটিকয়েক মুনাফেকের মুনাফা নির্ভর এজেন্ডা রুপায়নে একগুচ্ছ কর্মসূচী নিয়েছে ভারতীয় রেল। তারা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে পর্যায়ক্রমে সারা রেল ব্যাবস্থাকেই বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার।
১) আনলক পর্যায়ে রেল চলাচল স্বাভাবিক না হতেই রেলমন্ত্রক বহু ট্রেনকেই স্থায়ীভাবে বাতিল ঘোষণা করেছে, যে ট্রেনগুলো মুনাফা তথা বাবুয়ানায় অন্যদের থেকে পিছিয়ে থাকলেও শ্রমজীবী মানুষের কাছে তাদের গুরুত্ব ছিলো একটু বেশিই। তারমধ্যে পূর্ব রেল অর্থাৎ পশ্চিম বাংলার সংযোগকারী ১৭ জোড়া ট্রেন (মেল/এক্সপ্রেস সহ) তালিকায় রয়েছে। আছে হাওড়া-অমৃতসর এক্সপ্রেস, তুফান এক্সপ্রেস, হাওড়া-রাজগির, শিয়ালদহ-বারানসি, শিয়ালদহ-সিতামাড়ি (মুজফফরপুর), কোলকাতা-পাটনা সহ অন্যান্য।
২) ইতিমধ্যেই রেল ১০৮টি রুটে প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালাতে বেসরকারী টেন্ডার জারি করেছে। হাওড়া শিয়ালদহ থেকে ছাড়ে এমন ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনের বেসরকারী হাতে দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। টিকিট ব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই আইআরসিটিসি-র হাতে। নামমাত্র কিছু অংশ এখনও রেলের হাতে থাকলেও অনেক ট্রেনে টিকিট বিক্রির অধিকার নেই রেলের। ডরমিটরি, ওয়েটিং রুম-সহ সমস্ত ক্যাটারিং ব্যবস্থায় ব্যাবসায়ী অধিকার পেয়েছে বেসরকারী সংস্থা।
৩) ৪ লাখ কর্মচারি সংকোচনের লক্ষ্য সহযোগে ননসেফটি ক্যাটাগরিতে ৫০ শতাংশ পোস্ট সারেন্ডার করার আদেশ জারি হয়েছে এবং কোথাও তা কার্যকরী করার সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে বর্তমান মাসের (জুলাই) ১০ তারিখ, কোথাও একটু বেশি বা কম। রেলওয়ে রিক্রুটমেট বোর্ড/সেল তুলে দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে, পাশাপাশি রেলওয়ের তত্ত্বাবধানে বেসরকারী সংস্থার দ্বারা অত্যন্ত কম বেতনে কর্মী নিয়োগ করে অনুসন্ধান, চেকিং ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করানো হচ্ছে।
৪) নিউ পেনশন স্কিম বাতিল সহ কিছু অধিকারের দাবিতে রেল কর্মচারীরা দীর্ঘদিন লড়াই চালানো সত্ত্বেও তার বিপরীতে হেঁটে কর্মজীবন কমিয়ে (৫৫ বছর বয়স বা ৩০ বছর চাকরি যেটা আগে আসে) আনার কৌশলগত পথ অবলম্বন করে বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছাবসরে পাঠানোর তালিকা প্রস্তুত করার বিজ্ঞপ্তি জারি করছে এই সরকার।
৫) ট্রেন কম্পার্টমেন্ট সহ সমস্ত স্টেশনগুলির হকার উচ্ছেদের ব্লুপ্রিন্ট প্রস্তুত, জীবিকা হারাবে গরিব মানুষ আর সেখানে ব্যাবসার একচেটিয়া অধিকার থাকবে কোন বহুজাতিক সংস্থার।
৬) ব্যাপক মানুষের বেকারত্বর সুযোগ নিয়ে অতি সামান্য বেতনে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু এবং ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা কাজে বাধ্য করার আইনি স্বাধীনতা যথেচ্ছ ভাবেই বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে দিচ্ছে এই সরকার বিভিন্ন শ্রম আইন সংশোধনের মধ্যে দিয়ে।
একদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথা বলছেন, অপর দিকে দেশের সমস্ত সরকারী ক্ষেত্রই দেশি-বিদেশি কর্পোরেটের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ হারাচ্ছে তার অধিকার। রেলের ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু নয়। সমস্ত পরিবর্তনগুলো ঘটছে অতি দ্রুততার সাথে এই লকডাউন সময়কাল জুড়ে সাধারণ মানুষের অসহায়তাকে কাজে লাগিয়ে। সামান্য অংশের বিলাসী মানুষ প্রাথমিকভাবে এই দৃশ্যত ঝাঁচকচকে ব্যবস্থার শরিক হতে চাইলেও দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে নেমে আসতে চলেছে এক ভয়ানক পরিণতি।
জেনারেল কম্পার্টমেন্ট তুলে দেওয়ার পক্ষে রেল। ট্রেন যাত্রায় গরীব মানুষের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে মুনাফার মাপকাঠিতে। রেলে কয়েকগুণ ভাড়া বৃদ্ধি এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ইতিমধ্যেই সারা বছরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে চাহিদার নিরিখে চার থেকে ছয় গুণ ভাড়া আদায়ের নজির রেখেছে রেল ‘প্রিমিয়াম’ শব্দ ব্যবহার করে। প্রস্তাব আছে প্রতি সপ্তাহেই চাহিদার নিরিখে দিন ভাগ করে ভাড়া বৃদ্ধির। বেসরকারী টিকিটিং ব্যাবস্থায় ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে কিছু ট্রেনে উচ্চশ্রেণির কামরা না চালিয়েও মাসের পর মাস ওই নির্দিষ্ট কামরার টিকিট বিক্রি করা হয়েছে, যার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে এসেছে কর্মরত রেলকর্মী আর যাত্রীদের মধ্যে সংঘাত।
রেল বেসরকারী হওয়ার দুর্ভোগ শুধুমাত্র রেলকর্মী ও তার পরিবারের নয়, প্রায় সর্বস্তরের মানুষের ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও ভাবে তার প্রভাব থাকবে। দেশের সর্ববৃহৎ পরিবাহী ব্যবস্থা রেলের ওপর নির্ভরতা আমাদের সবার। প্রতিহত করার দায়ও তাই আমাদেরই। রেল কর্মচারিরা সংগঠিতভাবেই লড়াইয়ে আছেন, থাকবেনও। শুধুমাত্র রেলকর্মী নয়, সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদী প্রয়াসেই বন্ধ হতে পারে এই লুঠের কারবার, পাল্টে যেতে পারে এই লুটেরার সরকার।
-- শঙ্কর রায়