সংরক্ষণ এবং সামাজিক ন্যায়কে সুরক্ষিত করুন
pro

সুপ্রিম কোর্টের একটা বেঞ্চ মৌখিকভাবে এই অভিমত প্রকাশ করেছে যে নিপীড়িত এবং পশ্চাদপদ শ্রেণীগুলোর জন্য সংরক্ষণ সংবিধান প্রদত্ত কোন মৌলিক অধিকার নয়। এই অভিমত আরও একবার এই আশঙ্কাকেই শক্তিশালী করছে যে সামাজিক ন্যায়ের সংস্থানগুলোকে দুর্বল করে তোলার লক্ষ্যে সমবেতভাবে পরিকল্পিত এক প্রচেষ্টা সক্রিয় রয়েছে। তামিলনাড়ুর সমস্ত রাজনৈতিক দল রাজ্যগুলোর ছেড়ে দেওয়া নিট (এনইইট) আসনগুলোতে ৫০ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আবেদন পেশ করতে গেলে সুপ্রিম কোর্টের ওই বেঞ্চ আবেদন গ্ৰহণ করতে অস্বীকার করে এবং উক্ত অভিমত প্রকাশ করে। পরবর্তীতে তামিলনাড়ুর দলগুলো ওই আবেদন তুলে নিয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্টে আবেদন দাখিল করে।

সুপ্রিম কোর্ট ফেব্রুয়ারি মাসে পদোন্নতি সম্পর্কে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টের দেওয়া একটা রায়কে বাতিল করতে গিয়ে বলে যে সংরক্ষণ কোন মৌলিক অধিকার নয় এবং রাজ্যই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞই দেখিয়েছেন যে এই দাবি বিভ্রান্তিকর এবং সঠিক নয়। সংবিধানের ১৬(১) ধারা সমস্ত নাগরিককে সমান সুযোগ লাভের মৌলিক অধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং এই ধারা বৈষম্যের শিকার হওয়া থেকেও রক্ষা করে। ১৯৭৬ সালের এক ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল যে, ১৬(৪) ধারা — যা রাষ্ট্রকে নিপীড়িত এবং পশ্চাদপদ সম্প্রদায়গুলোর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার অনুমতি দিয়েছে — ১৬(১) ধারায় প্রদত্ত সমতার সংস্থানের কোন ব্যতিক্রম নয়, বিপরীতে তা এরই একটা “দিক” এবং “জোরালো পুনরাবৃত্তি”।

ভারতীয় সমাজে অসাম্য এবং নিপীড়িত ও পশ্চাদপদ জাতগুলোর বিরুদ্ধে চালানো বৈষম্য এখনও ব্যাপক হারেই চলছে। সংরক্ষণ নিজের থেকেই ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত অসাম্যকে শুধরে দিতে পারে না। তবে, শিক্ষা ও কাজ পাওয়ার অধিকার থেকে নিপীড়িত ও পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ের মানুষদের বঞ্চিত করার যে প্রবণতা ব্যাপক হারে রয়েছে, তাকে শোধরানোর ব্যাপারে সংরক্ষণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বন্দোবস্ত হয়েই দেখা দিয়েছে।

সংরক্ষণ হল ভারতের সামাজিক ন্যায়-এর লক্ষ্যে গৃহীত মৌলিক নীতি, এবং গত কয়েক বছরে বেশ কিছু উদ্বেগজনক সংকেত পাওয়া গেছে যার থেকে মনে হচ্ছে যে সংরক্ষণ ব্যবস্থা বিপন্নতার মুখে। আরএসএস হল বিজেপির মূল সংগঠন, এবং বিজেপি গৃহীত নীতিমালার পিছনে প্রধান অনুপ্রেরণা তারই থাকে। এই আরএসএস ইতিহাসগত দিক থেকে জাত-ভিত্তিক সংরক্ষণের প্রতি বিরুদ্ধতাই দেখিয়ে এসেছে। আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকার তাঁর ‘বাঞ্চ অব থটস’ রচনা সংকলনে এসসি/এসটি-দের জন্য সংরক্ষণের দাবিকে সাম্প্রদায়িক ও জাতি-বিরোধী বলেই গণ্য করেছেন। মাঝেমধ্যেই আরএসএস নেতারা সংরক্ষণের নীতির পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে থাকেন, আর বিজেপি নেতারা সেই সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছেন যা নাগরিকদের, ভারতের নিপীড়িত সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘুদের অধিকারকে সুরক্ষিত করেছে।

sgg

 

মোদী জমানার গত ছ-বছরে সরকার এমন বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা সংরক্ষণের সুযোগ ও বৈধতাকে লঘু করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তাদের ২০১৬ সালের ৫ মে তারিখের বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতকে নিয়ন্ত্রিত করার যে কথা বলে তা ব্যাপক সংখ্যক আসন হ্রাসে পরিণতি পায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমফিল/পিএইচডি পাঠক্রমে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে সংরক্ষণ কার্যত বিলুপ্ত হয়। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বহু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে “স্বায়ত্তশাসিত” বলে ঘোষণা করে। এই সমস্ত “স্বশাসিত” প্রতিষ্ঠান এবং তার সাথে “প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে” ভর্তি এবং অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ পূরণ করার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এগুলির সাথে সংরক্ষণের সাংবিধানিক বন্দোবস্তকে নিয়ন্ত্রিত ও লঘু করে সুপ্রিম কোর্টের একের পর এক রায় প্রদানকে মিলিয়ে বিচার করলে তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক হয়েই দেখা দিচ্ছে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্টের একটা রায়ে এসসি/এসটি নিপীড়ন নিরোধক আইনকে ভোঁতা করে তোলার চেষ্টা হল, এবং ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আর একটা রায়ে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ১৩ দফা রোস্টার বলবৎ করা হল তাতে অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের দফারফা হওয়ার উপক্রম হল। উভয় রায়ের ক্ষেত্রেই দেশব্যাপী ব্যাপক আকারের প্রতিবাদ সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য করে এবং সরকার এমন আইনি বিধান গ্ৰহণ করে যাতে সুপ্রিম কোর্টের রায় অকার্যকর হয়ে যায়।

এখন সুপ্রিম কোর্টের এই সমস্ত রায়ে এবং মৌখিকভাবে ব্যক্ত অভিমতে সংরক্ষণকে মৌলিক অধিকার নয় বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা সংরক্ষণের অবস্থানকে টলোমলো করে তুলছে। এসসি/এসটি/ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণ সামাজিক ন্যায়ের পরীক্ষিত বন্দোবস্ত। এর মাথার ওপর অনিশ্চয়তার যে খাঁড়া নিরন্তর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, তার থেকে একে রক্ষা করতে হবে। সমাজের সমস্ত গণতান্ত্রিক অংশকে এগিয়ে এসে এটা সুনিশ্চিত করতে হবে যে সংসদ যেন সংরক্ষণ সম্পর্কিত সমস্ত আইনকে সংবিধানের নবম তপশিলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেয় যার ফলে সংরক্ষণকে আর আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়তে হয়।

-- কবিতা কৃষ্ণাণ 

খণ্ড-27