“কমরেড শোন বিউগল ওই হাঁকছে রে”
com

১৯৭১-৭২-এ আমাদের প্রিয় রাজ্যটা আক্ষরিক অর্থেই ‘মৃত্যু উপত্যকা’ হয়ে উঠেছিল। ১৯৭৭ সালে বিখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে জরুরি অবস্থা আসলে জারি হয়েছিল ১৯৭১ সালেই, তখনই শুরু হয়েছিল গণতন্ত্র হরণ ও প্রতিবাদী কন্ঠস্বর রুদ্ধ করার ফ্যাসিস্ত প্রক্রিয়া।

তৃতীয় ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের শুরু ১৯৭২ সালে, এপিসেন্টার ছিল কলকাতার কার্জন পার্ক, প্রশিক্ষণ ছাড়াই গণসঙ্গীত, নাটক, কবির লড়াই ইত্যাদির মাধ্যমে। সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলী শিল্পের আঙ্গিকে সোজাসাপটা মানুষের কাছে তুলে ধরা ও তাদের সাথে আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্দিষ্ট বার্তা এক বড় পরিসরে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদে প্রথিতযশা কবি, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী, লিটল ম্যাগাজিন সংগঠনগুলি এই কর্মকাণ্ডে সামিল হন। আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাটি বিপ্লবী বামপন্থা বা নকশালপন্থী আন্দোলনের দিশায় গড়ে উঠেছিল। ১৯৭২-৭৩ সালে কার্জন পার্কে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালানোর পর একই সঙ্গে বেশ কিছু ছোট সাংস্কৃতিক দল কোলকাতা ও শহরতলির বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করতে শুরু করে। আমাদের সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ছিল রণপায়ে হেঁটে যাওয়ার কবিতা, রক্তে তুফান তোলা গণসঙ্গীত, পথ নাটিকা, লিটল ম্যাগাজিনের স্বৈরতন্ত্র বিরোধী প্রবন্ধ, ছোট গল্পের সম্ভার। চোখে দিন বদলের স্বপ্নের সাথে দগদগে ক্ষতের মতো ছিল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সরোজ দত্তের প্রশাসনিক হত্যার ঘটনা।

তখন কোলকাতার মঞ্চগুলো কাঁপিয়ে চলছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে তোলার একাধিক নাটক। কার্জন পার্কে বাদল সরকারের হাত ধরে এল বামপন্থী নাট্য আন্দোলনের নতুন ন্যারেটিভ, অঙ্গন মঞ্চের নাটক। এই সবকিছু মিলে নির্মাণ হল স্বৈরাচারের যথার্থ সাংস্কৃতিক প্রত্যুত্তর।

বিপ্লবী বামপন্থী ধারার সাংস্কৃতিক কর্মীরা নিজেদের ঐক্যকে আরও প্রসারিত করতে ২০ জুলাই ১৯৭৪ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবসে একটি সাংস্কৃতিক পরিক্রমার আয়োজন করেন। এই পরিক্রমার আয়োজকরা ছিলেন বিভিন্ন নাট্য গোষ্ঠী, প্রস্তুতি পত্রিকা, অমিতেশ সরকার, অমিত রায়, শিবাজি (দেবাশিস্) ভট্টাচার্য, কল্লোল দাশগুপ্ত, সাগর চক্রবর্তী ছাড়াও আরও অনেক ছোট পত্রিকা, গণসঙ্গীতের দল। মিছিলের জমায়েতের জায়গা ছিল কার্জন পার্ক সংলগ্ন সিদো-কানহু ডহর। কিন্তু কার্জন পার্কে ঢোকার মুখে পুলিশ বেপরোয়া লাঠি চার্জ শুরু করে। ঘটনাক্রমে ওই দিনটি ছিল শনিবার, কার্জন পার্কে যথারীতি নাটক চলছিল, মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ ছত্রভঙ্গ হয়ে নাটকের দর্শকের ভিড়ে মিশে যায়। দুঃখজনকভাবে পুলিশের লাঠির নিশানায় চলে আসেন নাটকের দর্শকরাও, বন্দুকের কুঁদোর আঘাতে লুটিয়ে পড়েন নাট্যামোদি দর্শক প্রবীর দত্ত। না, উনি পালানোর চেষ্টাও করেননি।

karjanpark

পরের ঘটনা, কিছু প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত

গুরুতর ভাবে জখম প্রবীর দত্তকে প্রায় কোলে তুলে অনেকটা দূর নিয়ে যান দীপা দি (লিগাল এইড কমিটি)। ততক্ষণে প্রবীরের মৃত্যু হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের মর্গে সন্ধে থেকে সারারাত প্রবীরের মৃতদেহের সামনে বসে থাকেন এপিডিআর-এর সহ সম্পাদক শ্রী সঞ্জয় মিত্র।

ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার হন ৩২ জন সাংস্কৃতিক কর্মী। যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল তার টাইটেল ছিল "রুদ্রদেব মিত্র অ্যান্ড আদার্স ভার্সাস স্টেট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল”। উল্লেখ্য, মিছিলে অংশগ্রহন করেছিলেন কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায়।

প্রবীর হত্যার তদন্ত দাবি করে মেমোরাণ্ডাম তৈরি হয়, স্বাক্ষর করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তাপস সেন, উৎপল দত্ত, অসিত বসু প্রমুখ।

ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে গণকনভেনশনে এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করা হয়। তবে ৩২ জন সাংস্কৃতিক কর্মী গ্রেফতার হলেও কনভেনশন আয়োজকদের পক্ষ থেকে মাত্র তিন জনের মুক্তির দাবি করা হয়!

ঘটনার এক মাস পরে কার্জন পার্কে বাদল সরকারের নির্দেশনায় 'মিছিল' নাটকটির সফল অভিনয় হয়। বিভিন্ন গ্রুপ থেকে অভিনেতারা অংশ গ্রহণ করেন, দর্শকের ঢল নামে।

কার্জন পার্কে পুলিশের হিংস্রতার কারণটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। মিছিলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্লোগানের সাথে সাথে ‘সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ বিরোধী স্লোগানও দেওয়া হয়। একটি ইংরাজি দৈনিকে মিছিলের আয়োজকদের নক্সাল বলে দেগে দেওয়া হয়।

প্রবীর হত্যার তদন্ত রিপোর্ট দিনের আলো দেখেনি। ৩২ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা উক্ত মামলাটি ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ঘোষিত জেনারেল অ্যামনেস্টির আওতায় আসে ও তুলে নেওয়া হয়।

লাঠি চার্জের নেতৃত্বে ছিলেন হেয়ার স্ট্রিট থানার ওসি। নেপথ্য মস্তিষ্ক ছিলেন গোয়েন্দা বিভাগের অশোক খাসনবিস।

পরিশিষ্ট

কার্জন পার্কে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংগঠিত হওয়ার প্রাথমিক প্রচেষ্টা জোর ধাক্কা খাওয়ার পর স্বভাবতই মনে হয়েছিল যে তার আগের তিন বছর ধরে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেমে আসবে স্থিতাবস্থা। বাস্তবে কার্জন পার্কের ঘটনা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিয়ে এল নতুন জোয়ার। কোলকাতা ও মফস্বল শহরগুলিতে নতুন নতুন সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠতে শুরু করলো। গানের দল অরণির জন্ম হলো ২১ জুলাই। ঢাকুরিয়ায় গড়ে উঠলো ‘সমতান সাংস্কৃতিক সংস্থা’। হাজরা পার্কে তৈরি হলো ‘উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক মঞ্চ’। তৃতীয় ধারার অঙ্গন মঞ্চের নাটকের দলগুলিতে নতুন জোয়ার এলো। এর ১১ মাস পরে জারি হয় এমারজেন্সি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ত শক্তি জাঁকিয়ে বসেছে। ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার প্রাক্কালে যে অবস্থা ছিল, আজ তা আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। গণতন্ত্র, সংবিধান সবই আক্রান্ত। মেধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এই সরকার। কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ধারাবাহিকভাবে খুন হয়েছেন দাভোলকার, পানসারে, কালবর্গী, গৌরী লঙ্কেশ। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সহ প্রতিবাদীরা জেলে বন্দি। সর্বত্র চলছে নিশ্চুপ করিয়ে দেওয়ার ফ্যাসিস্ত রাজনীতি। বেলাগাম কর্পোরেট শোষন লুন্ঠনে কোটি কোটি দেশবাসীর প্রিয় স্বদেশ আজ পরিণত হয়েছে নবারুণ বর্ণিত সেই ‘জহ্লাদের উল্লাস মঞ্চে’, ছদ্ম দেশপ্রেমে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করার এবং হাজার হাজার জনজাতি ও উৎপীড়িত গোষ্ঠীর মানুষকে জমি ও জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর এই সরকার। দেশব্যাপী উত্তাল গণজাগরণই পারে এই ফ্যাসিস্তদের সবক শেখাতে। এই গণজোয়ারে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অতীতের মতোই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। প্রবীর দত্তকে স্মরণ করে আসুন আমরা সেই শপথই নিই।

- তথ্য সূত্র : কল্লোল দাশগুপ্ত, অমিত রায়, স্বপন চক্রবর্তী, বিমল দে ও অপূর্ব মুক্তিকামী

- শান্তনু ভট্টাচার্য  
২০/০৭/২০  

খণ্ড-27