প্যানডেমিক প্যানিক যেন প্যান্ডেমোনিয়াম তৈরি না করে
paa

মোট কোভিড সংক্রমিতের সংখ্যায় ভারত কিছুদিন আগেই তিন নম্বরে এসে পৌঁছেছে এবং আপাতত এই অবস্থানেই বেশ কিছুদিন থাকবে এটা নিশ্চিত। দুনম্বরে থাকা ব্রাজিলের সাথে ব্যবধানটা অনেকটাই বেশি। আর এক নম্বরে থাকা আমেরিকার সংক্রমণও মাঝে কিছুটা কমার পর আবার বাড়ছে ভীষণভাবে। এবং তা ব্রাজিল বা ভারতের থেকেও অনেক বেশি সংখ্যায়।

অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন বা প্রথমদিকে সংক্রমণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। মনে করা হচ্ছে আরো কিছু কারণের সঙ্গে লকডাউন সেখানে যথাযথ হয়েছে বলেই এই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। যা আমেরিকা বা ব্রাজিলে হয়নি। ট্রাম্প এবং বোলসেনারোর বিরুদ্ধে হঠকারিতার অভিযোগও বেশ প্রবল।

ভারতে লকডাউন নিয়ে মিশ্র মতামত আছে। অনেকে মনে করেন লকডাউন করা হয়েছিল বলে অনেকদিন পর্যন্ত সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা গেছিল। লকডাউন পর্বের মধ্যেই পরিযায়ী শ্রমিকদের সংকটের দিকটি সামনে আসা ও তাকে মোকাবিলা করার জন্য তাদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করার মধ্যে দিয়ে অনেক অসংক্রমিত এলাকায় সংক্রমণ স্বাভাবিকভাবেই ছড়াতে শুরু করে। তারপর লকডাউনকে তুলেই নিতে হয় ধাপে ধাপে। বস্তুতপক্ষে লকডাউন যেভাবে গরিব নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তাতে লকডাউন না তুললে নিঃসন্দেহে রুটি-রুজির দিক থেকে কোটি কোটি মানুষের জন্য আরো অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হত।

লকডাউন আরো দীর্ঘস্থায়ী যদি করতেই হত, তাহলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির তরফে প্রান্তিক ও বিপদগ্রস্থ মানুষদের জন্য একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিতে হত। যেমন নিখরচায় নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিলিবণ্টন ব্যবস্থা যথাযথ করা। এটা করা গেলে তবেই হয়ত ভারতে লকডাউন চালিয়ে যাওয়া ও কঠোর করা সম্ভব ছিল।

তবে শুধু রেশন বিলির সমস্যা নয়, আমাদের দেশ ও রাজ্যের বাস্তবতা হল ছোট ছোট একটা দুটো ঘরে পরিবারের অনেকের বাস। এই সমস্যার মোকাবিলা করা নিঃসন্দেহে বেশ কঠিন।

saf

 

ফলে ভারতের মতো দেশে পশ্চিম ইউরোপের মতো কয়েক মাসের দীর্ঘ ও কঠোর লক ডাউন চালিয়ে যাওয়া অন্যান্য অনেক জটিলতা তৈরি করত। শেষদিকে মানুষ আর লকডাউন মানার জায়গায় ছিলেন না, এটা লক্ষ্যই করা গেছিল বহু জায়গায়।

বর্তমানে মূলত বাজার এলাকা সহ আরো কিছু জায়গায় আংশিক লকডাউন আবার বলবৎ করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায়। তবে এর মধ্যে দিয়ে সমাধান আসবে তেমন দাবি প্রশাসনেরও নেই। এ গতিকে কেবল খানিকটা মন্দীভূত করার চেষ্টা। তবে সেই ক্ষেত্রেও কতটা সাফল্য পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

ভ্যাকসিন যদি না বেরোয় খুব কিছু রাস্তা খোলা নেই বলেই অনেকে মনে করছেন। ভ্যাকসিন কবে বেরোবে সেটা প্রবল অনিশ্চিত একটা ব্যাপার। ১৫ অগস্ট ভ্যাকসিন জনতার ব্যবহারের জন্য আসতে পারে বলে ICMR-এর পক্ষ থেকে ডঃ ভার্গব যা জানিয়েছিলেন, তা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিকর। এটা বড়জোর তৃতীয় দফার যে পরীক্ষা একটু বেশি সংখ্যক জনগণের ওপর করা হয়, তার একটা সময়সীমা হতে পারে।

তবে ভারত বায়োটেক সহ আরো যে সব কোম্পানি এখানে স্বাধীনভাবে বা বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য চেষ্টা করে চলেছে, তাদের ভ্যাকসিন তৈরির অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রমাণিত। শিশুদের ভ্যাকসিনের সিংহভাগ ভারতীয় কোম্পানিগুলিই তৈরি করে থাকে।

ভারতের বাইরেও অসংখ্য উদ্যোগ চলছে ভ্যাকসিন তৈরির। প্রায় দেড় শতাধিক উদ্যোগের কয়েকটি মার্চেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন বেশ কয়েকটি জনগণের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষার স্তরে আছে।

রাশিয়া, ব্রিটেন, চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ায় ভ্যাকসিন বেরোলেও ভারতে করোনা ভাইরাসের নির্দিষ্ট স্টেনগুলির মোকাবিলায় সেগুলি পুরোপুরি সফল নাও হতে পারে। দেশ বা অঞ্চলভিত্তিক গবেষণাকে তাই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। দ্রুত ভ্যাকসিন বেরোলে অবশ্যই সেটা আশার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মকে অতিক্রম করে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক চমক দেবার চেষ্টা করলে তা হবে হঠকারী ও কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য আশঙ্কাজনক। সমস্ত নিয়ম ও সুরক্ষাবিধিকে যথাযথভাবে মেনেই এক্ষেত্রে এগনো দরকার।

কীভাবে ছড়ায় করোনা ভাইরাস এবং তা থেকে বাঁচার সঠিক গাইডলাইন কি তা বেশ অস্পষ্ট। মাঝে মাঝেই নতুন তথ্য ও গবেষণার আলোয় তাকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে হচ্ছে। ভাইরাসের চরিত্র ঠিকমতো বুঝে উঠতে না পারার কারণেই এই বিভ্রান্তি। কোন ওষুধ কার্যকরী আর কোনটি নয়, তাই নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। যেমন হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইনকে একসময় উপশমের দাওয়াই ভাবা হয়েছিল। ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে তা মার্কিন দেশে পাড়ি দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক চাপান উতোরও হয়েছিল। কিন্তু তারপর দেখা গেল সংক্রমিতকে সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে এর তেমন কোনও প্রভাব নেই। চিকিৎসক ও মেডিকেল স্টাফদের সংক্রমণ প্রতিরোধী ওষুধ হিসেবে এর কার্যকারিতা আছে কিনা তাও অস্পষ্ট।

test

 

এই যাবতীয় বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা থেকেই হয়ত একটি স্পষ্ট বার্তা উঠে আসছে -- ভ্যাকসিন আবিষ্কার ছাড়া অন্য কোনওভাবে সংক্রমণের বাড়বাড়ন্তকে আমাদের দেশে এবং রাজ্যে রোধ করা সম্ভব নয়। যতদূর সম্ভব সতর্কতা মেনে অবশ্যই চলতে হবে কিন্তু ভ্যাকসিন হাতে আসার আগের পর্বে কোভিড অতিরিক্ত অন্যান্য নানা রোগ ব্যাধির মোকাবিলা, জীবন-জীবিকার বিভিন্ন সঙ্কটের দিকগুলির মোকাবিলা যেন যতটা সম্ভব মসৃণ হতে পারে, সেই চেষ্টা করা দরকার।

কিন্তু এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট ব্যর্থতাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিকে দেখা যাচ্ছে কোভিড চিকিৎসা বা কোয়ারান্টাইন সেন্টারের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো এখনো সরকারগুলি তৈরি করে উঠতে পারেনি। অনেক আক্রান্তকেই সুস্থ হয়ে ওঠার আগে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে এবং তারা ও তাদের পরিবার নানা সামাজিক সমস্যার মুখোমুখী হচ্ছেন। অনেকে কোভিড আক্রান্ত অসুস্থ ব্যক্তি আবার হাসপাতালে বেড-ই পাচ্ছেন না। হাসপাতালে না রেখে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ফলে রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা এক তরুণীর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর খবর সাম্প্রতিককালে আলোড়ন তুলেছে। মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে ভাবছেন যে উচ্চ পদস্থ সরকারী আমলাই যদি এইভাবে মারা যান, তাহলে সাধারণ মানুষের অসহায়তা কতটা। আমতার এক কলেজ অধ্যাপক থেকে ইছাপুরের এক কিশোর ছাত্র সহ অনেকেই এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরে কোথাও ঠাঁই না পেয়ে মারা গেছেন গত কদিনে। এরকম বেদনাদায়ক খবর একের পর এক আসছে।

একদিকে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার যখন এই হাল, তখন অন্যদিকে অন্যান্য রোগ ব্যাধিতে আক্রান্তদেরও সমস্যার শেষ নেই। বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাই যে শুধু ভেঙে পড়েছে তা নয়, এলাকাগুলিতে স্থানীয় চিকিৎসকদের অনেকেই এখন আর রোগী দেখছেন না। অসুস্থ রোগী ও তাদের পরিজনেরা গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা নিয়ে অসহায়ভাবে পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

buss

 

চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্কট ছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে গোটা সমাজ জুড়ে সঙ্কট, অস্থিরতা ও আতঙ্ক ক্রমশ ছড়াচ্ছে। তা সে গণপরিবহনই হোক কী বয়স্কদের একান্ত প্রয়োজনীয় ডোমেস্টিক হেল্প। কোটি কোটি মানুষের আর্থিক দুরবস্থাই হোক, কী শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের মানসিক সঙ্কট।

সবচেয়ে বড় কথা কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে এখনো অবধি ব্যর্থ। কেন্দ্রের সরকার ও শাসক দল করোনা সঙ্কটের প্রথম দিনগুলি থেকেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও সরকার বদলের লক্ষ্যে ঘোড়া কেনাবেচায় ব্যস্ত থেকেছে। অন্যদিকে রাজ্যের শাসক দলের নেতারা বিভিন্ন জায়গায় সরকারী ত্রাণ প্যাকেজকে নিজেদের পকেট ভরানোর উপায় হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন।

প্যানডেমিক প্যানিক দেশ ও রাজ্য জুড়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। একে আটকানোর জন্য জরুরিভিত্তিতে একগুচ্ছ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার বদলে অনেক সময়েই একে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল ব্যবহার করছে তাদের স্বৈরতন্ত্রী শাসনের বিরুদ্ধে ওঠা যে কোনও প্রতিবাদ আন্দোলনকে দমন করার কাজে। এভাবে শাসকেরা নিজেদের সঙ্কটকে পেরিয়ে যাবার কথা ভাবছেন ও জনগণকে আতঙ্কের মধ্যেই রেখে দিচ্ছেন।

কিন্তু প্যানডেমিক প্যানিক বা মহামারী আতঙ্ক যদি নাগরিক ও অর্থনৈতিক জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রগুলিকে বিপর্যস্ত করতে থাকে, ছড়াতে থাকে, তাহলে তা কোভিড সংকটের পাশাপাশি অন্যান্য হাজারো নতুন সমস্যার জন্ম দেবে ও প্যান্ডেমোনিয়ামের পরিস্থিতি তৈরি করবে। এইটাকে আটকানোর চেষ্টা অবশ্যই করা দরকার সরকার ও প্রশাসনের তরফে। প্যান্ডেমিক প্যানিক যেন প্যান্ডেমোনিয়াম তৈরি না করে, সে জন্য জরুরি ভিত্তিতে অনেক ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে।

- সৌভিক ঘোষাল 

খণ্ড-27