(দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক পাতায় প্রকাশিত এই লেখাটি দেশব্রতীর পাঠকদের জন্য তুলে আনা হল)
ধারাবাহিকভাবে তাঁর কাছের মানুষদের ইন্টারভিউ প্রকাশিত হচ্ছে আমার প্রোফাইলে। আজ বলছেন নীতীশ রায়।
গণমানুষের ভিড়ে আজীবন গান গেয়েছেন নীতিশবাবু। গণমানুষের গান গেয়েছেন। মানুষের রাজনীতির গান, সংস্কৃতির গান। ঘাম-রক্ত-কোষের ভেতর মিশে গেছেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সদস্য নীতীশবাবুর সাথে নবারুণের ঘনিষ্ঠতা হয়, নবারুণের জীবনের শেষ পর্যায়ে। নবারুণও এই পর্যায়ে মানুষের ভেতর মিশতে চাইছেন আরও। ভালোবাসতে চাইছেন প্রবল। কোনও এক অজানা টানে যেন তিনি তাই বুদ্ধের কথা ভাবছেন। আর সদস্য না হলেও সভাপতিত্ব গ্রহণ করছেন লিবারেশানের সংস্কৃতি সেলের। শরীর খারাপ নিয়েও ছুটে যাচ্ছেন নানা কনফারেন্সে। সে-সব কথাই আজ বললেন নীতীশবাবু। তাঁর গানের মতোই সহজ ভাষায়, ......
জীবনের একেবারে শেষদিকে আমাদের পার্টি সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলের ঘনিষ্ঠ হন নবারুণদা। আজীবন বাম রাজনীতির প্রতি আসক্ত ছিলেন। কিন্তু কোনওদিন সদস্য হননি। শিল্পী হিসেবে বরাবর পাশে থেকেছেন আমাদেরও। এই পর্যায়ে আমরাও চেয়েছিলাম, একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ হিসেবে কখনওই যেন দলীয় নিয়মে আটকে না পড়েন তিনি। যেন স্বাধীনভাবেই আমাদের পরামর্শ দেন।
এরপর মহাজাতি সদনে পার্টি কংগ্রেসে বক্তব্য রাখেন নবারুণদা। এরপর মেট্রো চ্যানেলে আয়োজিত সাংস্কৃতিক সমাবেশেও আসেন। ভাষণ দেওয়ার পাশাপাশি নানা বুদ্ধিজীবীদেরও আসতে বলেন সেখানে। এ সময়টা থেকেই ক্রমশ সিঙ্গুরের পটভূমি বিস্তার পেতে থাকছিল। আমরা সিঙ্গুরে যাচ্ছিলামও বারবার।
২০০৭-এ পঞ্চায়েত নির্বাচনে হুগলির পোলবা-দাদপুরে গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করে লিবারেশন৷ সেবারের বিজয় অনুষ্ঠানেও নবারুণদা এসে কবিতা পড়লেন সাধারণের ভিড়ে। সবাই উচ্ছসিত। নবারুণদাও খুব খুশি হলেন।
এরপর, বেনারসে জনসংস্কৃতি মঞ্চের অনুষ্ঠানে হাজির হলেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে নানা ভাষার কবি-সাহিত্যিক-মানুষদের ভিড়ের মাঝে পড়লেন তাঁর বিখ্যাত “মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না”। প্রথমে হিন্দিতে পড়া শুরু করে মাঝপথে বাংলাতেই পড়তে থাকলেন। ফেটে পড়ল উচ্ছাসে সামনের অগণিত মানুষ৷ তাঁরা নিজের নিজের ভাষায় উচ্চারণ করলেন এই ইতিহাস হয়ে যাওয়া পংক্তিগুলি। আমরা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ!
বরাবর বলতেন, ভাষার জোরের কথা। যে ভাষা উনি খুঁজছিলেন। এই পুতুপুতু এলিট শ্রেণির ভাষা পেরিয়ে শ্রমিকের ভাষার কাছে পৌঁছনোর তাগিদ ছিল নবারুণদার বরাবর। তাই যে কোনও জায়গাতেই তাঁর ভাষণ বা কবিতাপাঠ সবার মনের মণিকোঠায় কড়া নাড়ত। লিবারেশনের অমলেন্দুভূষণ চৌধুরী, মানস ঘোষেদের সাথে ওঁর ঘনিষ্ঠতা ছিলই। পরে ক্রমশ আমাদেরও কাছের হয়ে উঠলেন। হয়ে উঠলেন সবার নবারুণদা!
২০০৭ সালেই বজবজ কনফারেন্সে যোগ দিলেন। খুব সুন্দর সময় কাটল একসাথে। বন্ধুতা বাড়তে থাকল। এরপর ভিলাই কনফারেন্সে যাওয়ার পথে কয়েকটা মজার ঘটনা ঘটে। তখন জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের ঘটনায় কড়াকড়ি চলছিল ট্রেনে। চক্রধরপুরের কাছে আমাদের ট্রেন দাঁড়িয়ে যায়। নবারুণদা আর বৌদি বাড়ি থেকে মাংস এনেছিলেন। রুটি ছিল না। আমাদের আরেক বন্ধু অরিন্দমকে নিয়ে রুটি কিনতে বেরলেন তিনি অগত্যা। বৌদির কথা শুনলেন না। বৌদি বলে দিলেন, “তোমরা ওকে দেখো একটু, ও কিন্তু হঠাৎ কোথাও আড্ডা জমিয়ে দেবে!”
আর, সেটাই হল। হঠাৎ স্টেশনের পাশের একটা হোটেলে গিয়ে নবারুণদা রুটি বেলতে আরম্ভ করলেন। অরিন্দমকে পরে রুটি বেলার দায়িত্ব দিয়ে, নিজে রুটি ভাজতে লাগলেন। সামান্য মদ্যপানও হল। সে এক কাণ্ড। নবারুণদা মেতে গেলেন আড্ডায়। ভিলাইতে গিয়ে এক চিত্রশিল্পীর ছবি দেখে তিনি চিত্তপ্রসাদের কথা গভীরে বলেছিলেন মনে আছে। এ ছাড়া বাবা বিজন ভট্টাচার্য বা ঋত্বিক ঘটকের নাম তো প্রতি নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করতেন। নানা লেখায় তাঁদের কথা বারবার বলেছেন। বইমেলাতে ভাষাবন্ধনে গেলেই, তাঁদের কথা বলতেন।
নন্দীগ্রামের ঘটনার পর ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে ভাষণ দিলেন। সংহতি জানালেন অশোকনগর ও যাদবপুরের কনভেনশানেও। কিষেণজি মারা যাওয়ার খবরে লিখলেন “চড়ুই” নামের অনবদ্য কবিতা। সেদিন ঘটনাচক্রে আমরা তাঁর বাড়িতে গেছিলাম। আমাদের একটি পত্রিকার জন্য পরবর্তীতে একটি কবিতা দিলেন কমিউনিস্ট পার্টি ও তাঁর সম্পর্ক নিয়ে। (এ লেখার সাথে কবিতাটি নীচের ছবিতে দেওয়া হল)
আমাদের দলের সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সাথেও ঘনিষ্ঠতা ছিল নবারুণদার। পরে যখন দিল্লি বা কেরালা গেলেন চিকিৎসার জন্য, আমাদের সদস্যরা ছুটে এসেছেন তাঁর কাছে।
কিন্তু লিবারেশনের তরফে কখনও সদস্য হতে পীড়াপীড়ি করা হয়নি। অতীতে বাবা নাগার্জুন যেমন সদস্য না হয়েও, জনসংস্কৃতি মঞ্চের সভাপতি ছিলেন, আমরা সেভাবেই তাঁকে পাটনা কনফারেন্সে জানাই, আপনি সদস্য না হলেও সমস্যা নেই। আমরা চাই আপনি স্বাধীন মনেই আমাদের পাশে থাকুন। পরামর্শ দিন। তিনি কিন্তু বারবার সে কথা রেখেছেন।
জীবনের প্রতি অমোঘ টান ছিল নবারুণদার। বারবার বলতেন, “অনেক কাজ বাকি আছে রে। শেষ করে যেতে হবে।” লেখার পাশাপাশি বারবারই রাস্তায় নেমেছেন। সাউথ সিটিতে ওঁকে একবার অপমান করায় রীতিমতো প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এ ছাড়াও, সোভিয়েত দেশ কার্যালয়ের সামনে তাঁর শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদের ও স্লোগানিংয়ের কথা তো সবাই জানেন আজ।
শিলিগুড়ি কনফারেন্সে সারারাত আড্ডার স্মৃতি আজও মনে পড়ে। কত গান গাইলেন নবারুণদা। বৌদিও গাইলেন। মুকেশ বড় প্রিয় ছিল নবারুণদার। বৌদি সব সময় শিশুর মতো আগলে রাখতেন ওঁকে। বাবাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন নবারুণদা। আগেই বললাম। বলতেন, “আমি বাবার ছেলে”। শুধু লিখে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই সম্ভব না। সেই তাগিদ থেকেই শরীর খারাপ নিয়েও ছুটে গেছেন দূরের কনফারেন্সগুলোয়। লোকাল ট্রেনে সাধারণ যাত্রীর ভিড়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। কখনও একটুও বিরক্ত হননি।
শেষ দিকের শরীর খারাপেও বারবার বলতেন, “দ্রুত সেরে উঠেই আদিবাসীদের মধ্যে চলে যাব বুঝলি। তারপর তোর বৌদিকে ওঁদের সাথে নাচতে পাঠিয়ে, লুকিয়ে আমরা মহুয়া খাব।” (হাসি) নবারুণদা লিখেছিলেন, কমিউনিস্টরা ফিরবেই। এবং দশ না দশ হাজার দিন ধরে দুনিয়া কাঁপাবে। চলে যাওয়ার কিছুদিন আগেও এ বিশ্বাস প্রতি নিঃশ্বাসে ছিল ওঁর রক্তে-মজ্জায় চোখে-নাকে। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপালে বারবার সেন্সলেস হয়ে পড়ছেন, তার মধ্যেও একটু সজাগ হলেই আমাদের রাশিয়ার কথা বলছে ... এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে!
লাল পতাকা যুদ্ধে না গেলেও লাল হতে পারে। এই বিশ্বাসের প্রতি সম্মানে আমরা তাঁর চলে যাওয়ার পর দেহে জড়িয়ে দিলাম সেই পতাকা। নানা দলের তাতে সে সময় অসুবিধে সত্ত্বেও ওঁর ঘনিষ্ঠরা আমাদেরকেই সমর্থন করেছিলেন। আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম, “লাল সেলাম”। তাঁকে নানা জন বলেছিলেন, বেলভিউতে চিকিৎসা করানোর কথা। বলেছিলেন, “না। মরলে সাধারণের মতোই মরব।” এবং তাই ঘটল।
আমার একটি গান নবারুণদার বড় প্রিয় ছিল। প্রায়ই গাইতে বলতেন। ফেরিওলার গান। ওঁর যাদবপুরের স্মরণসভায় সে গান গেয়েছিলামও। মানুষকে এড়িয়ে কোনও উন্নয়ন হতে পারে না। নবারুণদার এ বিশ্বাসের কথাই আছে আমার এ গানেও। আজ তাঁর স্মৃতিতে সে গান সবার জন্য তুলে দিলাম –
“গামছা চাই গামছা নিন
হকারদের বাঁচতে দিন
ধ্বংসের মুখে তাঁতশিল্প
তাঁতিদের মুখে অন্ন দিন।
গামছা চাই, গামছা
গামছা চাই, গামছা
বিশ্বায়নের ফলে
কলে-মিলে তালা ঝোলে
হাজার শ্রমিক বেকার হচ্ছে
বেকার শ্রমিক হকার হচ্ছে
হকারেরা সব ছড়িয়ে পড়ছে
ফুটপাতে আর রেলে
গামছা চাই, গামছা
হকারের পোড়ো ঘরে
বৌটা সেলাই করে
ছেঁড়াখোড়া এই সংসারটা
জুড়তে চেষ্টা করে।
হকারের ছোট ছেলে
শিশুর হাসপাতালে
চিকিৎসাবিনা হারিয়ে গেছে
টাটা-বাইবাই বলে।
এঁদের জন্য হয় আইন
অপারেশান সানশাইন
মন্ত্রী-পুলিশ-বুলডোজার
মিলেমিশে সব একাক্কার
কলকাতা আজ লণ্ডন হবে
পেপসির বোতলে।
(ভাষ্য)
এসব দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমাদের কি আছে? আছে শুধু ভাঙা গলায় গান আর আছে গামছা।
(গান)
সে গামছা কোমরে কোষে
মাঝে মাঝে উঠি ফুঁসে
রাষ্ট্র যখন সন্ত্রাস করে
গরিবের ভাত-রুটি নেয় কেড়ে
রাষ্ট্রদোহী হয়ে উঠি আমি
দারুণ ক্ষোভে ও রোষে
গামছা চাই গামছা
গামছা চাই গামছা।।
(কথোপকথনের ভিত্তিতে অনুলিখন)
লেখা -- দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়