চীন-ভারত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় চাই যথার্থ শান্তি ও সুস্থিতি
cede

চীন ও ভারতের মনোনীত বিশেষ প্রতিনিধিদের মধ্যে ৫ জুলাইয়ের আলোচনার পর লাদাখে চীন-ভারত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় সেনা সমাবেশ কমানো এবং উত্তেজনা প্রশমনের প্রাথমিক কিছু বহুবাঞ্ছিত সূচনা দেখা গেছে। ভারতের পক্ষে মনোনীত বিশেষ প্রতিনিধি হলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল আর চীন মনোনীত বিশেষ প্রতিনিধি হলেন বিদেশ মন্ত্রী ওয়াং-ই। ওই আলোচনার পর উভয় পক্ষের দেওয়া বিবৃতিতে সীমান্ত এলাকাগুলোতে শান্তি ও সুস্থিতি স্থাপন এবং উন্নত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে; উভয় তরফে ধাপে-ধাপে সেনা সরিয়ে পিছু হঠা নিয়ে আলোচনা চালানোর কথাও বলা হয়েছে। আলোচনার সূত্রে মীমাংসায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা উভয় পক্ষই উল্লেখ করেছে।

পারস্পরিকভাবে পিছুহঠার প্রস্তাব প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখাকে ধরে একটা বাফার জোন সৃষ্টিরই ইঙ্গিত করেছে। এই ব্যবস্থা উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনবে বলেই মনে হয়; তবে গালোয়ান উপত্যকা, প্যাংগং সো এবং ডেপসাং সমভূমি অঞ্চলে কিছু এলাকার ওপর ভারত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, এমন একটা ধারণা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টতই, ভারতীয় এলাকায় কোন অনুপ্রবেশের বা এলাকা জবরদখলের কথা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে মোদী ২১ জুনের “সর্বদলীয় বৈঠকে” যে বিবৃতি দেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত সেনা অপসারণকে বিচার করলে এই অপসারণ কখনই ভারতকে মুখোমুখি সংঘর্ষের আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। সেনা অপসারণে পারস্পরিকভাবে সম্মত হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় যথাযথ পরিস্থিতি সম্পর্কে মোদী সরকারের বিভ্রান্তিকর নীরবতা আরও অনুসন্ধিৎসাই জাগাতে পারে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হওয়ায় তাকে স্বাগত জানানোর সাথে-সাথে আমরা তাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় এখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা শ্বেতপত্র প্রকাশের আমাদের দাবির প্রতি  অবিচল থাকছি।

সেনা সমাবেশকে কমিয়ে আনা এবং উত্তেজনা প্রশমনই যদি প্রকৃত উদ্দেশ্য হয়, মতানৈক্যকে যদি বিবাদে পর্যবসিত হতে না দেওয়া হয়, তবে সেটা কেবলমাত্র চীনের কাছ থেকেই প্রত্যাশা করাটা ঠিক হবে না। এই লক্ষ্যে ভারতকেও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। আমরা এমন একটা সীমান্ত বিবাদের মধ্যে রয়েছি যেটা তীব্র হয়ে উঠে আরও একটা যুদ্ধে পরিণতি লাভ করতে পারে, আর তা ঘটলে ভারত বা চীন কারুরই ভালো হবে না। ভারত এবং চীন উভয়ে বর্তমানে সঠিকভাবেই সেই পথকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে সীমান্ত বিবাদকে আরও জটিল করে তোলার কোনো প্রয়োজন কি রয়েছে? সীমান্ত বিবাদকে শুধুই সীমান্ত বিবাদ বলে গণ্য করে চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের সামগ্ৰিক ব্যাপ্তিকে বিপর্যস্ত করে তোলাটাকে কি আমরা আটকাতে পারি না?

চীনা কোম্পানিগুলোর তৈরি ৫৯টা অ্যপকে নিষিদ্ধ করার যে অপরিণামদর্শী প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে, ঠিক সেই ধরনের প্রত্যুত্তরই পরিণত ভারতকে এড়িয়ে যেতে হবে। রবিশঙ্কর প্রসাদ যখন “ভারতের নিরাপত্তা, সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা, সার্বভৌমত্ব ও সংহতি এবং … ভারতের জনগণের তথ্য ও ব্যক্তিগত পরিসর” রক্ষার পদক্ষেপ হিসাবে এই নিষেধাজ্ঞার কথা ঘোষণা করেন (স্বভাবগতভাবে চীনের নাম না করেই), তখন তিনি নিজেকে হাসির এক খোরাক করে তোলেন। এই সেদিন ১৭ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী জি কিসান রেড্ডি সংসদে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন – টিকটক-এর কাছ থেকে বিপদের কোনো সম্ভাবনা নেই আর তাই তাকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবও নেই। এরপরও রবিশঙ্কর প্রসাদ ওই দাবি করলেন। আর তথ্য চুরি এবং ব্যক্তিগত পরিসরে হানাদারির কথা যদি বলতেই হয় তবে আমেরিকা ও ভারতের বেশকিছু কোম্পানি ও অ্যপও এ ব্যাপারে কম অপরাধী নয়।

চীনা পণ্য বয়কটের জন্য বিকারগ্ৰস্ত জিগির এ ব্যাপারে আর একটা নজির। চীন হল ভারতীয় বাণিজ্যের বৃহত্তম অংশিদার এবং চীন থেকে আমদানি করা পণ্য ভারতীয় উৎপাদনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষভাবে ওষুধ তৈরি শিল্পে যাতে ভারত বিশ্বক্ষেত্রে এক বড় রপ্তানিকারক। চীনের বা বলতে গেলে অন্য যে কোনো দেশের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতাকে কমানো এবং আমাদের আত্ম-নির্ভরতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা ব্যাপার। কিন্তু বয়কটের ডাককে কাজে লাগিয়ে ভারতের নিজের উপভোক্তা এবং ব্যবসাদারদের নিশানা বানানো এবং ভারতে চালু প্রকল্পগুলো ও বিনিয়োগকে বিপর্যস্ত করে তোলা, এবং শ্রমিক বা ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারী হিসাবে লক্ষ-লক্ষ ভারতবাসীর অর্থনৈতিক স্বার্থের ক্ষতি করাটা কখনই ভারতের স্বার্থের অনুকূল নয়।

dad

 

লেহ থেকে দেয়া তাঁর সাম্প্রতিক ভাষণে মোদী সম্প্রসারণবাদকে ধিক্কার জানান এবং উন্নয়নবাদকে তুলে ধরেন। ঘটনা হল, মূলত অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের এজেণ্ডাকে কাজে লাগিয়েই চীন তার প্রভাব ও স্বার্থের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে এবং চীন জড়িত আছে এমন প্রতিটি মঞ্চ বা উদ্যোগ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেই চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভারত এঁটে উঠবে না। ভারতই হল সন্নিহিত অঞ্চলের একমাত্র দেশ যা বিতর্কিত এবং বহু দেশ ও একাধিক মহাদেশকে যুক্ত করা বিপুলাকায় বেল্ট ও রোড প্রকল্পে যোগ দেয়নি। এছাড়া, আশিয়ানভুক্ত দেশগুলির যুক্ত থাকা আঞ্চলিক সামগ্ৰিক অর্থনৈতিক অংশিদারিত্ব (আরসিইপি) থেকেও ভারত এখন বেরিয়ে এসেছে (এই জোটটাতে যুক্ত রয়েছে ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপাইনস, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম) এবং আশিয়ানের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্যের পাঁচ অংশিদারের সঙ্গেও ভারত নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছে (এই দেশগুলো হল অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া)। পরিহাসের ব্যাপার হল, ভারত প্রথম থেকে আরসিইপি পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে, ২০১৩ থেকে তার ২৮টা বৈঠকে অংশ নিয়েছে এবং মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর দুটি পর্ব এই দেশে অনুষ্ঠিতও করেছে (ষষ্ঠ পর্ব, যা দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ১-৫ ডিসেম্বর, এবং ১৯তম পর্ব যা হায়দারাবাদে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের ২৪-২৮ জুলাই), এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আশিয়ানভুক্ত অনেক দেশই এই অঞ্চলকে ইদানিং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বলে উল্লেখ করছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের সঙ্গে রণনৈতিক সমন্বয়কে ক্রমেই বাড়িয়ে চলাটা আমাদের নিজেদেরই সন্নিহিত অঞ্চলে এবং বৃহত্তর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমাদের বিচ্ছিন্নতার বিকল্প হতে পারে না। আমাদের বুঝতে হবে যে, ইউরোপ থেকে তার সেনা সরিয়ে ভারতের সন্নিহিত অঞ্চলে ওই সেনাদের সমাবেশিত করার মার্কিনের পরিকল্পনা আসলে ঘোলা জলে মাছ ধরার তার প্রয়াসেরই অঙ্গ (এবং এই উদ্দেশে জলটাকে ঘোলা করেই রাখা)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্র হিসাবে ভারতকে ঠিক কতটা মূল্য দেয় তা বারবারই উন্মোচিত হয়েছে, অতি সম্প্রতি যা স্পষ্ট হয়েছে অনলাইন শিক্ষায় ভিসা বাতিলের ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষণায়, যে সিদ্ধান্ত ভারতীয় ছাত্রদের বড় আকারে ক্ষতিগ্ৰস্ত করবে।

আত্মনির্ভরতা কখনই এমন একটা বাছাই করা শ্লোগান হতে পারে না যাকে শুধু চীনের পরিপ্রেক্ষিতেই এবং বিশেষভাবে মার্কিনের কাছে ভারতের ক্রমবর্ধমান এবং গ্লানিকর অধীনস্থতাকে আড়াল করতে এবং এমনকি তাকে যুক্তিযুক্ত করতেই ব্যবহার করা হবে। বাণিজ্য এবং অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক বন্ধন থেকে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদকে আলাদা করা এবং বিদেশ নীতির দীর্ঘ-মেয়াদী গুরুত্বকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বল্প-মেয়াদী হিসেবনিকেশ থেকে বার করে আনাটাই সময়ের দাবি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বিদেশ নীতির এমন একটা মিশেল যা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে ভারতকে যুদ্ধের মত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়, তা ভারতীয় জনগণ এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য বিপর্যয় ডেকেই আনতে পারে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৭ জুলাই ২০২০) 

খণ্ড-27