আজ শুধুই লুণ্ঠনের ‘স্বর্গ’!!
loot

ঝোড়ো হাওয়ায় বেশ কিছু পাতা উল্টে গেছে। কিন্তু অধ্যায়টা এখনও শেষ হয়নি। প্রকৃতির লীলানিকেতন সেই রম্যভূমি এখন কাঁটাতার ঘেরা — মানবতার বধ্যভূমি।

৩৭০ ধারা বিলোপ তথা রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা খোওয়ানোর পর প্রায় বছর ঘুরে এল। ‘ভূস্বর্গ’ কেমন আছে? কেমন আছেন উপত্যকার মানুষজন? উত্তরটা জানা। সামরিক বাহিনীর ভারী বুটের তলায় নেট-বিচ্ছিন্ন উপত্যকায় এখনও সংঘাত সংঘর্ষ রক্তস্নান অব্যাহত। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, লকডাউনপর্বে অন্তত ৭৩ জন কাশ্মীরী জঙ্গি নিহত হয়েছে, শুধু এপ্রিলেই ২৮ জন। নিরীহ নাগরিকও মারা গেছেন।

কিন্তু অতিমারী কোভিড১৯-এর লকডাউনের আড়ালে যেটা চলছে, তা বোধ হয় আমাদের জানা ছিল না। সেখানটাতেই একটু আলোকপাত করা যাক। গত ৯ মে সাউথ এশিয়া সলিডারিটি গ্রুপের উদ্যোগে এক অন-লাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় — ‘সাইলেন্সিং দ্য ট্রুথ টেলার্স: কাশ্মীর আন্ডার অকুপেশন ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে। সেই বৈঠকে বক্তাদের কণ্ঠে একে একে উঠে এসেছে কীভাবে কোভিড১৯-এর আড়ালে, ৩৭০ ধারা বিলোপ ও নতুন স্থায়ী বাসস্থান সংক্রান্ত আইন (ডোমিসাইল ল)-কে কাজে লাগিয়ে চলছে কর্পোরেট পুঁজির দ্বারা অবাধ লুণ্ঠন, তার জ্বলন্ত, মর্মস্পর্শী ছবি।

এই ওয়েবিনারে অংশ নেন লেখক ও আইনজীবী মির্জা সালিব বেগ, কাশ্মীর উইমেন্স কালেকটিভ-এর প্রতিনিধি আর্শি কুরেশি এবং কাশ্মীর সলিডারিটি মুভমেন্ট থেকে মেহরুশ তাক।

kas

 

এমনিতেই ব্যাপক মাত্রায় সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা কাশ্মীরে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে, মানুষের বিপন্নতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। আর এই পরিস্থিতিতে লকডাউনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মোদী সরকার কাশ্মীরী জনসাধারণের উপর দমনপীড়ন তথা নজরদারির মাত্রা তীব্রতর করে উপত্যকায় ঘটে চলা সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার ভয়ঙ্কর অভিযানে নেমেছে। এই ভয়ানক আবহে ৩৭০-ধারা-বিলোপ-পরবর্তী পরিস্থিতি এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। কাশ্মীরে ইজরায়েলি ধাঁচে এক ‘সেটলার’ উপনিবেশবাদ কায়েম হতে চলেছে আর তার ক্রমবিকাশে সহায়ক হয়ে উঠেছে নতুন ‘স্থায়ী বাসস্থান সংক্রান্ত আইন’। এই সব লুঠের যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের জন্য প্রযুক্ত হচ্ছে দানবীয় আইন। কাশ্মীরের বিখ্যাত চিত্রসাংবাদিক মাশরত জাহরাকে গত ২০ এপ্রিল ইউএপিএ-১৯৬৭-তে অভিযুক্ত করা হয়েছে ১৯ মাস আগের একটি ফোটোগ্রাফের বাহানায়। ঐ দিনই ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার কাশ্মীর করেসপন্ডেন্ট পীরজাদা আশিকের বিরুদ্ধে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ এফআইআর করে ‘ফেক নিউজ’-এর অভিযোগে — আর যথারীতি সংবাদপত্রকে কোন কারণ না দর্শিয়েই এটা করা হয়। ২১ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক জওহর গিলানিকে ‘সন্ত্রাসবাদকে গৌরবান্বিত করা’ এবং ‘ভাবতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি ক্ষতিকর কাজকর্মকে প্রশ্রয় দেওয়ার’ অভিযোগে গ্রেফতার করে। তিনি আগের দিন মাশরত ও পীরজাদার সমর্থনে লিখেছিলেন, এটাই তাঁর ‘অপরাধ’! এইভাবে সাংবাদিক নিগ্রহ চলছেই। সম্প্রতি ‘কাশ্মীরওয়ালা’-র সম্পাদককে পুলিশি হেনস্থার মুখে পড়তে হয় — পুলিশের ‘সুনাম’ ‘কালিমা লিপ্ত’ করার অভিযোগে। আসলে কী ‘অপরাধ’ করেছিলেন তিনি? নাওয়াকাদালে গুলিযুদ্ধের পর পুলিশ এই অতিমারীর সময় অন্তত পনেরোটি বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় আর সরকারী কর্মচারিরা সেখানে ব্যাপক লুঠপাট চালায় — স্থানীয় অধিবাসীদের এই অভিযোগ তিনি তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন।

অনলাইন বৈঠকে মির্জা সালিব বেগ ডোমিসাইল আইনপ্রণয়ণ সংক্রান্ত পরিবর্তনের মারাত্মক বিষয়টি নিয়ে বলেন। কোভিড১৯ লকডাউনের সূচনা থেকেই মোদী সরকার এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই কর্তৃত্বমূলক সুবিধাবাদের নাটকীয় ফলাফল কাশ্মীরের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নির্লজ্জভাবে প্রকটমান। নতুন স্থায়ী বাসস্থান সংক্রান্ত আইন পাস করানোর জন্য লকডাউনের সময়টা বেছে নেওয়া মোদী সরকারের রণকৌশলগত (স্ট্র্যাটেজিক) সিদ্ধান্ত। কারণ সেই মাত্রায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ এখন অসম্ভব। এই আইন শুধু জনবিন্যাসগত পরিবর্তনকেই অনুমোদন করছে না, কাশ্মীরকে লুঠ করার অবাধ সুযোগও করে দিয়েছে। এই প্রথম কাশ্মীরে ভারতীয় নাগরিকদের ও কোম্পানিগুলিকে জমি ও খনিজ উত্তোলনের অধিকার দেওয়া হল। খনিজ উত্তোলনের নিলাম ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। ১০০% লিজ-ই চলে গেছে অ-কাশ্মীরীদের হাতে। সত্যি বলতে কি, খুব ভেবে চিন্তেই অকশন করা হয়েছে অনলাইনে। কারণ কাশ্মীরে এখনও ‘ইন্টারনেট শাটডাউন’ চলছে। তাই নেট-বঞ্চিত কাশ্মীরীরা এই নিলামে অংশও নিতে পারেননি। মির্জা সালিব বেগ মনে করেন, বিবেকবান ভারতীয়দের এই প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত।

ddar

 

কাশ্মীর উইমেন্স কালেকটিভ-এর সদস্য আর্শি কুরেশি একজন গবেষক ও মহিলা মানবাধিকার কর্মী। তিনি গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মহিলাদের নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর সংগঠন মহিলা অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করছে। নেট-বিচ্ছিন্ন থাকায় তিনি সরাসরি বৈঠকে অংশ নিতে পারেননি। আগে রেকর্ড করা ভিডিও পাঠিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন কাশ্মীরে মানবাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নারীর অধিকারকে বোঝা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, কাশ্মীরে কোভিড১৯ নিয়ে বিদ্রোহ দমনের মনোভাব মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। মোবাইল পরিষেবা বন্ধ রাখা আসলে গোটা কাশ্মীরী সমাজকে শাস্তি দেওয়া। অতিমারির পরিস্থিতিতে মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা পাচ্ছে না। গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মহিলারা কোন সাহায্য পাচ্ছেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাত্র ১৯৬-টি বা তার কম বাড়িতে ল্যান্ড ফোন আছে।

ডঃ মেহরুশ তাক, কৃষি ও খাদ্য বিষয়ক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ, কাশ্মীর সলিডারিটি মুভমেন্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জানালেন, ঐ মুহূর্তে শ্রীনগরে কোভিড১৯-এ আক্রান্ত রেড জোনের সংখ্যা ১৫টিরও বেশি। এই বিষয়ে, সেনাবাহিনী প্রতিবাদ দমনের উদ্দেশ্যে অঞ্চলগুলিকে কর্ডন করার জন্য নিজেদের খেয়াল খুশিমত ঘোষণা করে। বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী নয়। তিনি আরও বলেন, কাশ্মীরী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সাম্প্রতিক অধিগ্রহণ কীভাবে কাশ্মীরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কৃষক সম্প্রদায়কে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং তাদের ভারতীয় কর্পোরেটদের কাছে ‘অভাবী বিক্রি’ করতে বাধ্য করছে। কাশ্মীরে অনেকেই অরণ্যভূমির উপর নির্ভরশীল, সেই অধিকারও ৩৭০ ধারা বিলোপের মাধ্যমে তলে তলে গ্রাস করা হচ্ছে। খাদ্যের অধিকার ও খাদ্য সুরক্ষা বিপন্ন। কোভিড১৯ পরিস্থিতিতে অনাহারের আশঙ্কা অনেকটাই বেড়ে গেছে। কাশ্মীরে আন্তর্জাতিক মানবিক ত্রাণ বন্ধ, যবে থেকে এটি একটি দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ড: তাক আরও বলেন, গ্রেট ব্রিটেন এবং ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ আর্থিক সম্পর্ক, ব্রিটেনে হিন্দুত্ববাদীদের লবিবাজি এবং জাতি বৈষম্য আইন, কাশ্মীর সম্পর্কে সঠিক অবস্থান নেওয়ার পথে ব্রিটেনের অন্তরায়।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে ‘ফ্রন্ট লাইন’-কে লেখক মির্জা ওয়াহিদ সক্ষোভে বলেছেন, “ভারত কাশ্মীরে ক্রমবর্ধমানভাবে যে আচরণ করে চলেছে তা ইজরায়েল-অধিকৃত প্যালেস্টাইনের সঙ্গেই তুলনীয়। দিল্লি কাশ্মীরকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু ইতিহাস আমাদের বলে, কাশ্মীরী জনজীবনকে ভেঙেচুরে অন্য কাঠামো দেওয়ার নিষ্ঠুর চেষ্টা যতই চলুক কাশ্মীরী জনগণ আত্ম-নির্ধারণের সংগ্রামে অবিচল থাকবেন”।

-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত 

খণ্ড-27