করোনা উদ্বেগের মধ্যেই মে মাসে আমফান ঝড় বাঙলার শহর-গ্রাম তছনছ করে দিয়ে গেল। বিদ্যুতের পোস্ট ও খুঁটি সব উপড়ে গেছে, যেন কোন দৈত্য এসে সব কিছু দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিয়ে গেছে। শহরে বিদ্যুৎ পরিষেবা স্তব্ধ। বিদ্যুৎ সরবারহ স্বাভাবিক হতে ১০ দিন সময় লেগে গেল। গ্রামের অবস্থা আরও সঙ্গীণ, বিশেষ করে দুই ২৪ পরগনার উপকূলবর্তী অঞ্চলে। এখানেও এক মাসের বেশি সময় লেগেছে বিদ্যুৎ সরবারহ স্বাভাবিক হতে। রাজ্যের মানুষকে করনো, লকডাউন, আমফান ঝড় বিপর্যস্ত করেছে, আবার আমাদের সবাইকে এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ও করিয়ে দিয়েছে।
রাস্তায় আলো ঝলমল করছে, ল্যাম্প পোস্টে শাপের মতো পেঁচিয়ে টুনি লাইট উঠেছে, কোথাও ত্রিফলা, রাস্তার মাঝে ফোয়ারা কত কী। প্রবাসীরা ছুটিতে বাড়ি এসে বলতো কত ‘উন্নয়ন’ হয়েছে। গর্বে আমাদের পা মাটিতে পড়তো না। গাছ কেটে, পুকুর বুজিয়ে উন্নয়নের রথের চাকা আরও জোরে ছুটতে লাগলো। কিন্তু করোনা, লকডাউনে আমাদের সব তাল কেটে দিল। আলোর নীচে গাঢ় অন্ধকার ছিটকে বেড়িয়ে এলো। লকডাউনে বেশিরভাগ বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন বা মজুরি না দিয়ে কাজ থেকে বসিয়ে দিল। সঙ্কট যতো বেড়েছে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষরা নিরপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। বিপরীতে শ্রমিক কর্মচারিদের খালি হাতে, ভুখা পেটে ঘরে থাকতে বাধ্য করেছে। এক অমানবিক, নিষ্ঠুর রাষ্ট্র এবং বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে আমরা দেখতে পেলাম।
আমফান ঝড়ে বেসরকারী বিদ্যুৎ সংস্থার কঙ্কালসার চেহারা বেড়িয়ে এলো। ঝড়ে কলকাতা সহ শহরতলিতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বেহাল হয়ে পড়ল। দেখা গেল সঙ্কট মুহূর্তে বঙ্গবিভূষণ সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সিইএসসি’র কোনো পরিকাঠামোই কাজ করছে না। উলটো দিকে লাইন থেকে গাছ কাটতে গিয়ে এক জন ফায়ার ব্রিগেডের কর্মী তড়িদাহত হয়ে মারা গেলেন। কলকাতায় ঝড়ে মৃত্যুর বেশিরভাগ হয়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। এই অব্যবস্থার অন্যতম কারণ হল, অন্য বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতো সিইএসসি কর্তৃপক্ষও লকডাউনে সংস্থার ঠিকা শ্রমিক সহ কোম্পানির স্থায়ী কর্মীদের সিংহভাগকে কাজ থেকে বসিয়ে দিয়েছিল। আর অল্প সংখ্যক কর্মীকে দিয়ে এতবড় বিপর্যয় মোকাবিলা করা সম্ভবই নয়। ফল হল দমকল কর্মী সহ কয়েকজন সহনাগরিকের মৃত্যু। জরুরি পরিষেবার ক্ষেত্রে যা অন্যায় বা অপরাধ। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইন দিয়ে সরকার সিইএসসি’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতো, কিন্তু নেয়নি। সিইএসসি কর্মীর অভাবে গ্রাহকদের বাড়িতে তিন মাস মিটার রিডিং নিতে যায়নি। কিন্তু প্রতিমাসে ভুতুড়ে বিল পাঠিয়েছে। একদিকে সিইএসসি ঝড়ের পর বিদ্যুৎ সরবারহ স্বাভাবিক করতে কাজে ঢিলেমি করেছে। অতিমারী ও অপরিকল্পিত লকডাউনে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ও আর্থিক সঙ্কট চরম পর্যায় পৌঁছেছে, কিন্তু সিইএসসি তার মুনাফার পাহাড় বাড়িয়ে চলেছে। সব গ্রাহকদের কাছে অস্বাভাবিক ভুতুড়ে বিল পাঠিয়েছে। অস্বাভাবিক মাশুলের বিরুদ্ধে বৃহত্তর কলকাতায় বিক্ষোভ চলছে।
বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্যুৎ মাশুল দেখে নেওয়া যাক। এই হিসেব প্রতিমাসের। দিল্লী — ২০০ ইউনিট পর্যন্ত কোন মাশুল নেই। ২০১-৪০০ ইউনিট মাসে মাত্র ৫০০.০০ টাকা। অন্যান্য রাজ্যগুলো ৪০০ ইউনিটে কত নিচ্ছে? মহারাষ্ট্র (গড়) ৩১৪০.০০ টাকা, সিইএসসি (কলকাতা) ২৯১৭.১৫ টাকা, কেরল ২৭৬০.০০ টাকা, গুজরাট ১৫৮৮.০০ টাকা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন নিগম ৮১৩.২২ টাকা (ত্রৈমাসিক বিল ৪০০ ইউনিট ২৪৩৯.৬৬ টাকা)।
বেশিরভাগ গ্রাহক গড়ে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। প্রধান প্রধান রাজ্যগুলোতে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত মাশুলের পরিমাণ কত নেয় দেখে নেওয়া যাক। দিল্লী ২০০ ইউনিট পর্যন্ত শূন্য চার্জ। সিইএসসি (কলকাতা) ২০০ ইউনিট ১২৯২.১৫, কেরল ১০৮৭.৫০, মহারাষ্ট্র ১০৬০, গুজরাট ৬৬২.৫০, পশ্চিবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন নিগম ৫৮১ টাকা (ত্রৈমাসিক ১৭৪২.৬৬ টাকা)।
এই তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে সিইএসসি দেশের মধ্যে ৪০০ ইউনিট বিদ্যুতের মাশুলে দ্বিতীয় স্থানে আছে, মহারাষ্ট্র প্রথম। আর ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ, যা বেশিরভাগ গ্রাহক ব্যবহার করেন, সেখানে সিইএসসি’র মাশুল সবচেয়ে বেশি এবং দেশের মধ্যে ‘শীর্ষস্থান’ দখল করেছে। দিল্লি সব থেকে কম, শূন্য মাশুল। এক দেশ, এক ভোট, এক রেশন কার্ড চলছে, তখন বিদ্যুৎ মাশুলের ক্ষেত্রে দিল্লী মডেল সব রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হোক।
সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের নেতৃত্বে সিইএসসি’র ভুতুড়ে বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ডেপুটেশন চলছে। সিইএসসি কর্তৃপক্ষের কাছে দাবিপত্র পেশ করা হয়েছে কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগণায়। ১) লকডাউনের সময়কার ৩ মাসের বিল মুকুব করতে হবে। ২) ভুতুড়ে বিল নেওয়া বন্ধ করুন। ৩) প্রথম স্লাব ২৫ ইউনিট থেকে বাড়িয়ে ১০০ ইউনিট করতে হবে। ৪) ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ী করে পরিষেবা উন্নত করতে হবে। ৫) কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ আইন ২০২০ বাতিল কর।
-- নবেন্দু দাশগুপ্ত