রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বেসরকারী কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থ রক্ষার সরকারের তাগিদ আজ আর কোনো গোপন ব্যাপার নয়। আর তাই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হলেও সরকার বিএসএনএল-এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার আচরণই করেছে। বলা ভালো, লাগাম লাগিয়ে এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার রাশ টেনে রাখতেই সরকার প্রয়াসী হয়েছে। বিএসএনএল-এর কর্মীদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সরকার অবশেষে সংস্থাটির পুনরুজ্জীবনে সায় দেয়, এবং ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর বিএসএনএল-এর সঙ্গে অন্য আর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এমটিএনএল-এর পুনরুজ্জীবনের জন্য ৬৯,০০০ কোটি টাকার এক প্যাকেজ ঘোষণা করে। ওই প্যাকেজের অঙ্গ হিসাবে বিএসএনএল-কে ৪জি স্পেক্ট্রাম দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, বিএসএনএল-এর নিজস্ব জমি বিক্রি করে অর্থ জোগাড়ে অনুমতি দেওয়া হয়, বণ্ড বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তোলার প্রস্তাব সম্মতি পায়, অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ভালো সংখ্যক কর্মীর ভিআরএস বা স্বেচ্ছাবসর গ্রহণের শর্তও থাকে। কিন্তু ওই প্যাকেজ ঘোষণার পর আট মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কর্মীদের স্বেচ্ছাবসর গ্ৰহণ ছাড়া প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত অন্য কোনো বিষয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকারের দিক থেকে কোনো আন্তরিকতা বা তৎপরতা দেখা যায়নি, নেওয়া হয়নি পুনরুজ্জীবনকে সার্থক করতে পারার মতো কোনো পদক্ষেপ। বিএসএনএল থেকে ৭৯,০০০ কর্মী স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার পরও যে ৭০,০০০ কর্মী এখনও রয়েছেন, তাঁরা ঠিক সময়ে বেতন পান না। সংস্থাটিতে কাজ করা ঠিকা কর্মীদের অবস্থাও সঙ্গিন, বেশ কিছু ঠিকা কর্মী আত্মহত্যা করেছেন বলেও জানা গেছে। পরিস্থিতি এরকম হলেও বিএসএনএল-এর পুনরিজ্জীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতেই যেন সরকার ব্যগ্ৰ এবং কিভাবে সেদিকে তাকানো যাক।
বিএসএনএল-কে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে ৪জি পরিষেবা প্রদানের সামর্থ্য অবশ্যই অর্জন করতে হবে। রিলায়েন্স, এয়ারটেল-এর মতো বেসরকারি সংস্থা যেখানে চার বছর আগে থেকে এই পরিষেবা প্রদান করে যাচ্ছে, বিএসএনএল-কে আজ সেখানে ২জি ও ৩জি পরিষেবা প্রদানের মধ্যেই আটকে রাখা হয়েছে। ৪জি পরিষেবা দিতে পারলে বিএসএনএল-এর গ্ৰাহক ভিত্তি অনেক বাড়বে, তার সঙ্গে ভালো পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে তার আয়। পুনরুজ্জীবনের সবুজ সংকেত পেয়ে বিএসএনএল তার ব্রডব্যন্ড নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ঘটাতে এ বছরের ২৩ মার্চ দরপত্র ডাকল, যার পরিমাণ ৯,০০০ কোটি টাকা। এই দরপত্র ডাকা হয়েছিল সারা দেশে ৫০,০০০ নতুন স্থলের আধুনিকিকরণ ঘটানো, বর্তমানে যে টাওয়ারগুলো রয়েছে সেগুলোকে উন্নত করে তোলা, অনেক নতুন টাওয়ার বসানো ইত্যাদির জন্য। অর্থাৎ, ৪জি পরিষেবা প্রদানের নেটওয়ার্ক জোগানো ও সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যেই দরপত্র। কিন্তু বিএসএনএল দরপত্র ডাকার পরই টেলিকম যন্ত্র নির্মাতাদের দেশীয় সংস্থাগুলোর সমিতি টিইপিসি (টেলিকম ইকুইপমেন্ট এণ্ড সার্ভিস এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিল) বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চিঠি দিয়ে অভিযোগ জানাল যে বিএসএনএল-এর দরপত্রে দেশীয় সংস্থাগুলোর অংশগ্ৰহণকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, দরপত্র এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে বহুজাতিক সংস্থাগুলিই অংশগ্ৰহণ করতে পারে, ওই দরপত্রে মোদী সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতিকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এই চিঠি পাওয়ার পরপরই সরকারের পক্ষে কি ভয়ঙ্কর তৎপরতাই না দেখানো হল। প্রোমোশন অব ইন্ডাস্ট্রিজ এন্ড ইন্টারনাল ট্রেড দপ্তর ২২ এপ্রিল টেলিকম দপ্তরের সচিবকে চিঠি দিয়ে বলল “আসাধু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে” বিএসএনএল-এর যে সমস্ত অফিসার “দেশীয় নির্মাতাদের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শর্ত চাপিয়েছে” তাদের বিরুদ্ধে “শাস্তিমূলক ব্যবস্থা” গ্ৰহণের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। এছাড়া, ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে চীনা পণ্য বয়কটের জিগিরের পথ ধরে বিএসএনএল-এর ওপর চাপানো হল নিষেধাজ্ঞা – চীনা কোম্পানিগুলোর তৈরি টেলিকম যন্ত্রপাতি কেনা যাবে না। আর যায় কোথা, বিএসএনএল-কে তাদের দরপত্র বাতিল করতে হল, ৪জি পরিষেবা দেওয়ার পরিকল্পনা পড়ে গেল বিশ বাঁও জলে। এই প্রতিকূলতা থেকে বিএসএনএল আর কোনোদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা, পারলেও কত দেরিতে পারবে, তা আজ আর কারুর পক্ষেই বলা সম্ভব নয়।
বিএসএনএল-এর দরপত্রে বলা ছিল যে, যারা এই দরপত্রে অংশ নিতে চায় তাদের গত দু-বছরের বাৎসরিক আয় ৮,০০০ কোটি টাকা হতে হবে, আর ২০ মিলিয়ন ৪জি লাইন জোগানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই শর্তই নাকি দেশীয় নির্মাতাদের অংশগ্ৰহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিএসএনএল-এর পক্ষে বলা হয়েছে এই দুটো শর্ত এই কারণেই রাখা হয়েছিল যে – যারা এই বিপুল পরিমাণ যন্ত্রপাতির জোগান দেবে তাদের যথাযথ আর্থিক সঙ্গতি আছে কিনা তা দেখে নেওয়া, এবং ৪জি পরিষেবা প্রদানের বিপুল নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা আছে কিনা তা যাচাই করা। যে সমস্ত শর্তের তথাকথিত লঙ্ঘনের জন্য বিএসএনএল-কে তার দরপত্র বাতিল করতে হল, সেই সব শর্ত মানার দায় কিন্তু রিলায়েন্স, এয়ারটেল, ভোডাফোন-আইডিয়ার মতো বেসরকারী কর্পোরেট সংস্থার নেই। তারা নোকিয়া, এরিকসন, স্যামসাং-এর মতো বহুজাতিকদের কাছ থেকে যন্ত্রপাতি কেনার সাথে হুয়েই ওজেডটিই-র মতো চীনা সংস্থার কাছ থেকে যন্ত্রপাতি কিনছে এবং কিনতে পারবে। বিশ্বমানের উৎকৃষ্ট যন্ত্রপাতি নির্মাণের নজির যারা এখনও প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি, সেই ‘দেশীয় নির্মাতাদের’ কাছ থেকে যন্ত্রপাতি কেনা তথা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতিকে সার্থক করে তোলার দায় বিএসএনএল-এর থাকলেও বেসরকারী সংস্থাগুলোর নেই, আর চীনা পণ্য বয়কটের মতো মহান জাতীয়তাবাদী আবেগে শামিল হওয়ার পরীক্ষায় তাদের পাশ না করলেও চলবে!
বিএসএনএল-এর কর্মীরা জানিয়েছেন, এর আগে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ২জি পরিষেবার যন্ত্রপাতি কেনার সময়ও ভারতের বহু হাইকোর্টেই বিএসএনএল-এর বিরদ্ধে মামলা করা হয়েছিল এবং সেই সমস্ত মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে বিএসএনএল-এর প্রায় দেড় বছর লেগে গিয়েছিল। বিএসএনএল-কে অবিলম্বে ৪জি পরিষেবা প্রদানের অধিকার দেওয়া এবং পুনরুজ্জীবন প্যাকেজের রূপায়ণের দাবিতে বিএসএনএল-এর কর্মীরা ২৬ জুন সারা দেশে ধর্ণা সংগঠিত করেন। মাস্ক পরে ও দূরত্ব বিধি মেনে বড় শহরে ১০ জন ও ছোট শহরে ৫ জন করে ধর্ণায় অংশ নেন। আজও বিএসএনএল-কে আটকানোর পিছনে শুধুই কি ‘দেশীয় নির্মাতাদের’ স্বার্থ রক্ষার আকাঙ্খা ও জাতীয়তাবাদী আবেগই কাজ করছে? বিএসএনএল-এর কর্মী ইউনিয়ন ও সমিতিগুলোর (এইউএবি) সম্পাদক অভিমন্যু বলেছেন এর পিছনে রয়েছে ‘কায়েমি স্বার্থরা’। কারা এই কায়েমি স্বার্থ? এরা হল “জিও, এয়ারটেল, ভোডাফোন-আইডিয়ার” মতো বেসরকারী কর্পোরেট সংস্থা, যারা বিএসএনএল-এর ৪জি পরিষেবা প্রদানের সম্ভাবনায় আতঙ্কিত। আর অভিযোগকারী টিইপিসি-ভুক্ত দেশীয় নির্মাতাদের চরিত্রই বা কেমন? অভিমন্যুর কথায় এরা এমন “অকিঞ্চিৎকর সংগঠন” যাদের সহজেই “কিনে নেওয়া যায়”। অভিমন্যুর স্পষ্ট কথায়, “আমি বলছি যে, টিইপিসি-র করা অভিযোগের পিছনে বেসরকারী অপারেটরদের হাত আছে। … আমি সোজাসুজি বলছি, নরেন্দ্র মোদী চাননা যে বিএসএনএল পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠুক, কেননা সেটা তাঁর বন্ধু মুকেশ আম্বানিকে আঘাত করবে।” নীতি মানার দায় যখন সবার জন্য প্রযোজ্য না হয়ে বেছে নেওয়া কোন সংস্থার ওপরই চাপানো হয়, দেশীয় নির্মাতাদের স্বার্থ রক্ষা এবং ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতিকে পালন করার কর্তব্য থেকে বেসরকারী সংস্থাগুলোকে রেহাই দিয়ে সেই দায়িত্ব পালনে যখন শুধু বিএসএনএল-কেই দায়বদ্ধ করা হয়, তখন সেই নীতির প্রতি সরকারের আন্তরিকতা অন্তঃসারশূন্য হয়েই দেখা দিতে বাধ্য। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিপর্যয় ঘটিয়ে পেটোয়া বেসরকারী ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর স্বার্থের প্রতি অনুগত হওয়াটা ‘আত্মনির্ভরতার’ অভিলাষকে কপট বলেই প্রতিপন্ন করছে।