দেশে চলছে নয়া এক হীরক রাজার শাসন। যার নারকীয়তার নজির মিলছে প্রায় প্রাত্যহিক। এর নিশানার এক অন্যতম শিকার “জনগণের কবি” পরিচয়ে প্রখ্যাত তেলুগু কবি ভারভারা রাও। প্রগতিবাদী কাব্য সৃজনে ও জন-আন্দোলনের সপক্ষে অবিচল থাকা এই রোগজর্জর বৃদ্ধ যোদ্ধা আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবী সহ দু’বছর ধরে কারাবন্দী। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) ও মহারাষ্ট্র সরকারের যোগসাজশে ‘ভীমা কোরেগাঁও’ মামলায় জড়িত অভিযোগে। এই গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে, বন্দীদশা থেকে মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়েছে দেশ-বিদেশের অসংখ্য গণকন্ঠ। কিন্তু মুক্তি মেলেনি। অধুনা চরম অবনতি হয়েছে কবির শারীরিক অবস্থার, তবু চূড়ান্ত অবহেলা করা হচ্ছে তাঁর চিকিৎসার প্রশ্নে। বাইরে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার বন্দোবস্ত না করে ফেলে রাখা হয়েছিল কারার ঐ কুঠুরিতে। কোনও দাবি, কোনও আবেদনের সুরাহা মিলছিল না। পরন্তু কর্তৃপক্ষ মনে করছে কবির অবস্থা নাকি ‘স্থিতিশীল’! চিকিৎসকের জায়গায় বিবৃতি দিচ্ছিলেন পুলিশ ও কারা প্রশাসনের কর্তারা! তবে প্রবল জনমতের চাপে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে ভারভারা রাওকে বাইরের হাসপাতালে ভর্তি করতে।
এমনতর রাষ্ট্রীয় দমন ও নিয়ন্ত্রণের ঘটনা ও প্রবণতা সংঘটিত হচ্ছে অজস্র। তার কিছু যেমন সংবাদ জগতের খবর হয়, আন্দোলনের বিষয় হয়ে ওঠে, বহু কিছু থেকে যাচ্ছে অজানা, অধরা। দমন-পীড়ন চালাচ্ছ রাষ্ট্রশক্তি শুধুমাত্র নয়, রাষ্ট্র বহির্ভূত শক্তিগুলিও। কুখ্যাত আইন কানুনে যেমন কারারুদ্ধ করা হচ্ছে, বিনা বিচারে বছরের পর বছর বন্দী করে রাখা হচ্ছে, তেমনি শোনানো হয় ‘এনকাউন্টারে মৃত্যু’-র গল্প। আর রাষ্ট্রশক্তির থেকে মদত পায় রাষ্ট্র বহির্ভূত শক্তিগুলির দ্বারা পরিকল্পিত সংগঠিত সমস্ত অপরাধ। যেমন ‘ভীড় ঘটিয়ে হত্যাকান্ড’ বা বিশিষ্টজনদের হত্যার ঘটনা। যারা এর শিকার তারা রাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলনের প্রতিনিধি, বামপন্থী-গণতান্ত্রিক-যুক্তিবাদী-প্রগতিশীল প্রতিবাদী ব্যক্তিবর্গ, দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। শিল্প সাহিত্য তথা বিজ্ঞান ও গবেষণা কাজে যুক্ত বিদ্বজ্জনও রেহাই পাচ্ছেন না। সর্বত্র গণতন্ত্রের ওপর খড়গহস্ত হচ্ছে ফ্যাসিবাদী শাসকেরা। তারা বেঁধে দিচ্ছে ‘গণতন্ত্রের সংজ্ঞা’, তার বেচাল হলেই দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা! কখনও বা তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘দেশকে টুকরো টুকরো করা’র পন্থী বলে।
সরকারের নীতি-আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুললে, তর্কবিতর্ক জুড়লে, স্বরূপ উন্মোচন করলে, সমালোচনা, বিরোধিতা করলে বা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে, নিপাত যাক আহ্বান জানালে ছাপ মেরে দেওয়া হয় একইভাবে! এমনকি দেশ যখন বিগত মার্চ মাসের গোড়া থেকে কোভিড আক্রান্ত হচ্ছিল তখন তার মোকাবিলায় একমুখী অগ্রাধিকার না দিয়ে মোদী সরকার ব্যস্ত ছিল ‘সিএএ-এনপিআর-এনআরসি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ‘দেশের শত্রু’ খোঁজার ফ্যসিস্ট উন্মত্ততাকে চরমে তুলতে, সাম্প্রদায়িক আক্রমণ নামাতে। অন্যদিকে সফরে আসা ট্রাম্প সাহেবকে ‘দেশের বন্ধু’ বানাতে! গণতন্ত্র, দেশপ্রেম, ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রগতিশীল জাতিয়তাবাদ নির্ণয় ও জনগণের জীবন-জীবিকার নির্ধারণের প্রশ্নে মোদী আমল যত বেশি পর্যুদস্ত হচ্ছে যুক্তির লড়াইয়ে, ততই কুখ্যাত সব আইন কানুনের জোরে নামাচ্ছে দমন পীড়ন। কুখ্যাত আইনগুলির বন্দোবস্ত রয়েছে কম কিছু নয়। এনএসএ, ইউএপিএ, সিডিশন এ্যাক্ট, ক্রিমিনাল ডিফেমেশন এ্যাক্ট ইত্যাদি রয়েছেই। এছাড়া রাজ্য বিশেষে রয়েছে আরও বিশেষ বিশেষ সব কুখ্যাত কানুন, যেমন কাশ্মীরে লাগু রয়েছে ‘জন সুরক্ষা আইন’। তবু মোদী সরকার বিরত হওয়ার নয়। এমনকী মারণঘাতী করোনার বিপদ আর পীড়াদায়ক লক ডাউনের পরিস্থিতিতে, যখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে শাসকপক্ষকে সরাসরি চেপে ধরার উপায়গুলি হয়ে গেছে অনেকটাই অসুবিধাজনক, সেই প্রতিকূলতার সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ তৎপর হয়েছেন নয়া উদ্যোগে, দুঁদে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বানিয়েছেন এমন একটা কমিটি যার উদ্দেশ্য হল, কুখ্যাত আইনগুলির আরও কত কড়া সংজ্ঞায়ন ও এক্তিয়ারের সম্প্রসারণ ঘটানো যায় সেটাই।