বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন স্তরে চলা ঋণমুক্তি আন্দোলনের বিষয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে একটি অনলাইন মিটিং সংগঠিত করে সমগ্র বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয় এবং কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দেশ জুড়েই ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষের খুবই বড় একটা অংশ। বন্ধনের মতো মাইক্রো ফাইনান্স কোম্পানিগুলি চড়া সুদ নিচ্ছে এবং আদায়ে যথেচ্ছাচার চালাচ্ছে। অবিলম্বে এ প্রশ্নে সরকারি নিয়ন্ত্রণ জরুরি। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মহিলাদের ঋণফাঁদ কেটে বার হতে কাজ ও নিয়মিত উপার্জনের ব্যবস্থা দরকার। স্বনির্ভরতার এই প্রশ্নে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এই বিষয়গুলিকে কেন্দ্রে রেখে বৃহত্তর আন্দোলন সংগঠিত করতে গ্রামাঞ্চলে একযোগে সর্বত্র উদ্যোগ নিতে হবে পার্টিকে।
সরকার বারবার শিল্পপতিদের ঋণমুক্ত (রাইট-অফ) করে, বেল আউট দেয়, ছাড় দেয়। বিজয় মাল্যদের ব্যাঙ্কের টাকা মেরে বিদেশ পালাতে সাহায্য করে। উল্টো পরিস্থিতিতে আছে আমজনতা। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মহিলারা জড়িয়ে পড়েন ঋণফাঁদে; ইএমআই দিতে না পারায় সরকারি/বেসরকারী ব্যাঙ্ক, মাইক্রো ফাইনান্সের মহাজনদের বেলাগাম চাপের মুখে দিশেহারা দরিদ্র গ্রামবাসী; কৃষক থেকে গ্রাম-শহরের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, কাজ হারিয়ে নিয়মিত উপার্জনহারা শ্রমিক, কর্মচারী, বহুজাতিক কোম্পানির দ্রুত প্রসারমান ছাঁটাই কর্মীরা। এই বৈপরীত্যে ঋণমুক্তি আন্দোলন প্রাসঙ্গিক ও সম্ভাবনাময়।
প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে প্রতিদিন মানুষ কাজ হারাচ্ছেন, কর্মী-ছাঁটাই চলছে। এমতাবস্থায়, হাউস বিল্ডিং লোন, অন্যান্য ফাইনান্সের ইএমআই মেটাতে দিশেহারা গ্রাম-শহরের মধ্যবিত্তদেরও বিরাট অংশ। শহরাঞ্চলেও মাইক্রো ফাইনান্সের চড়া মহাজনী কারবার নিম্নবিত্তদের মধ্যে জাল বিস্তার করেছে। উপরিউক্ত দাবিগুলিতে শহরাঞ্চলও আমাদের উদ্যোগের অপেক্ষায়।
সাধারণভাবে, ঋণমুক্তি কমিটির নামে আমরা এই আন্দোলন কর্মসূচী সংগঠিত করতে পারি। কোথাও ‘কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি’ ও কোথাও বা ‘প্রগতিশীল মহিলা সমিতি’ এই আন্দোলন সংগঠিত করছে।
এই আন্দোলনের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল –
(১) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে স্বতস্ফূর্তভাবে, নিচুতলার চাপে।
(২) আন্দোলনকারীদের অধিকাংশই মহিলা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতা, বিস্তার ও গতিময়তার লক্ষ্যে আন্দোলনরত মহিলাদের নেতৃত্বের সামনে আনার কাজটি গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।
(৩) পঞ্জাবের অধিকাংশ জেলায় এই আন্দোলন আয়ারলা সংগঠকদের উদ্যোগে ছড়িয়েছে। আসামেও কয়েকটি জেলায় পার্টি কর্মীরা সামনে আছেন। সেখানে ১২টি সংগঠনকে (অন্যরা এনজিও) নিয়ে গড়ে উঠেছে যৌথ মঞ্চ। তামিলনাড়ুতে আমাদের আন্দোলনের চাপে একাধিক জেলাশাসক মাইক্রো ফাইনান্সের জুলুমবাজির বিরুদ্ধে মাইক-প্রচার সহ খবরের কাগজে নোটিশ দিতে বাধ্য হয়েছেন। বিহারের চলমান আন্দোলনকে বৃহত্তর আকার দিতে উদ্যোগ চলছে।
এই পরিস্থিতিতে আগামী ১৩ আগস্ট, স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে, দেশজুড়ে সর্বত্র যথেষ্ট উদ্যোগ, প্রস্তুতি ও গুরুত্ব সহকারে “ঋণ মুক্তি দিবস” পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সাথে গ্রাম ও এলাকা স্তরে বৈঠক, বিডিও ও জেলা শাসকের কাছে ডেপুটেশন ইত্যাদি উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য, যেখানে জনগণের মধ্যে দুটি প্রধান শিবিরে বিভক্ত হয়ে থাকার দীর্ঘ প্রবণতা, সেখানে ঋণ মুক্তি কমিটির মতো বৃহত্তর অ্যাপ্রোচ নিয়ে মানুষকে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করছে।
ইতিমধ্যে হুগলির বেশ কয়েকটি ব্লক ও বর্ধমানের জামালপুর, মেমারী, মন্তেশ্বর ব্লকেও উদ্যোগ বিকাশ লাভ করেছে। নতুন এই ব্লকগুলিতে বিডিও ডেপুটেশনের প্রচেষ্টা চলছে। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি সহ এরাজ্যে আমাদের পার্টি কাজের গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলিতে দ্রুতই ঋণ মুক্তি কমিটি গঠন করে উদ্যোগ শুরু করার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
ফিনান্স পুঁজির এই দৌরাত্ম্য, আধুনিক কোম্পানির আড়ালে মহাজনী কারবারের ফিরে আসা – এসব নিয়ে তত্ত্বগতভাবে আরো সমৃদ্ধ হওয়াও এসময় গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ বলে কেন্দ্রীয় বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কমরেড শংকর, সজল অধিকারী সহ অন্যান্য কমরেডরা ধারাবাহিক আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে এই কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
কেন্দ্রীয় কমিটির এই বৈঠকে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, পলিটব্যুরো সদস্য কবিতা কৃষ্ণান, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ সহ বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে কর্মরত নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন এবং পরবর্তীতে এরকম বৈঠক আবার সংগঠিত করা হবে বলে জানিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক।
- সজল অধিকারী