স্বাস্থ্য অব্যবস্থা প্রাণ কাড়লো করোনা যোদ্ধা সিস্টার কবিতার
sister

প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট। অথচ হাসপাতালে ভেন্টিলেটর ফাঁকা নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা অক্সিজেনের অভাবে চরম কষ্ট পেয়ে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন কবিতা। আমরা হারালাম করোনা বিরোধী লড়াইয়ের একজন প্রথম সারির যোদ্ধাকে। আবারো প্রমান হলো কোভিড চিকিৎসায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা কি ভয়ঙ্কর! লকডাউন – নাইট কার্ফু নামে সারা দেশকে ঘরবন্দী করার উদ্দেশ্য ছিলো তো সংক্রমণের গতি কমিয়ে প্রস্তুতির জন্য সময় কেনা। অথচ দু মাসাধিক সময় অতিক্রান্ত করে ভগ্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আজ যেন অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়েছে!

নৈহাটির বাসিন্দা কবিতা দত্ত মজুমদার বারাসাত হাসপাতালের সিস্টার-ইন-চার্জ ছিলেন। করোনা আবহে গত মার্চ মাস থেকে হাসপাতালে প্রচন্ড কাজের চাপ। এই চাপ তিনি আর নিতে পারছিলেন না। শরীর ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। অথচ ছুটি নেই। তাঁর মেয়ে গার্গী জানালেন “হাসপাতালে স্টাফ কম থাকায় মা টানা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৫ মে মা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন ১০৭ ডিগ্রি জ্বর ও প্রচন্ড পেটের যন্ত্রনা নিয়ে। সঙ্গে উচ্চ রক্ত চাপ ও সারা দেহে অসহ্য ব্যাথা।” বাড়ির লোক সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু করোনা আতঙ্কে ( যেহেতু উচ্চ জ্বর) নৈহাটি ও কল্যাণী হাসপাতাল এমনকি‌ রোগীকে দেখতেও অস্বীকার করে। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত বারাকপুর অঞ্চলের একমাত্র কোভিড হাসপাতাল টেকনোগ্লোবে ভর্তি করা হয়। তাঁর প্রথম রিপোর্ট কোভিড নেগেটিভ আসে। প্রায় ১০ দিন এই হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। ডাক্তারদের মতে রোগীর অন্ত্রে সংক্রমণ। খুব দ্রুত নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে যায় ও অবস্থাও ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। এর মধ্যেই দ্বিতীয়বার কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় তাঁকে ঐ কোভিড হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।

আবার অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ২৫ মে আরজিকরে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়। এখানকার ডাক্তাররা বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে অন্ত্রে নয়, কবিতার স্পাইনাল কর্ডে ইনফেকশন। তাঁর অসার নিম্নাঙ্গে সংক্রমণ তখন ভালোমাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। ডাক্তাররা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানায় এবার ঊর্ধাঙ্গে যদি ছড়িয়ে পড়ে তবে তার শ্বাসকষ্ট সহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেবে। কয়েকদিন রোগী স্থিতিশীল থাকার পর ৩১ মে অবস্থা ক্রমশ‌ অবনতি হতে থাকে, শুরু হয় প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট। রোগীর প্রয়োজন ভেন্টিলেটর। কিন্তু যেহেতু কোভিড হাসপাতাল থেকে রোগী এসেছে, তাই ভেন্টিলেটর দিতে রাজি নয় মেডিসিন বিভাগ। তাই বাড়ির লোক তাঁকে কোভিড চিকিৎসা বিভাগে ভর্তি করান।

কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। সেখানেও ভেন্টিলেটর ফাঁকা নেই। চরম কষ্ট ভোগ করতে করতে প্রায় বিনা চিকিৎসায় ১ জুন মারা গেলেন কবিতা। দীর্ঘদিনের নার্স, কত রোগীকে সেবার মাধ্যমে সুস্থ করে ঘরে ফিরিয়ে দিয়ে আজ নিজে চলে গেলেন চিকিৎসা সেবা না পেয়ে!

এখন তো মরেও শান্তি নেই! হাসপাতাল থেকে বাড়ির লোককে জানিয়ে দেওয়া হলো ৩১ মে কবিতার নমুনা সংগ্রহ করে কোভিড টেস্টে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত মরদেহ বাড়ির হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। দু-দুবার কোভিড নেগেটিভ রোগী কবিতার মৃত্যুর পরের দিন রিপোর্ট আসলো কোভিড পজিটিভ। তাই মৃতদেহ বাড়ির লোকের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। মর্গেই থাকবে। প্রশাসন তার সুবিধা মতো কোনো একদিন কোনো এক জায়গায় দাহ করবে। পরিবারের লোক তাদের প্রিয়জনকে শেষ বিদায় পর্যন্ত জানাতে পারলো না।

বারাসাত হাসপাতালের সুপারের বক্তব্য তার হাসপাতালে এখনো কোনো করোনা কেস নেই। তাই হয়তো করোনা আক্রান্ত হয়েছে বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের একমাত্র কোভিড হাসপাতাল টেকনোগ্লোব থেকেই। ঐ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই তাই তাঁর রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। স্বাস্থ্য দপ্তর পরিবারকে জানিয়েছে যে তারা এই মৃত্যুর তদন্ত করে দেখবে। জানিনা ‌বাড়ির লোক সেই রিপোর্ট দেখতে পাবে‌ কি না?

এখন কবিতার একমাত্র মেয়ে সদ্য গ্র্যাজুয়েট গার্গী করোনা আক্রান্ত হয়ে বেলাঘাটা আইডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই রিপোর্ট লেখার সময় জানতে পারলাম গার্গীর অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হ‌ওয়ায় তাকে আইসিইউ থেকে জেনারেল বেডে দেওয়া ‌হয়েছে। ওর বাবা আছেন সরকারী কোয়ারিন্টাইন সেন্টারে। কবিতার ভাই বোন সহ ৫টি পরিবার হোম কোয়ারিন্টাইনে। কবিতার বারবার কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট আসায় এই‌ পরিবারগুলি‌ মিসগাইড হ‌ওয়ার ফল ভোগ করছে।

কবিতার ভাই কমরেড বরুনাভ দত্ত হোম কোয়ারিন্টাইন থেকে ফোনে জানালেন যে “করোনা মোকাবিলায় রাজ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুন কঙ্কাল দশা আবার বে-আব্রু হলো আমার দিদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এই অবস্থা বদলাতে সোচ্চার হতে হবে আমাদের সবাইকে। সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বাড়ানোর। না হলে দেখতে হবে এই ভাবে বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পেয়ে চলে যেতে আমাদের অনেক প্রিয়জনদের। সে বড় বেদনাদায়ক !”

আমরা কবিতা দত্ত মজুমদারের অকাল প্রয়াণে গভীর শোক জ্ঞাপন করছি।‌ তাঁর পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি। দাবি করছি তার মেয়ে গার্গীর চিকিৎসা যেন সরকার উপযুক্ত দায়িত্ব নিয়ে তত্ত্বাবধান করে। আমরা গার্গীর দ্রুত আরোগ্য লাভ কামনা করি। রাজ্যে‌ প্রথম সিস্টার কোভিড শহীদ কবিতা দত্ত মজুমদারকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে আসুন আমরা সকলে মিলে এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সোচ্চার হ‌ই।

– সুব্রত সেনগুপ্ত 

খণ্ড-27